আত্মজীবনী লেখার অভিপ্রায়ে এই গ্রন্থরচনা নয়। বস্তুত আত্মজীবনী লেখার উপজীব্য যে অন্তর্জীবন, তাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে বহির্জীবনকে আধার করে এই স্মৃতিআলেখ্য নির্মাণ করেছেন লেখক। এগারোটি পরিচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি উপবিভাগ। সেখানে ঘুরেফিরে এসেছে লেখকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের কেন্দ্র করেই এই গ্রন্থের বিনির্মাণ। অনেকটা যেমন মূল নদীতে অসংখ্য উপনদীর সহাবস্থান, ঠিক তেমনই।
স্মৃতি সততই সুখের। কথাটা আংশিক সত্য। স্মৃতির যাত্রাপথে সুখময় অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে দুঃখবোধ। সেই সুখ-দুঃখের মিলিত সম্ভার দাগ কেটে যায় হৃদয়ে। স্মৃতিচারণায় ভিড় করে আসে তার টুকরো টুকরো কোলাজ। লেখক প্রদীপ রায়গুপ্তের ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ তেমনই দুই মলাটে বন্দি স্মৃতি-আলেখ্য। যেখানে সময়ের পথ-পরিক্রমায় ভিড় করে এসেছে লেখকের ছেলেবেলা, অভিভাবক থেকে আত্মীয়-পরিজন, কর্মজীবন থেকে মানসলোক, লেখার জগৎ। আর এসেছে বাঙালির নানা পালাপার্বণ থেকে সংস্কার, সংস্কৃতি। তা উঠে এসেছে লেখকের চেতনায়।
জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, সময়ের ঘষা লাগলেও যা আজও স্মৃতিপটে ফিকে হয়ে যায়নি, তাকেই সাদা পাতায় কালির মায়াজালে বাঁধতে চেয়েছেন লেখক। ‘ঋতাক্ষর’ প্রকাশিত ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ তাই এক অর্থে ছিন্নপত্রের সমাহার। জীবন-নদীতে হাল ধরে বসে আছেন লেখক, ভেসে যাচ্ছে ভাসা-ভাসা অতীত। পাঠক একবার ‘ছিন্ন পাতার তরণী’তে সওয়ার হলেই লেখকের চোখ দিয়ে দেখতে পাবেন সেই ভেসে যাওয়া অতীতকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পাতাবাহার: শিল্প নিয়ে কোনও টিকরমবাজি রেয়াত করতেন না অহিভূষণ মালিক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
নৌকার হাল ধরে যিনি বসে, সেই লেখকের পরিচিতিটাও তাই পাঠপ্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জন্মসূত্রে কোচবিহার শহরটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন লেখক প্রদীপ রায়গুপ্ত। ছোটবেলায় পড়াশোনাও সেখানেই। ছোটবেলায় দেখা সেই ফেলে আসা কোচবিহার শহরটা ধরা পড়েছে লেখকের কলমে। যেমন ধরা পড়েছে কলেজ জীবনে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক জীবন। সিভিল সার্ভিস (আইএএস) পরীক্ষায় পাস করে ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা অন্যখাতে বয়েছে। নাগপুর থেকে গুয়াহাটি, দিল্লি থেকে কলকাতা– দেশের বিস্তৃত পরিসরে চাকরি-জীবন যে ব্যক্তি প্রদীপ রায়গুপ্তের লেখকসত্তাকে পরিপুষ্ট করেছে, তা অনস্বীকার্য। তবে লেখায় সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল আগেই। সাতের দশকে ছাত্রাবস্থায় কবিতার হাত ধরে যে লেখনীর উদ্ভাস, সেই প্রদীপ-শিখা আজও সমুজ্জ্বল। কতটা দীপ্তিময় তার প্রকাশ, তার দৃষ্টান্ত এই ‘ছিন্ন পাতার তরণী’।
আত্মজীবনী লেখার অভিপ্রায়ে এই গ্রন্থরচনা নয়। বস্তুত আত্মজীবনী লেখার উপজীব্য যে অন্তর্জীবন, তাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে বহির্জীবনকে আধার করে এই স্মৃতিআলেখ্য নির্মাণ করেছেন লেখক। এগারোটি পরিচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি উপবিভাগ। সেখানে ঘুরেফিরে এসেছে লেখকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের কেন্দ্র করেই এই গ্রন্থের বিনির্মাণ। অনেকটা যেমন মূল নদীতে অসংখ্য উপনদীর সহাবস্থান, ঠিক তেমনই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘ছিন্ন পাতার তরণী’র পালে দমকা হাওয়ার মতো হাজির হয়েছে ‘নস্ট্যালজিয়া’। আর সেই স্মৃতিমেদুরতার আর এক নাম হল– ক্রিকেট। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয় একটা মাইলস্টোন। প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয় জনতার কাছেও তাই। লেখক প্রদীপ রায়গুপ্তও তার ব্যতিক্রম নন। পিতৃসূত্রে ক্রিকেটপ্রীতি লাভ করেছিলেন, তা পরবর্তীতে খেলাটার প্রতি একটা আলাদা আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল। ব্যস্তময় ‘ভবঘুরে’ কর্মজীবনের ফাঁকে ক্রিকেট খেলেছেন চুটিয়ে। সেই অভিজ্ঞতার কথা ঠাঁই পেয়েছে তাঁর এই স্মৃতিকথায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শৈশব থেকে কৈশোর, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব– জীবনচক্রের সোপান ধরে ধরে স্মৃতিকথার এক একটা ইট গেঁথেছেন রচনাকার। স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খেয়েছে লেখকের প্রিয়জনের স্নেহ-মমত্বে, সৌহার্দ্যে। অনেকক্ষেত্রে তা জন্ম দিয়েছে একঘেয়েমির। পাশাপাশি খেদের বিষয়, সময়ের অভিঘাত ধাক্কা দেয়নি লেখকের স্মৃতির তরণীটিকে। তাই মুক্তির দশকে কলকাতার উপকণ্ঠে থেকেও উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে নকশাল আন্দোলন, তার প্রভাব। উহ্য রয়ে গিয়েছে সাতের দশকের রাজ্য-রাজনীতি, রাজনৈতিক পালাবদলের কথা। তবে আশ্চর্যের, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে ঠাঁই পেয়েছে শীতলকুচি-প্রসঙ্গ, যা সাম্প্রতিক অতীতে রাজনৈতিক গোলযোগে ছিল সংবাদ শিরোনামে। একইভাবে উত্থাপিত হয়েছে ‘করোনাকালের ডায়েরি’। অতিমারীর প্রভাবে দেশজুড়ে যে দমবন্ধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল গোটা দেশ, তার শরিক লেখক নিজেও। সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণে বিচার করেছেন এই লেখায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পাতাবাহার: সংগীতের সুর ধরে মিলেমিশে গিয়েছে গুরু-শিষ্যের জীবনচিত্র
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘ছিন্ন পাতার তরণী’র পালে দমকা হাওয়ার মতো হাজির হয়েছে ‘নস্ট্যালজিয়া’। আর সেই স্মৃতিমেদুরতার আর এক নাম হল– ক্রিকেট। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয় একটা মাইলস্টোন। প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয় জনতার কাছেও তাই। লেখক প্রদীপ রায়গুপ্তও তার ব্যতিক্রম নন। পিতৃসূত্রে ক্রিকেটপ্রীতি লাভ করেছিলেন, তা পরবর্তীতে খেলাটার প্রতি একটা আলাদা আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল। ব্যস্তময় ‘ভবঘুরে’ কর্মজীবনের ফাঁকে ক্রিকেট খেলেছেন চুটিয়ে। সেই অভিজ্ঞতার কথা ঠাঁই পেয়েছে তাঁর এই স্মৃতিকথায়। সঙ্গে আছে ’৮৩-এর প্রসঙ্গ।
কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের সেই প্রথম বিশ্বকাপ জয় কতটা যে প্রভাবিত করেছিল লেখককে, তা ফুটে উঠেছে ‘এইটি-থ্রী: একটি নস্ট্যালজিয়া’ পরিচ্ছেদে। সাদা-কালোয় মোড়া সেই ফেলে আসা স্মৃতি নতুন করে জাগরিত হয়েছে রণবীর সিং অভিনীত ‘৮৩’ সিনেমার হাত ধরে। ধারাবিবরণীর ছক-ভেঙে কিছুটা বিশ্লেষকের ভূমিকা অবতীর্ণ হয়ে লেখক বলেছেন, ‘আসল মানসিং-এর চেহারা কেমন ছিল আমি জানি না, কিন্তু ওই চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠীকে আমার দারুণ ভালো লেগেছে। এখনকার কোচদের মতো তখনকার ম্যানেজারদের অত বোলবোলাও ছিল না। নামী খেলোয়াড়দের পাশে তাংরা ঈষৎ সংকুচিত থাকতেন। মানসিং-এর ক্যাপটেন কপিলের প্রতি অগাধ আস্থা, কপিলের কমিউনিকেশন স্কিলের ঘাটতি যথাসম্ভব পুষিয়ে দেওয়া, সর্বদা দলের মধ্যে সংহতি বজার রাখার চেষ্টা, হতাশা ও আনন্দের অনতিসোচ্চার অভিব্যক্তি সবকিছুই পঙ্কজের নিয়ন্ত্রিত অভিনয়ে চমৎকার ফুটেছে। রণবীরের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।’
ক্রিকেটের মতোই এসেছে গল্প ও কবিতা লেখার প্রসঙ্গ। একবুক সাহস নিয়ে ‘দেশ’-এর গল্পবিভাগের দায়িত্বে থাকা বিমল করকে ফোন, কিংবা দিন পনেরো সময়ে উপন্যাস লিখে দেওয়ার প্রস্তাব পাওয়া ঠাঁই পেয়েছে ‘বিভিন্ন আকাশের গল্প ও বিমল কর’ পরিচ্ছেদে। যা এই স্মৃতিকথার অন্যতম আকর্ষণ। এসবের মধ্যে দিয়েই মূর্ত হয়েছে রক্তমাংসের এক জীবনরসিকের আবছা অবয়ব।
ছিন্ন পাতার তরণী
প্রদীপ রায়গুপ্ত
ঋতাক্ষর
৩৫০ টাকা