গতিই কী সব? চলিষ্ণু জীবনে মোক্ষলাভে কি গতিই একমাত্র অবলম্বন? একটু থামার দরকার নেই? আছে বইকি। ক্রিকেট কিংবা খেলাধুলোর পরিসরে গতি চুম্বকের মতো মানুষকে আকর্ষণ করে। তাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। কিন্তু সেই উদযাপনটাই জীবনের সবকিছু নয়। জীবনকে চেনার জন্য, বোঝার জন্য একটু গতি মন্থরতার প্রয়োজন। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর ‘মর্ডান টাইমস’-এ জীবনে গতি ও স্বাভাবিক যাপনের তফাতটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সময় বাঁচাতে কারখানার শ্রমিককে খাওয়ার খাইয়ে দিচ্ছে যন্ত্র। যে যন্ত্র আসলে গতির দ্যোতক। সেই গতি লাগমছাড়া হলে দুর্গতির শেষ নেই, হাসির চাদর বিছিয়ে সেই জীবনশিক্ষাই তো কত সহজে দিয়েছেন চার্লি। তাই খেলার মাঠে গতি যতটা উপভোগ্য জীবনের ময়দানে ততটা নয়।
১৫৬.৭।
আইপিএল দুনিয়ায় এটাই এখন গতির নতুন সংজ্ঞা। যে গতির মালিক এক অনামী একুশ। যাঁর গতির প্রাবল্যে নড়েচড়ে বসেছে ক্রিকেটবিশ্ব। মুগ্ধতার আবেশে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের ‘গ্যালাক্সি’।
মায়াঙ্ক যাদব!
সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা নাম। পাঞ্জাব কিংস ম্যাচে শিখর ধাওয়ানের বিরুদ্ধে ঘণ্টায় ১৫৬.৭ কিলোমিটারের ডেলিভারি তাঁকে আইপিএল ইতিহাসে পাকাপাকি জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের বাইশ গজে পায়ের তলায় মাটি শক্ত করেছে পরপর দু’ম্যাচে হাফডজন উইকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মায়াঙ্ক থাকবেন কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে চর্চা শুরু হয়েছে। তবে ‘দিল্লি অনেক দূর’।
ক্রিকেট দুনিয়ায় এই মাতামাতি নতুন কিছু নয়। অতীতেও ঘটেছে, আজও হয়। চোখ বন্ধ করলেই আইপিএলে মায়াঙ্কের মতো ভেসে উঠবে ভূস্বর্গের উমরান মালিক থেকে অস্ট্রেলীয় পেস-দানব শন টেট, জেরাল্ড কোয়েৎজে থেকে লকি ফার্গুসনের নাম। আবার আইপিএল-জমিদারির বেড়া টপকে যদি বৃহত্তর ক্রিকেট মানচিত্রে চোখ রাখা যায়, তাহলে সেখানে দেখা মিলবে আরও অনেক ‘স্পিডস্টার’দের। পড়শি দেশের শোয়েব আখতার নিয়ে কথা পাড়লে আস্ত একখানা আরব্য রজনী তৈরি হয়ে যাবে। কিংবা সোনালি চুলের ব্রেট লি, সে তো নস্ট্যালজিয়া। কিংবা বিদ্যুতের ঝলক হয়ে মিলিয়ে যাওয়া কিউয়ি শেন বন্ড। ডেল স্টেইনের স্মৃতি ক্রিকেট-জনতার হৃদয় থেকে এত সহজে ফিকে হওয়ার নয়। আর রয় গিলক্রিস্ট, ডেনিস লিলি, ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস– নামগুলো তো এক একটা ক্রিকেট রোমান্স। যার যাপন আছে, যুগ যুগ ধরে, শুধু লয়-ক্ষয় নেই। মায়াঙ্ক সেখানে জায়গা করে নেবেন কি না, সেটা সময় বলবে। তবে অতীতের কীর্তিমানদের মতো তাঁর মধ্যেও একটা গুণ রয়েছে, তা হল– আগুনে গতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়শি দেশের শোয়েব আখতার নিয়ে কথা পাড়লে আস্ত একখানা আরব্য রজনী তৈরি হয়ে যাবে। কিংবা সোনালি চুলের ব্রেট লি, সে তো নস্ট্যালজিয়া। কিংবা বিদ্যুতের ঝলক হয়ে মিলিয়ে যাওয়া কিউয়ি শেন বন্ড। ডেল স্টেইনের স্মৃতি ক্রিকেট-জনতার হৃদয় থেকে এত সহজে ফিকে হওয়ার নয়। আর রয় গিলক্রিস্ট, ডেনিস লিলি, ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস– নামগুলো তো এক একটা ক্রিকেট রোমান্স। যার যাপন আছে, যুগ যুগ ধরে, শুধু লয়-ক্ষয় নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু গতিই কী সব? চলিষ্ণু জীবনে মোক্ষলাভে কি গতিই একমাত্র অবলম্বন? একটু থামার দরকার নেই? আছে বইকি। ক্রিকেট কিংবা খেলাধুলোর পরিসরে গতি চুম্বকের মতো মানুষকে আকর্ষণ করে। তাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। কিন্তু সেই উদযাপনটাই জীবনের সবকিছু নয়। জীবনকে চেনার জন্য, বোঝার জন্য একটু গতি মন্থরতার প্রয়োজন। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর ‘মর্ডান টাইমস’-এ জীবনে গতি ও স্বাভাবিক যাপনের তফাতটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সময় বাঁচাতে কারখানার শ্রমিককে খাওয়ার খাইয়ে দিচ্ছে যন্ত্র। যে যন্ত্র আসলে গতির দ্যোতক। সেই গতি লাগমছাড়া হলে দুর্গতির শেষ নেই, হাসির চাদর বিছিয়ে সেই জীবনশিক্ষাই তো কত সহজে দিয়েছেন চার্লি। তাই খেলার মাঠে গতি যতটা উপভোগ্য জীবনের ময়দানে ততটা নয়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে এক সুতোয় গেঁথে রাখতে দরকার সফল দাঁড়িকমা। গতির পিঠে সওয়ার হয়ে হয়তো বা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে, কিন্তু জীবনকে চেনা যাবে কি? না, যাবে না। তার জন্য দরকার বিরতি। যে বিরতি, স্থিতির সন্ধান চালিয়ে গিয়েছেন ‘ইছামতী’ উপন্যাসের ভবানী বাড়ুজ্যে, পলে পলে। তার সাংসারিক কামনা, বাসনার জগৎ পরিপূর্ণ। তবু আবহমান জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করার তাগিদ অনুভব করে ভবানী। গতির উল্টোস্রোতে দাঁড়িয়ে সাময়িক অবকাশ যাপন তাই প্রয়োজনীয়। মননকে সৃজনশীল করে তুলতে দরকার নিজেকে সময় দেওয়ার, দরকার আত্মকে অনুসন্ধানের– সেটা নির্জন পাহাড়ি পথের বাঁকে হতে পারে, হতে পারে কোনও নিভৃত একাকিত্বে মোড়া রেলস্টেশনে, কিংবা নিস্তব্ধ রাতে চেনা গৃণকোণে, নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: তোমার শেখানো পথেই প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ব্যস্তসমস্ত জীবনের ফাঁক গলে শান্ত, নিবিড়তার হাতছানিতে সাড়া দেওয়া প্রকৃত জীবধর্ম। আসলে তীব্র গতির উল্টো পিঠেই আছে শান্ত মায়াবী এক মায়া, এক মন্থর আলসে জীবন। আমাদের জীবনবোধে তা মিলে মিশে আছে বরাবর। ইঁদুরদৌড়ে মত্ত প্রাত্যহিক জীবনে সেই সত্যের তল অনেক সময় আমরা খুঁজে পাই না। উচিত-অনুচিত ভুলে শুধু ধাবমান হই, লক্ষ্যে পৌঁছনোর আত্মতৃপ্তি আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। কিন্তু তাতে অন্তরের ভাবনা, নিজেকে জানার সুযোগ মেলে না। অধরাই থেকে যায় জীবনের রহস্যগুলো। আমরা মনের জানলায় খিল এঁটে বেরিয়ে পড়ি গতির দুনিয়ায়, বন্ধ দুয়ারের ভিতর গুমরে মরে আমাদের চিন্তা, চেতনাগুলো। দিনের শেষে ক্লান্ত মন ভুলতে বসে সেই চেনা গল্পের সারসত্যটুকু– কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড়ে শেষ পর্যন্ত জিতেছিল কচ্ছপ।
গতি নয়, মন্থরতা!