সিদ্ধার্থ আর রঞ্জিতরা সিনেমা বা বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে, তাদের কলকাতার কোনও সিঙ্গল স্ক্রিন হলের অন্ধকারে বসে থাকতে পারত একমনে, ‘মেরা নাম জোকার’ দেখতে গিয়ে? ব্রাত্য বসু রচিত ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের ইন্দ্র, যে সময়ের প্রতি হতাশ, ক্ষুব্ধ তরুণ, সে হৃতিক রোশনের একটি ছবি দেখতে গিয়েও বেরিয়ে আসে। ময়দানে এসে বসে একা। কারণ ছবিটা তার ভাল লাগছিল না। তার বাবা, সব্যসাচী সেন, যে ছাব্বিশ বছর ধরে শীতঘুমে ছিল, রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো, এবং নতুন সময়কে আদৌ আত্মস্থ করেনি, সে ‘হৃতিকের ছবি’ শুনে অবলীলায় বলে, ‘ঋত্বিক ঘটক সিনেমা বানাচ্ছেন এখনও?’
৩.
সিদ্ধার্থ হেঁটে যাচ্ছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হনহন করে। পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ভীষণ রাগের দেওয়াল লিখন। হঠাৎ তার চোখে পড়ছে এক গণপিটুনির দৃশ্য। সে মিশিয়ে দিতে চাইছে নিজের রাগ ওই গণহিংসার আসরে, যে রাগ একটু আগে বন্দুক হয়ে তাক হতে চাইছিল তার বোনের শীতল বসের দিকে, শোষণের খুলিতে একদলা বুলেট হয়ে যা গেঁথে যেতে চাইছিল একটু আগে। বড়লোকের গাড়ি ঘিরে সেই জটলা যেন পারলেই শ্রেণিক্রোধের অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে সিদ্ধার্থর ভেতরে। হঠাৎ তার মাঝেই চোখে পড়ে গেল সিদ্ধার্থর; একলা একটি মেয়ে, সেই গাড়ির জানলায় মুখ রেখে বসে। সিদ্ধার্থ পিছিয়ে গেল, সমষ্টির মধ্যে একা ওই কিশোরীর কথা ভেবে। শ্রেণির প্রতিনিধিত্বে তাকেও শত্রু ঠাওরাতে পারে সিদ্ধার্থ, কিন্তু এভাবে নয়। শেষত তাই নেগেটিভে কঙ্কাল হয়ে ওঠা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে সিদ্ধার্থ, একাই। কিন্তু সকলের হয়ে। ইন্টারভিউর টেবিল উলটে যে নৈরাজ্য সে তৈরি করে, তা তার দ্রোহমনকে মূর্ত করে তোলে।
একইভাবে রঞ্জিত কিছুটা থমকায় বারবার। সে জানে হয়তো বা মনের কোনও গহিনে, একদিন না একদিন সে ফুঁসে উঠবেই। থানায় গিয়ে পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে, বা ইন্টারভিউর টেবিলে সে হয়তো সিদ্ধার্থর মতো ধারালো নয়। সে হয়তো জোরের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ইভেন্ট’ বলে দাবি করে বসে না, কিন্তু তার ভেতরের জমা অঙ্গার তো একদিন না একদিন ছিটকে যাবেই কাচে বন্দি ম্যানিকুইনের শরীর লক্ষ করে। সে তা জানে। সে জানে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অন্তত তার দ্বিধা থাকবে না কবুল করতে, যে তার সত্যিই রাগ হয়েছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
হিন্দি সিনেমা প্রায় দিবাস্বপ্নর শামিল। এবং সেই স্বপ্নকে হতে হবে ততটাই কৌম, যতটা না হলে সেই ছবির আবেদন সর্বজনীন হবে না। তাঁর ‘লাভার্স ইন দ্য ডার্ক’ নিবন্ধে তাই দেখাতে চেয়েছেন সুধীর, সিনেমা হলের অন্ধকারে কীভাবে হিন্দি সিনেমা এই বিপুল উপমহাদেশের ফ্যান্টাসি পোষে। আর তার উদাহরণ হিসেবে রাজ কাপুরেরই ‘রাম তেরি গঙ্গা মেয়লি’ (১৯৮৬) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন তিনি, যা বক্স অফিসে ঝড় তোলা হিট ছিল। কিন্তু কেন ‘ববি’ (যে ছবি আদতে দেনা চুকিয়ে রাজ কাপুরকে আবার ব্যবসায় ফেরাল) থেকে রাজ কাপুরের এই বদল দিব্য ফ্যান্টাসির ফ্যান্টমদের সফল করল, আর কেন একলা জোকারকে খুলিগুহার অন্ধকারে বিলীন হতে হল?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সিদ্ধার্থ আর রঞ্জিতরা সিনেমা বা বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে, তাদের কলকাতার কোনও সিঙ্গল স্ক্রিন হলের অন্ধকারে বসে থাকতে পারত একমনে, ‘মেরা নাম জোকার’ দেখতে গিয়ে? ব্রাত্য বসু রচিত ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের ইন্দ্র, যে সময়ের প্রতি হতাশ, ক্ষুব্ধ তরুণ, সে হৃতিক রোশনের একটি ছবি দেখতে গিয়েও বেরিয়ে আসে। ময়দানে এসে বসে একা। কারণ ছবিটা তার ভালো লাগছিল না। তার বাবা, সব্যসাচী সেন, যে ছাব্বিশ বছর ধরে শীতঘুমে ছিল, রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো, এবং নতুন সময়কে আদৌ আত্মস্থ করেনি, সে ‘হৃতিকের ছবি’ শুনে অবলীলায় বলে, ‘ঋত্বিক ঘটক সিনেমা বানাচ্ছেন এখনও?’ সময়ের ভেদরেখায় দাঁড়িয়ে, বলিউডের গোলকায়িত চেহারা এবং হৃতিক রোশন নামে একজন হিরোর উত্থান সম্পর্কে অন্ধকারে থাকা, গোঁড়া পুরনো বামপন্থী সব্যসাচী সেন ভাবতেই পারেনি, ‘হৃতিক’ বলতে অন্য কিছু বোঝানো আদৌ সম্ভব। সব্যসাচীর যৌবন, আর তার রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্দ্রর যৌবনের তফাত এটাই, সব্যসাচীর মনের তারুণ্যে ঋত্বিক ঘটকের নাম তার মুখ উজ্জ্বল করে তোলে, আর ইন্দ্র, তার সময়ের যৌবনের সঙ্গে স্বর মেলাতে পারে না। তাই হৃতিক রোশনের ছবি, যার নাম এই নাটকে জানাও যায় না, সেই ছবিতে সে আনন্দ পায় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সময়ের কিছু আগেই রামগোপাল ভার্মা বানিয়ে ফেলেছেন ‘সত্য’, যার চিত্রনাট্য যৌথভাবে লিখে নজরে আসবেন অনুরাগ কাশ্যপ নামে এক তরুণ। যিনি কিনা এমটিভি-র ক্যামেরা চুরি করে কিছুদিন পর বানাবেন তাঁর শর্ট, ‘লাস্ট ট্রেন টু মহাকালী’। সদ্য আসা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের জোয়ারে ‘স্টার বেস্টসেলারস’-এর জন্য ছবি বানাচ্ছেন তিগমাংশু ধুলিয়া, হনসল মেহতার মতো নাম। তারপর তো ওই ‘সত্য’-র সংগীত পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ বানাবেন ‘মাখড়ি’, আর অনুরাগ কাশ্যপ বানাবেন ‘পাঁচ’ (যা আবার রিলিজই করবে না), কিছু বছর পর শ্রীরাম রাঘবন বানাবেন ‘এক হাসিনা থি’। অর্থাৎ বলিউডের সমান্তরাল গতিপথ নির্মাণের সেই শুরু, যার অভিঘাত পাওয়া যাবে বাংলা ছবিতেও, ব্রাত্য বসুই যখন ‘রাস্তা’ বানাবেন। তার আগে ‘চক্রব্যূহ’-র মতো ছবি বাংলায় হয়েছিল বটে, কিন্তু ভড়ংহীন মেনস্ট্রিমে গ্যাংস্টারের গল্প বলা বাংলায় সেই প্রথম। তবে সেসব গল্প পরের জন্য জমানো থাক।
সুধীর কাকার মনে করেছিলেন, হিন্দি সিনেমা প্রায় দিবাস্বপ্নর শামিল। এবং সেই স্বপ্নকে হতে হবে ততটাই কৌম, যতটা না হলে সেই ছবির আবেদন সর্বজনীন হবে না। তাঁর ‘লাভার্স ইন দ্য ডার্ক’ নিবন্ধে তাই দেখাতে চেয়েছেন সুধীর, সিনেমা হলের অন্ধকারে কীভাবে হিন্দি সিনেমা এই বিপুল উপমহাদেশের ফ্যান্টাসি পোষে। আর তার উদাহরণ হিসেবে রাজ কাপুরেরই ‘রাম তেরি গঙ্গা মেয়লি’ (১৯৮৬) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন তিনি, যা বক্স অফিসে ঝড় তোলা হিট ছিল। কিন্তু কেন ‘ববি’ (যে ছবি আদতে দেনা চুকিয়ে রাজ কাপুরকে আবার ব্যবসায় ফেরাল) থেকে রাজ কাপুরের এই বদল দিব্য ফ্যান্টাসির ফ্যান্টমদের সফল করল, আর কেন একলা জোকারকে খুলিগুহার অন্ধকারে বিলীন হতে হল? কেন সিনেমা হলের আঁধারে সিদ্ধার্থ-রঞ্জিতদের চোখ জ্বলে উঠল না রাজুর মাতৃপ্রীতি ও মাতৃশোক দেখে, যেমনটা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর ফয়জলের হয়, তার চোখে পদস্খলিত মাকে ছাপিয়ে গিয়ে অমিতাভ বচ্চনের মাতৃপ্রেমে সে আকুল হয়ে কাঁদে প্রেক্ষাগৃহের আলো-অন্ধকারে?
আদতে এই ছবি, কিঞ্চিৎ তলিয়ে দেখলে, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে একেবারে সোভিয়েত মডেল থেকে তুলে এনেছিল ভারতীয় চরিত্রদের আধারে। রাজু তার অসুস্থ মাকে নিয়ে যে সার্কাস-জীবনে বেরিয়ে পড়ে, তার সঙ্গে ভারত-সোভিয়েত সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর মতো একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বা ‘নয়া দৌড়’-এ যে নেহরুশাসিত ভারতের ছবি উঠে আসছিল, সেই ভারতের বিদেশনীতির সূত্র ধরেই এক নিজস্ব প্রেম ও দুঃখবাদের দুনিয়া তৈরি করতে চান রাজ কাপুর। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী তাঁর যেসব ছবি, অর্থাৎ ‘আগ’, ‘বরসত’ বা ‘আওয়ারা’ সাদা-কালোয় তৈরি করেছিল তাঁর চ্যাপলিনীয় ইমেজ, যা কাঁদিয়ে ছেড়েও দর্শককে ফিরিয়ে এনেছিল পর্দার সামনে, সত্তরের ওই অদ্ভুত সময়ে তা আর কাজ করল না। শেষত ব্যর্থ, বিশ্বাসহত, একলা, আহত প্রেমিক হিসেবে থেকে যাওয়া রাজু তাই কবীর সুমনের গানের পঙক্তির মতো রোদে পোড়া জলে ভেজা বেঞ্চে সমকালের আত্মা হয়ে বসতে পারল না।
আরও একটি বেশ গুরুতর বিষয় ছিল এই ছবিতে, যা যৌনতা নিয়ে তখনও নড়বড়ে থাকা ভারতীয় দর্শকমনে সেভাবে সেঁধোতেই পারেনি। তা হল এই ছবির নায়ক রাজুর স্কুলছাত্রাবস্থায় শিক্ষিকার স্নান অবলোকন ও স্বপ্নে তাকে নগ্ন দেখে প্রেমে পড়ার ঘটনা। এই শিক্ষিকা, মেরিকে অবশ্যম্ভাবীভাবে খ্রিস্টান করে এবং রাজুকে স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য চার্চে পাঠিয়ে আবার আরেক কেলেঙ্কারি করেছিলেন রাজ কাপুর। এই বাইবেলীয় পাপের বিষয়ে রাজ কাপুর কি কিছুটা অনুপ্রাণিত ছিলেন বছরসাতেক আগে সেই আশ্চর্য ছবি ‘এইট অ্যান্ড আ হাফ’ থেকে? যেখানে কড়া ক্যাথোলিক স্কুলে পড়া অবদমিত গাইডো সারাহিনার দ্বারা প্ররোচিত হওয়ার পর, তার প্রবল অপরাধবোধের কামড় থেকে ফেদরিকো ফেলিনি তৈরি করে ফেলেন চার্চের সর্বময়তা নিয়ে প্রায় এক পৌরাণিক প্রতিসন্দর্ভ? কিন্তু রাজু সেই জটিলতায় যায় কই? সে তো প্রেমেই পড়ে মেরির, এবং তাকে পুতুল পাঠিয়ে নেমন্তন্ন করে তার ‘শেষ’ পারফরম্যান্সে, তার বাকি দুই প্রেমিকার পাশাপাশি। এবং জোকার একা হলেও খেলা দেখিয়ে যাবে, এই বিরহের নোটে যখন মিলে যায় ছবির সুর, তখন বুঝতেই হয়, অমন একটি প্রেমকে সততই স্বীকৃতি দিয়েছেন রাজ কাপুর। আদতে কারও গোপন স্বপ্নে তা টোকা মারেনি কি? না কি তা হারিয়ে গিয়েছিল হলভর্তি আলোর দাপট মিলিয়ে যেতেই? সিদ্ধার্থ-রঞ্জিতদের এসব নিষিদ্ধ গহন নিয়ে ভাবার সময় বা পরিসর ছিল কি আদৌ? সমসময় সেই অবকাশ তাদের জন্য রাখছিল?
(চলবে)
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল