স্মৃতির পার্থক্যই চিনিয়ে দেয়, কীভাবে এক দশক থেকে আরেক দশক, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যাতায়াতে বদলে যায় জনপ্রিয় সিনেমা ঘিরে উন্মাদনার চলাচল। আশিস রাজাধ্যক্ষ একুশ শতকের শুরুতে তাঁর একটি নিবন্ধে অত্যন্ত হতাশা সহকারে বলেছিলেন, ভারতের জাতীয় ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সিনেমা জড়িয়ে থাকার ইতিহাস যদি স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছরের হয়, তবে বলিউড নামক বেলুনটি ফুলেফেঁপে উঠেছে এক দশক হল। এক দশক, অর্থাৎ তাঁর এই মুসাবিদার নিরিখে। অতএব, গোলকায়িত দেশে যে সিনেমা জেঁকে বসেছে, তার মুম্বইকেন্দ্রিকতাকে তিনি দাগিয়ে দিচ্ছেন, এবং তাকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘বলিউডাইজেশন’।
৫.
১৯৬৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘গাইড’। দেব আনন্দ-ওয়াহিদা রহমান জুটির এই ছবি বলিউডের ইতিহাসের নিরিখে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার বিচারের আগেও বলা যায়, একটা সময়কালকে প্রায় ধরে রেখেছিল এই ছবি। একটা গোটা দশকের চিহ্ন কীভাবে হয়ে উঠেছিল ‘গাইড’, তা বোঝা যায়, যখন অনুরাগ কাশ্যপ ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর একটি রক্তারক্তি দৃশ্যে ছয়ের দশক বোঝাতে ন্যাড়া দেওয়ালে কেবল একটিমাত্র ‘গাইড’-এর পোস্টারকে সম্বল করেন। বাঙালি দর্শকের কাছেও ‘গাইড’ স্মৃতির নিরিখে এমনই এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে। পাঁচ-ছয়ের দশকে কৈশোর-বয়ঃসন্ধি কেটেছে, এমন এক প্রজন্মের ধারক হয়ে রয়েছে ‘গাইড’। এবং এটাও বুঝতে হবে, এই ছয়ের দশকের শেষভাগ ও সাতের শুরুতে যারা বয়সের ওই গোধূলিবেলা পেরচ্ছিল, তাদের কাছে দেব আনন্দ ধীরে ধীরে ফিকে হয়েছেন, বুড়ো হয়েছেন। ‘গাইড’, ‘হাম দোনো’-র সময় যারা দেখেছে, যারা দেখেছে ‘যব পেয়ার কিসি সে হোতা হ্যায়’, ‘কাঁহি অউর চল’-এর দেব আনন্দ-কে, আর ‘দুনিয়া’, ‘প্রেম পূজারী’ থেকে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’-র দেব আনন্দ-কে যারা দেখছে, তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম হলেও দেখার পার্থক্য হয়ে গিয়েছে।
আমার শিক্ষক পার্থ মুখোপাধ্যায় আবার যেমন বলছিলেন আরও কিছুটা পরের সময়ের কথা। আটের দশকের শুরু, বাম আমলে ‘পূর্ণশ্রী’ সিনেমায় ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকা সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতে হবে সন্ধে-সন্ধে, এমন অনুশাসনের মধ্যেই হঠাৎ চোখে পড়ে যায় একটি পোস্টার, ‘লুটমার’-এর। পরে লুকিয়ে, গোপন ও গর্হিত কাজের অজস্র অপরাধবোধ নিয়ে সে-ছবি দেখতে যাওয়া। সেই ছবির চিত্রনাট্য এবং প্রায় ষাটের দেব আনন্দের কলপ করা চুলে নায়ক হওয়ার চেষ্টা বেশ বিরক্তই করেছিল তখন কিশোর বয়সের আমার শিক্ষককে। তারও আগের প্রজন্মেরও এমনই লুকিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখার ইতিহাসে আবার হয়তো বা রয়েছে ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’-এর চাপা রোমাঞ্চ, যা অনেকাংশেই হয়তো দেব আনন্দ-এর থেকে বেশি অধিকার করে বসে আছেন তখনকার পুং-চোখে আবেদনময়ী জিনাত আমন। আবার তারও কিছুটা আগে রয়েছে ‘গাইড’-এর সম্মোহন, যেখানে শচীন দেব বর্মন অবশ্যই ভাগ বসাবেন দেব আনন্দের ক্যারিশমায়। ‘গাতা রহে মেরা দিল’-এর মেলডি ছাড়া, ‘দিন ঢল যায়ে’-র ওই অপূর্ব বিষাদ ছাড়া দেব আনন্দ আদৌ ফ্রেমে স্থির হয়ে থাকেন? ‘আভি না যাও ছোড়কর’ ছাড়া, ‘ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাথা চলা গয়া’ ছাড়া ‘হাম দোনো’-র দেব আনন্দ স্মৃতিতে থাকেন কি?
স্মৃতির এই পার্থক্যটুকুই চিনিয়ে দেয়, কীভাবে এক দশক থেকে আরেক দশক, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যাতায়াতে বদলে যায় জনপ্রিয় সিনেমা ঘিরে উন্মাদনার চলাচল। আশিস রাজাধ্যক্ষ একুশ শতকের শুরুতে তাঁর একটি নিবন্ধে অত্যন্ত হতাশা সহকারে বলেছিলেন, ভারতের জাতীয় ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সিনেমা জড়িয়ে থাকার ইতিহাস যদি স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছরের হয়, তবে বলিউড নামক বেলুনটি ফুলেফেঁপে উঠেছে এক দশক হল। এক দশক, অর্থাৎ তাঁর এই মুসাবিদার নিরিখে। অতএব, গোলকায়িত দেশে যে সিনেমা জেঁকে বসেছে, তার মুম্বইকেন্দ্রিকতাকে তিনি দাগিয়ে দিচ্ছেন, এবং তাকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘বলিউডাইজেশন’। এই সন্দর্ভের সঙ্গে জড়িত ভারতীয় সিনেমার আন্তর্জাতিক পরিচিতি নির্মাণও। রাজ কাপুর-খাজা আহমেদ আব্বাস জুটির সোভিয়েত অভিযানের প্রসঙ্গ আগেও উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে ভারতের সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক ও নেহরুভিয়ান বিদেশনীতির একটা প্রভাব ছিল, নয়ের দশক থেকে যা ঘটেছে বলে আশিস দাবি করছেন, তা মূলত বিশ্বায়িত ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটেরে চেহারা নির্মাণ। এই বিশ্বায়ন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অনেক ট্যাবু, অনেক ভাবধারাকে ধীরে ধীরে কাছাখোলা করেছিল, সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। কিন্তু এই যে সাত-আটের দশক অবধি হিন্দি সিনেমাকে কিঞ্চিৎ নিষিদ্ধর আওতায় ফেলার বাঙালি প্রবণতা, তা এই ‘বলিউডাইজেশন’-এর বেশ কিছুটা আগের কিসসা। ভারতীয় সিনেমা বলতে তখন বাঙালির কাছে কী, তাও বলা শক্ত, তবে বাংলা ও হিন্দি সিনেমা/বায়োস্কোপ/বই/ছায়াছবি- মূলত এই দুই মেরুর অবস্থান তো ছিলই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাজ কাপুর-খাজা আহমেদ আব্বাস জুটির সোভিয়েত অভিযানের প্রসঙ্গ আগেও উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে ভারতের সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক ও নেহরুভিয়ান বিদেশনীতির একটা প্রভাব ছিল, নয়ের দশক থেকে যা ঘটেছে বলে আশিস দাবি করছেন, তা মূলত বিশ্বায়িত ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটেরে চেহারা নির্মাণ। এই বিশ্বায়ন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অনেক ট্যাবু, অনেক ভাবধারাকে ধীরে ধীরে কাছাখোলা করেছিল, সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। কিন্তু এই যে সাত-আটের দশক অবধি হিন্দি সিনেমাকে কিঞ্চিৎ নিষিদ্ধর আওতায় ফেলার বাঙালি প্রবণতা, তা এই ‘বলিউডাইজেশন’-এর বেশ কিছুটা আগের