উপকরণ যদি অমৃত না হয়, তাহলে অমৃত কী? মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের স্পর্শ আমরা কোনখানে পাই? যেখানে আমাদের প্রেম। প্রেমই সীমার মধ্যে অসীমের স্পর্শ নিয়ে আসে। প্রেমেই আমরা অনন্তের স্বাদ পাই। সংসারে এই প্রেমের আভাস পাই। এই প্রেমকেই যখন পরিপূর্ণরূপে পাওয়ার জন্য আমাদের অন্তরাত্মার সত্য আকাঙ্ক্ষাকে চিনতে পারি, তখনই আমরা সমস্ত উপকরণকে অনায়াসে সরিয়ে রেখে বলে উঠতে পারি ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’?
৬.
শান্তিনিকেতনে বুধবার সকালে উপাসনা গৃহ বা মন্দিরে যে সাপ্তাহিক প্রার্থনা হয়, সেই প্রার্থনার একটি কাঠামো নির্ধারিত থাকে, সেকথা আগে বলেছি। একটি গানে প্রার্থনার সূচনা। প্রথম গানের পর সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত মন্ত্রোচ্চারণ, ‘ওঁ পিতানোহসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্তু’, তারপর দ্বিতীয় গান। দ্বিতীয় গানের পর রবীন্দ্রনাথ বা দেবেন্দ্রনাথের রচনা থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠ করেন সেদিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘আচার্য’। পাঠের পর তৃতীয় এবং শেষ গান। ‘আচার্য’ যিনি থাকেন, তাঁর আর একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব হল, পাঠ শেষ করতে হয় একটি বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে। মন্ত্রটি হল, ‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়– আবিরাবীর্ম এধি– রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্’।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় এই মন্ত্রটির অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন একাধিকবার। ‘প্রার্থনা’ শিরোনামে ২ পৌষ, ১৩১৫ তারিখে তাঁর অভিভাষণটি আমার খুব প্রিয়।
অভিভাষণের প্রথম স্তবকটি উদ্ধৃত করছি, ‘উপনিষৎ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি। এ যে কেবল সুন্দর শ্যামল ছায়াময়, তা নয়, এ বৃহৎ এবং এ কঠিন। এর মধ্যে যে কেবল সিদ্ধির প্রাচুর্য পল্লবিত, তা নয়; এতে তপস্যার কঠোরতা উর্ধ্বগামী হয়ে রয়েছে। সেই অভ্রভেদী সুদৃঢ় অটলতার মধ্যে একটি মধুর ফুল ফুটে আছে– তার গন্ধ আমাদের ব্যাকুল করে তুলেছে। সেটি ঐ মৈত্রেয়ীর প্রার্থনা-মন্ত্রটি।’
মন্ত্রটির প্রথম অংশ হল, ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’– আমি যাতে অমৃতা না হব তা নিয়ে আমি কী করব? ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যং গৃহত্যাগ করার সময় যখন তাঁর দু’জন পত্নীকে সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যাতে তাঁরা স্বচ্ছন্দে সংসারজীবন কাটাতে পারেন, তখন মৈত্রেয়ী এই কথা বলেছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অন্য একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ধর্মসাধনার দু’টি দিক, শক্তির আর রসের। পৃথিবীর সার্থকতা কঠিন শিলাস্তরের নয়, সবুজ ঘাসে। সেই অনুভবের সুর এখানে যেন শুনতে পাই। পুরুষঋষিদের ধ্যানে চিন্তায় লাভ করা জ্ঞানের মধ্যে একটা যেন কাঠিন্য আছে। মৈত্রেয়ীর এই প্রকাশের মধ্যে যে আন্তরিক ব্যাকুলতা, তা নিত্য-অনিত্যের ধ্যানলব্ধ সত্য নয়, মনের মাধুর্যের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘উপনিষদে সমস্ত পুরুষঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটিমাত্র স্ত্রীকণ্ঠের এই একটিমাত্র ব্যাকুল বাক্য ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এবং সে ধ্বনি বিলীন হয়ে যায় নি, সেই ধ্বনি তাঁদের মেঘমন্দ্র শান্তস্বরের মাঝখানে অপূর্ব একটি অশ্রুপূর্ণ মাধুর্য জাগ্রত করে রেখেছে।’
অন্য একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ধর্মসাধনার দু’টি দিক, শক্তির আর রসের। পৃথিবীর সার্থকতা কঠিন শিলাস্তরের নয়, সবুজ ঘাসে। সেই অনুভবের সুর এখানে যেন শুনতে পাই। পুরুষঋষিদের ধ্যানে চিন্তায় লাভ করা জ্ঞানের মধ্যে একটা যেন কাঠিন্য আছে। মৈত্রেয়ীর এই প্রকাশের মধ্যে যে আন্তরিক ব্যাকুলতা, তা নিত্য-অনিত্যের ধ্যানলব্ধ সত্য নয়, মনের মাধুর্যের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। তাঁর মনের মধ্যে যেন এক সহজাত কষ্টিপাথর ছিল, যার ওপরে সংসারের সমস্ত উপকরণ একবার ঘষে নিয়েই উপলব্ধি করেছিলেন, ‘আমি যা চাই এ তো তা নয়।’
‘সংসারে পিতা ও মাতার ভেদ আছে, কিন্তু বেদের মন্ত্রে যাকে পিতা বলে নমস্কার করছে, তার মধ্যে পিতা ও মাতা দুইই এক হয়ে আছে। তাই তাঁকে কেবল পিতা বলেছে।’ রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা শুনেছি। এখানে বলছেন, আমাদের প্রত্যেকের অন্তর-প্রকৃতির মধ্যে পুরুষ নারী এক হয়ে আছে। আমাদের পুরুষ সারাজীবন পরিশ্রম করে টাকা-খ্যাতি-ক্ষমতার বোঝা এনে আমাদের নারীর কাছে এনে জড়ো করে সুখী হওয়ার জন্য। আমাদের অন্তরের তপস্বিনী মনে করে এগুলোই বুঝি তার পাওয়ার জিনিস। কিন্তু তার মন তৃপ্ত হয় না, কখনওই বলতে পারে না সব পাওয়া হল। সে ভাবে পাওয়ার পরিমাণটাকে আরও বাড়াতে হবে, কিন্তু সেই আরও-র আর শেষ হয় না। একদিন সে বুঝতে পারবে আসলে সে অমৃতই চায়, আর, এই উপকরণগুলো অমৃত নয়।
মৈত্রেয়ী যে অমৃত চেয়েছিলেন, সেটা কী? শরীরের অমরতা তিনি চাননি। আত্মার নিত্যতা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার প্রকাশও এ নয়। তিনি এমন কিছু চেয়েছিলেন, যা পেয়ে মন বলতে পারে, আর কিছু চাই না। এক চাওয়া থেকে আর এক চাওয়া– ক্রমাগত এক মৃত্যু থেকে আর এক মৃত্যুর মধ্যে আমাকে যেন চলতে না হয়।
উপকরণ যদি অমৃত না হয়, তাহলে অমৃত কী? মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের স্পর্শ আমরা কোনখানে পাই? যেখানে আমাদের প্রেম। প্রেমই সীমার মধ্যে অসীমের স্পর্শ নিয়ে আসে। প্রেমেই আমরা অনন্তের স্বাদ পাই। সংসারে এই প্রেমের আভাস পাই। এই প্রেমকেই যখন পরিপূর্ণরূপে পাওয়ার জন্য আমাদের অন্তরাত্মার সত্য আকাঙ্ক্ষাকে চিনতে পারি, তখনই আমরা সমস্ত উপকরণকে অনায়াসে সরিয়ে রেখে বলে উঠতে পারি ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’?
রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করছেন, এই কথাটি বলেই মৈত্রেয়ী যেন জোড়হাতে উঠে দাঁড়ালেন, আর ‘তাঁর অশ্রুপ্লাবিত মুখটি আকাশের দিকে তুলে বলে উঠলেন– ‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোমামৃতং গময় আবিরাবীর্ম এধি– রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্’। আমরা যথার্থ কী চাই, তার একাগ্র অনুভূতির সহজ প্রকাশ এই বাণীতে। ‘হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্রেম উপবাসী হয়ে থাকে; হে জ্যোতি, গভীর অন্ধকার হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্রেম কারারুদ্ধ হয়ে থাকে; হে অমৃত, নিরন্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্রেম আসন্নরাত্রির পথিকের মতো নিরাশ্রয় হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। হে প্রকাশ, তুমি আমার কাছে প্রকাশিত হও, তাহলেই আমার সমস্ত প্রেম সার্থক হবে।’ হে আবিঃ, হে চিরপ্রকাশ, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক। হে রুদ্র, হে ভয়ানক, বিরহরূপে তুমি দুঃসহ, তোমার প্রসন্নসুন্দর প্রেমের মুখ আমাকে দেখাও। তোমার সেই প্রেমের প্রকাশেই আমার পরিত্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সমস্ত মানবহৃদয়ের একান্ত প্রার্থনাটি এই রমণীর ব্যাকুলকণ্ঠে চিরন্তনকালের জন্য বাণীলাভ করেছে।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব