Robbar

আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 5, 2024 5:00 pm
  • Updated:March 5, 2024 5:00 pm  

বিজ্ঞানের সাধনা যেমন আমাদের প্রাকৃতিক জ্ঞানের বন্ধন মোচন করে, তেমনি আমাদের প্রেমের বন্ধন, আনন্দের বন্ধন মোচন করে মঙ্গলের সাধনা। মঙ্গলসাধনায় আমাদের প্রেম স্থান-কালের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে অনন্তে মিলিত হয়। পাপপরিশূন্য মঙ্গলসাধনায় প্রেম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে যা আছে, কোনও কিছুকেই আমাদের প্রেম তখন ত্যাগ করে না। পরিচিত অপরিচিতের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে, দূরত্বের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে, সমস্তকেই সে তখন সত্য আর পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে।

অভীক ঘোষ

৪.

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপনকে কেন্দ্র করে নানাদিকে নানা আয়োজনের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তির পথ’ শিরোনামের উপদেশটির কথা মনে পড়ল। যে অভিভাষণটির প্রথম পঙক্তিগুলি হল, ‘যে-ভাষা জানি নে সেই ভাষার কাব্য যদি শোনা যায় তবে শব্দগুলো কেবলই আমার কানে ঠেকতে থাকে, সেইভাষা আমাকে পীড়া দেয়। ভাষার সঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখন শব্দ আর আমার বাধা হয় না। তখন তার ভিতরকার ভাবটি গ্রহণ করবামাত্র শব্দই আনন্দময় হয়ে ওঠে, তখন তাকে কাব্য বলে বুঝতে পারি, ভোগ করতে পারি।’

মাতৃভাষার অধিকার আমাদের কাছে মূল্যবান কারণ সে ভাষায় ভাবপ্রকাশ সহজ হয়। শুধু নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা নয়, অন্যের ভাবের প্রকাশ বুঝতে পারাও সহজ হয় মাতৃভাষাতেই। সেই প্রকাশ যদি কেবলমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে সেই প্রয়োজনটুকু বোঝাতে বা বুঝতে পারার জন্য অপরিচিত ভাষাটির সঙ্গে কাজ-চালিয়ে-নেওয়া পরিচয় করে নিতেই হয়। কিন্তু মানুষ তো কেবল জীবনধারণের প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, তার চাই প্রয়োজনের অতীত আনন্দ। সেইজন্যই তো কাব্যের সৃষ্টি। কাব্য-সাহিত্যের সৌন্দর্যরসের গভীর আস্বাদন অপরিচিত ভাষায় সম্ভব হয় না। সে কাব্য আমাদের নিরর্থক আর পীড়াদায়ক মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ এই অভিভাষণে মানুষের ভাষায় রচিত মানুষের কাব্যের কথা বলেননি, বিশ্বকাব্যের কথা বলেছেন। সেই কাব্যের আনন্দের পরিচয় পেতে হলে যে ভাষা আমাদের শিখতে হবে, তার কথা বলেছেন। কারণ, ‘জগৎ যদি আমাদের আনন্দ না দেয়, তবে বিশ্বকবির এই বিরাট কাব্যকে অর্থহীন অমূলক পদার্থ বলে এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াকেই আমরা চরিতার্থতা বলব।’ তাই, সেই আনন্দের ভাষা শেখাকেই বলেছেন মুক্তির পথ।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