কিসসা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর এই বিভাজনে কোনও একভাবে, নিষিদ্ধর বেড়াজালে পড়তে হত হিন্দি ছবিকেই। এর কারণের ময়নাতদন্তে যাওয়ার পূর্বসূত্রটুকু আপাতত ধরানো যেতে পারে, হিন্দি ছবি সাহসী হয়েছে খানিক প্রকাশ্যেই। কেবল হিন্দি নয়, উর্দু ছবির ইন্ডাস্ট্রিও খানিক জুড়ে যায় এর সঙ্গে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর খাণ্ডারনি মলিনা দেবীর, দেবকী বসুর উর্দু ছবি ‘দুলারী বিবি’-তে পিঠখোলা ও উরুর বিভঙ্গ দেখানো দুঃসাহসী ছবি দেখে কেউ চমকে উঠতে পারেন কেউ। আবার ফ্রানৎস ওসেনের ‘অচ্ছুৎ কন্যা’-য় দেবিকা রানি-অশোককুমারের চুম্বনদৃশ্যও চলে আসে এই প্রসঙ্গে। আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে, গান এবং গানের সঙ্গে নাচের অবধারিত যোগাযোগ। হিন্দি ছবির এই উচ্চকিত বেপর্দা হওয়া বাঙালির ভিক্টোরীয় নৈতিকতার অবশেষ ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের নতুন শিকড়মেশানো চেতনার কাছে খানিক বিপজ্জনক করে তুলেছিল বটে। তাই হিন্দি ছবি দেখার সঙ্গে পাপবোধ ও বড় হওয়ার একরকমের মুক্তি, কড়া অঙ্গুলিহেলনের উল্টোদিকে গোপন দ্রোহের মতো হয়তো অপ্রাপ্তবয়সের বিকেলগড়ানো শরীর-মনের উত্তেজনা মিশে যেত অবধারিতভাবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠেছে মনের এককোণে থাকা নির্মল কোনও স্মরণিকামাত্র। কখনও তাতে জড়িয়েছে হারিয়ে ফেলার বিষণ্ণতা, কখনও বা সেই তাৎক্ষণিক আনন্দের আশ্চর্য এলডোরাডোরা।
হিন্দি ছবির এই তথাকথিত গোপন ও যৌনগন্ধী হয়ে ওঠার গল্পটা অবশ্য আরও খানিকটা জটিল ও বহুস্তরীয়। তবে সেসবে ঢোকার আগে আমরা দেব আনন্দকে নিয়ে আরও কিছুটা গজল্লা করব। সেসব ইতিহাসচর্চা ও রোমন্থনের রাজনীতি নির্মাণের আগে একটা ছোট্ট গল্পে, এবং বলা বাহুল্য, শোনা গল্পে শ্বাস ফেলা যাক।
সাতের দশকের শেষ দিকের এক সন্ধে। এই বছর যাঁর শতবর্ষ, সেই উৎপলা সেনের কণ্ঠে একটি গান এই গল্পের কেন্দ্রে। সাতের দশকের শেষ ভাগ। ‘ঝিকমিক জোনাকির দ্বীপ জ্বলে শিয়রে/ চারিধার থমথম নিঃঝুম/ সাত ভাই চম্পা জেগে দেয় পাহারা/ পারুলের চোখে তাও নেই ঘুম’… এই পঙক্তি এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের আশ্চর্য সুর রেডিওতে বাজছে, পাড়াজুড়ে তা স্পন্দিত। এমন সময় হঠাৎ গান বদলাল সোচ্চার, ‘আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়’, লতা মঙ্গেশকরের তীক্ষ্ণ স্বর উৎপলা সেনের মন্দ্রগম্ভীর স্বরের আমেজ চুরমার করে দিল। পাড়ায় নিঃশব্দে ক্যারম খেলছিল নানা বয়সের লোক। তার মধ্যে এক টেনিদাগোত্রের মধ্যবয়সি লোক ঠোঁটের এককোণে টুথপিক চেপে ওই গানের উৎস জানলাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এই বাড়িটা তো অ্যাডাল্ট হয়ে গেল রে!’
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল