এ কথা তো সত্যিই যে, মায়েদের জন্য এক নির্দিষ্ট আদল এঁকে রেখেছে সমাজ। বাহ্যিক পরিস্থিতি যাই হোক, অন্তরের সায় মিলুক কিংবা নাই মিলুক, সেই নির্ধারিত আদলে ঢুকতে না চাইলে জারি থাকবে সমাজের রাঙা চোখ। এমনিতেই ভালো আর মন্দের একরকম বাইনারিতে সবকিছুকে ভাগ করে নিতেই আমরা স্বচ্ছন্দ। সেখানে ওই সমাজনির্ধারিত ছকটিকেই ভালোর আখ্যা দিতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। কোন পরিস্থিতিতে, কোন তুল্যমূল্য বিচারে ওই উৎকর্ষের গণ্ডি টানা হয়েছিল, সে ইতিহাস সরিয়ে রেখে হিসেবের দাঁড়িপাল্লায় বারেবারে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে মেয়েদেরই।
‘দুঃখী বাতাসের মতো মা ঘুরছে, ফেরার রাস্তাটা
কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না
দুঃখী বাতাসের মতো ফিরে যাচ্ছে, যেমন অনেকে যায়
সেইভাবে মা-ও’
‘মায়ের জন্য কবিতা’-তে এ-কথা লিখেছিলেন অনিতা অগ্নিহোত্রী। মাতৃত্বের যে ঘেরাটোপ, তা বোধহয় এমনই এক বাতাসি বৃত্তের মতো, যেখানে কোনও দরজা খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্য কোথাও যাওয়ার, কিংবা হয়তো নিজের একান্ত ‘আমি’-র কাছে ফিরে আসার দরজাও হারিয়ে যায়। মা আর মাতৃত্বের সেই পথ ভোলা আর পথ খুঁজে দেখার যাত্রাকেই একরকমভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন অহনা বিশ্বাস, তাঁর ‘মাতৃত্ব’ বইয়ে। এই বইয়ের শিরোনামের সঙ্গে রয়েছে আরও একটি উপ-শিরোনাম, ‘মন্দ-ভালো মায়ের গল্প’। আর সেখান থেকেই স্পষ্ট, ‘মা’ এই শব্দের সঙ্গে যে ভালোত্বের একমাত্রিকতা জড়িয়ে, বা বলা ভালো যে বাধ্যতা জড়িয়ে, সেই নির্মিত কাঠামোকেই ভেঙেচুরে দেখতে চাইছেন লেখিকা।
এ কথা তো সত্যিই যে, মায়েদের জন্য এক নির্দিষ্ট আদল এঁকে রেখেছে সমাজ। বাহ্যিক পরিস্থিতি যাই হোক, অন্তরের সায় মিলুক কিংবা না-ই মিলুক, সেই নির্ধারিত আদলে ঢুকতে না চাইলে জারি থাকবে সমাজের রাঙা চোখ। এমনিতেই ভালো আর মন্দের একরকম বাইনারিতে সবকিছুকে ভাগ করে নিতেই আমরা স্বচ্ছন্দ। সেখানে ওই সমাজনির্ধারিত ছকটিকেই ভালোর আখ্যা দিতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। কোন পরিস্থিতিতে, কোন তুল্যমূল্য বিচারে ওই উৎকর্ষের গণ্ডি টানা হয়েছিল, সে ইতিহাস সরিয়ে রেখে হিসেবের দাঁড়িপাল্লায় বারেবারে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে মেয়েদেরই। যেহেতু মাতৃতন্ত্রকে হঠিয়ে সমাজের নিয়ন্ত্রণভার হাতে তুলে নিয়েছিল পুরুষ, নারী সেখানে হয়ে উঠেছিল ‘অপর’ বা ‘other’, কাজেই নারীকে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে সরিয়ে রাখার একরকম প্রয়াস সেখানে জারি ছিলই। মাতৃত্বের এক নির্দিষ্ট ভূমিকায় নারীকে ঢুকিয়ে ফেলাকেও সেই প্রয়াসেরই অংশ বলে দেখতে চান নারীবাদী গবেষকেরা, সিমোন দ্য বোভোয়া ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইয়ে যাকে বলেন ‘রিপ্রোডাক্টিভ স্লেভারি’। অবশ্য কেবল মায়ের ভূমিকাই নয়, একইসঙ্গে নারীর অন্যান্য সমাজনির্দিষ্ট ভূমিকাগুলিও কোনও মায়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েই থাকে। আর সেই ভূমিকার বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই উঁচিয়ে ওঠে শাস্তির খাঁড়া, যেমনটি ঘটেছে ‘পয়লা মে’ গল্পের সেই মায়ের সঙ্গে। যে মা সংসারের এই যাবতীয় ভূমিকায় নিজেকে ফুরিয়ে ফেলতে ফেলতে একদিনের জন্য সুখ আর স্বাধীনতা চুরি করে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও সেই সাহসের মূল্য তাঁকে চুকিয়ে দিতে হয়েছিল কড়ায়-গন্ডায়। আবার ‘ভাগের মা’ গল্পে মা হয়ে উঠেছেন গল্পের মধ্যে থাকা আরেক গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। স্বেচ্ছা অর্জিত সাহসে ভর করে নয়, সমাজের ছক তিনি ভেঙেছিলেন বাধ্যতায়, সন্তানকে রক্ষা করার মা-সুলভ তাগিদেই। অথচ মাতৃত্বের ভূমিকা পালনের সঙ্গে সঙ্গে ‘সতীত্ব’-এর বর্ম টিকিয়ে রাখাও নারীরই দায়। তাই দেখা যায়, তাঁকে কেবল পরিত্যক্ত করেই সম্পূর্ণ শাস্তি দেওয়া যায় না, উপরন্তু বেঁচে থাকা সেই মানুষের ট্র্যাজিক মৃত্যুর গল্প আওড়াতে আওড়াতে তা সত্যি করে তোলা হয়। অর্থাৎ পরিজনদের যে স্মৃতিলোক কোনও মানুষের আরেক বাসভূমি, সেই অন্তরঙ্গ ভিটেও কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর থেকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মাতৃত্বের এক নির্দিষ্ট ভূমিকায় নারীকে ঢুকিয়ে ফেলাকেও সেই প্রয়াসেরই অংশ বলে দেখতে চান নারীবাদী গবেষকেরা, সিমোন দ্য বোভোয়া ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইয়ে যাকে বলেন ‘রিপ্রোডাক্টিভ স্লেভারি’। অবশ্য কেবল মায়ের ভূমিকাই নয়, একইসঙ্গে নারীর অন্যান্য সমাজনির্দিষ্ট ভূমিকাগুলিও কোনও মায়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েই থাকে। আর সেই ভূমিকার বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই উঁচিয়ে ওঠে শাস্তির খাঁড়া, যেমনটি ঘটেছে ‘পয়লা মে’ গল্পের সেই মায়ের সঙ্গে। যে মা সংসারের এই যাবতীয় ভূমিকায় নিজেকে ফুরিয়ে ফেলতে ফেলতে একদিনের জন্য সুখ আর স্বাধীনতা চুরি করে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও সেই সাহসের মূল্য তাঁকে চুকিয়ে দিতে হয়েছিল কড়ায়-গন্ডায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে, অপত্যের জন্য মায়ের এই আত্মত্যাগ যেমন প্রচলিত নিয়মে সহজাত, একইভাবে এ-কথাও কিন্তু সত্যি যে, কখনও কখনও সমাজনির্ধারিত নীতি মেনে অপত্যকে ঘিরে থাকাও হয়ে ওঠে আরও এক ক্ষমতাতন্ত্রের প্রকাশ। ‘মাতৃতান্ত্রিক’ গল্পে মা ও ছেলের এক আত্মা হয়ে থাকা কেন সম্পর্কহীনতায় পালটে গেল, তার উত্তর খুঁজে এক পড়শি বুঝে নেন, আসলে তথাকথিত অসুন্দর এক মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েই মা চেয়েছিলেন মাতাপুত্রের পারস্পরিক আঁকড়ে ধরার অভ্যাসটি কায়েম রাখতে। তাই স্ত্রীর প্রতি ছেলের টান তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল অসহনীয়। আবার ‘শাশুড়ি’ গল্পে ‘ভালো’ শাশুড়ি হয়ে উঠতে চাওয়া অঞ্জনা শেষমেশ নিজের গোপনেই স্বীকার করে বসে, ‘নিজের ছেলে ছাড়া আর কারোর মা হবার তার প্রয়োজন নেই।’
‘মা ও মেয়ে’ গল্পে মেয়েকে যত্নের অছিলায় তার সমগ্র জীবনটাকেই নিজের শর্তে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন মা। আবার এক অদ্ভুত নার্সিসিজমে মেয়ের সাজসজ্জা-খুচরো প্রেম-যৌন অনুভূতিকে তারিয়ে তারিয়ে চেখে নেন ‘মেয়ের মা’, তিনিই যেন হয়ে ওঠেন নিজের মেয়ের ‘অল্টার ইগো’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: মেয়েদের কোনও বাড়তি হাত নেই, সে সমাজের চাপে পড়েই দশভুজা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আসলে যেকোনও মানুষের মতোই মাকেও কোনও বাইনারিতে বেঁধে ফেলা সমস্যার। প্রবৃত্তি আর চেতনার দড়ি টানাটানিতে অন্য যে কারও মতো বিক্ষত হন তিনিও, কোনও এক পক্ষের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করেন কিংবা জারি রাখেন লড়াই। সেই মানুষী সংলাপকেই এই ১৩টি গল্পে ঠাঁই দিয়েছেন লেখিকা। গল্পের এই সংখ্যা যদি সচেতন নির্বাচন হয়, তবে তার আরও এক ব্যঞ্জনা বোধহয় ভেবে নেওয়া যায় এই মাতৃত্বের প্রেক্ষিতেই। যিশুর শেষ সায়মাশের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া এই সংখ্যাটি এক অর্থে ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী। সুতরাং সমাজ যে মাতৃত্বের ভূমিকাকে এক দৈবী মহিমা দিয়েছে, এই সংখ্যাটি সেই মাহাত্ম্যকেই আঘাত করতে পারে একভাবে, বইটির সামগ্রিক ভাবনার নিরিখে এ কথা বোধহয় অসংগত হবে না।
মাতৃত্ব: মন্দ-ভালো মায়ের গল্প
অহনা বিশ্বাস
রাবণ
৩২৫ টাকা