মাতৃভাষার অধিকার আমাদের কাছে মূল্যবান কারণ সে ভাষায় ভাবপ্রকাশ সহজ হয়। শুধু নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা নয়, অন্যের ভাবের প্রকাশ বুঝতে পারাও সহজ হয় মাতৃভাষাতেই। সেই প্রকাশ যদি কেবলমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে সেই প্রয়োজনটুকু বোঝাতে বা বুঝতে পারার জন্য অপরিচিত ভাষাটির সঙ্গে কাজ-চালিয়ে-নেওয়া পরিচয় করে নিতেই হয়। কিন্তু মানুষ তো কেবল জীবনধারণের প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, তার চাই প্রয়োজনের অতীত আনন্দ। সেইজন্যই তো কাব্যের সৃষ্টি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ছোট ছেলেমেয়েরা অচেনা দুর্বোধ্য কোনও ভাষায় কাব্যপাঠে বাধ্য হলে তাদের ভালো লাগে না, কষ্ট হয়। তাদের সেই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে হলে পাঠ বন্ধ করে দেওয়াই কি পথ? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ভাষাটি শিখে নিলে সেই পাঠ যখন তাদের কাছে সত্য হয়ে ওঠে, পূর্ণ হয়ে ওঠে, সেই হচ্ছে যথার্থ মুক্তি। ছোটদের দুর্বোধ্য পাঠের কষ্টের মতোই আমাদের ‘ভবযন্ত্রণা’। বিশ্বকাব্যের ভাষা না বোঝার যন্ত্রণা। আমাদের ভালো লাগছে না বলে সেই কাব্যকে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া কি সম্ভব? ‘বিশ্বকাব্যকে নিরর্থক অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করবার তপস্যায় প্রবৃত্ত না হয়ে বিশ্বকাব্য শোনাকে সার্থক করে তোলাই হচ্ছে যথার্থ মুক্তি।’

May be an image of 1 person and studying

বিশ্ব আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে আছে রূপে। সেই রূপের মধ্যে অরূপকে উপলব্ধি করার জন্য আমাদের যে ভাষাটি প্রয়োজন, তা হল আনন্দ। বইয়ের বাইরে বাইরে চোখ বুলিয়ে তাকে পাওয়া যায় না। নিজের ভিতরকার জ্ঞানের শক্তিতেই তাকে বুঝতে হয়। বিশ্বপ্রকাশের রূপের মধ্যে আনন্দকে দেখতে পেলে রূপের সৌন্দর্য আমাদের বাধা না হয়ে আনন্দ উপলব্ধির বাহন হয়ে ওঠে।

‘পাওয়াই পাওয়াকে টেনে নিয়ে আসে।’ মরুভূমির রসহীন শুকনো তপ্ত বাতাস যেমন মেঘের কাছ থেকে রস গ্রহণ করতে পারে না, তেমনি আমাদের মনের মধ্যে যদি আনন্দ না থাকে, তাহলে বিশ্বের যে আনন্দপ্রবাহ আমাদের ওপর দিয়ে চিরকাল অবিরাম প্রবাহিত, তার থেকে আনন্দের রস আমরা গ্রহণ করতে পারব না। আমাদের ভিতরে আনন্দ যখন জাগে, তখনই বাইরের আনন্দরূপ আমাদের কাছে অমৃতময় হয়ে ধরা দেয়। আমাদের হৃদয় পূর্ণ হয় প্রেমে।

বিজ্ঞানের সাধনায় বিশ্বপ্রকৃতিকে আমরা যখন জ্ঞানের চোখে দেখি, তখন যে সত্যকে আমরা পাই, সে কোনও বিচ্ছিন্ন জ্ঞান নয়। সেই জ্ঞান অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সমস্ত কাল এবং কাছে দূরের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে একই ঐক্যে অনন্তের সঙ্গে যুক্ত জ্ঞান। সেই জ্ঞানের দৃষ্টি ছাড়া সমস্ত বিশ্ব, ভূতপ্রেত-দৈত্যদানোর বিভীষিকায় ভরে থাকে।

বিজ্ঞানের সাধনা যেমন আমাদের প্রাকৃতিক জ্ঞানের বন্ধন মোচন করে, তেমনি আমাদের প্রেমের বন্ধন, আনন্দের বন্ধন মোচন করে মঙ্গলের সাধনা। মঙ্গলসাধনায় আমাদের প্রেম স্থান-কালের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে অনন্তে মিলিত হয়। পাপপরিশূন্য মঙ্গলসাধনায় প্রেম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে যা আছে, কোনও কিছুকেই আমাদের প্রেম তখন ত্যাগ করে না। পরিচিত অপরিচিতের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে, দূরত্বের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে, সমস্তকেই সে তখন সত্য আর পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে। এইভাবে আমাদের প্রেম যখন অজ্ঞান অহং-এর শাসন অতিক্রম করে বিশ্বের মধ্যে অনন্তের মধ্যে মুক্ত হয়, তখন সে যা পায়, সে-ই মুক্তি। তখনই জগতের সত্য আমাদের কাছে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়। মহাকবির চিরন্তন কাব্য আমাদের কাছে সার্থক হয়ে ওঠে।

 

…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল

পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই

পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব