পথচলতি মানুষজন নাক চেপে পেরচ্ছেন অঞ্চলটুকু। আমরাও, ঘণ্টাখানেক অবস্থান ও কথোপকথনের পর, কাহিল। শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবেশে বড় হওয়া আমরা দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎহীন (তাও এই তাপপ্রবাহের দিনকালে) থাকা যদিও-বা বুঝতে পারি, এমন পূতিগন্ধময় পরিবেশে বছরের পর বছর বসবাস কল্পনার বাইরে। আমি নিশ্চিত, মেলাতে পারবেন না বর্তমানের অজস্র উদ্বাস্তু পরিবারও (প্রাথমিক দশকগুলির সংগ্রাম ও দৈন্যদশা অনস্বীকার্য)। সেখানে প্রমোদনগর ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ‘পায়ের তলা’-য়, একটি-দুটি নয়, ৮০টি পরিবার।
‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।’
(এইসব দিনরাত্রি, বেলা অবেলা কালবেলা)
যে-সমস্ত ‘আশ্চর্য’ মানুষের কথা লিখতে চলেছি, তাঁদের জীবনানন্দ দাশ দেখেননি। দেখা সম্ভবও ছিল না। অথবা হয়তো অন্তর্দৃষ্টিতে দেখে ফেলেছিলেন; নইলে আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর কবিতা-পঙক্তি এমন হুবহু মিলে যায় কী করে! ‘আশ্চর্য’ শব্দটার আড়ালে বিস্ময় লুকিয়ে। কিন্তু বিস্ময় সবসময় সদর্থক হয় না, কখনও-কখনও তা হতাশাও নিয়ে আসে। ‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।’ ততোধিক ‘অন্ধকার’ এক জায়গার কথা লিখতে বসেছি আজ। এক উদ্বাস্তু কলোনির কথা।
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াতের সময় কিংবা মেট্রোয় নোয়াপাড়া-বরানগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অনেকেই পাহাড়প্রমাণ এক ভাগাড় দেখে থাকবেন। এত তীব্র দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত বাতাস, যে, নাক-মুখ চাপা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিছুক্ষণ সেই গন্ধ নাকে গেলে অনভ্যস্ত মানুষ অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে। সারাক্ষণ ধিকিধিকি আগুন। আশপাশের একাধিক অঞ্চলের বর্জ্য এসে জমা হয় সেখানে। পোশাকি নাম ‘প্রমোদনগর ভাগাড়’। অবস্থান দক্ষিণ দমদম পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে। আগে আশপাশের পুকুর ও অন্যত্র বর্জ্য ফেলা হলেও, বর্তমান ভাগাড়টিকে ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। প্রায় ২০ একর জায়গা জুড়ে ছড়ানো এই ভাগাড়ে ছ’টি পৌরসভার (উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদম, দমদম, নিউ ব্যারাকপুর, বরানগর ও কামারহাটি) কঠিন বর্জ্য জমা হয়। প্রতিদিন তার পরিমাণ আনুমানিক ৬০০ মেট্রিক টন। সেই ভাগাড়ের গা ঘেঁষেই অবস্থান করে এক ছোট্ট ‘পাড়া’, সাইনবোর্ডে যার পরিচয় ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড উদ্বাস্তু কলোনি’ নামে।
চোখ আটকেছিল এমন নামকরণের কারণেই। পথ চলতে চলতে থমকে যাওয়া তাই। প্রবেশ করা কলোনির গেট দিয়ে। পিছনে উঁকি মারছে ভাগাড়ের চূড়া। পাঁচিলঘেরা অংশের শুরুতেই ফাঁকা উঠোন গোছের, সেখানে অবসর পোহাচ্ছেন নারী-পুরুষরা। আর সেই উঠোন-লাগোয়া তিন-চার সারি ঘর, পরপর, টিনের। বিকেলের মেঘলাভাব কলোনির সর্বাঙ্গে। নাকি ভাগাড়ের ধোঁয়ার?
সাধারণত কলোনিগুলির নামকরণ হয় অঞ্চলের সুবাদে, বা কোনও দেশবরেণ্য ব্যক্তির নামানুসারে। সেখানে ভাগাড়ের (অবশ্য ‘সুশীলভাবে’ ডাম্পিং গ্রাউন্ড) নামে নামকরণ! এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কবে থেকে রয়েছে কলোনিটি?
আলাপ হল মনোরঞ্জন দাসের সঙ্গে। বয়স ৬৫, দেশের বাড়ি খুলনা-বাগেরহাটে। কথায়-কথায় জানালেন, সাত-আট বছর আগে ভাগাড়ের গা ঘেঁষে জন্ম এই কলোনির। আগে এর বাসিন্দারা সামনের বাগজোলা খালের ধারে ইতস্তত ঝুপড়ি বেঁধে বাস করতেন। খাল পরিষ্কারের সময় পাঁক তোলায়, সেই পাঁকের পাশে বসবাস অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখনই ‘মন্ত্রীদের বলেকয়ে’ উল্টোদিকের ভাগাড়-পাদদেশে স্থানান্তরিত হওয়া। নাম রাখা হয়– ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড উদ্বাস্তু কলোনি’, বর্তমানে ৮০-র বেশি পরিবারের বসবাস যেখানে।
এখানকার প্রায় সব উদ্বাস্তুই ১৯৭১-এর আশপাশের সময়ে আসেন এপারে। ফরিদপুর-বরিশাল-খুলনার মানুষই অধিক। এই কলোনিতে আসার আগে, খালপাড়ে কেটেছে ২৫-৩০ বছর। তারও আগে বর্তমানে যেখানে মেট্রোর কারশেড (নোয়াপাড়া), সেখানে। আটের দশকে সেই স্থান অধিগৃহীত হলে, সেখানকার সব বাসিন্দা প্রমোদনগরে চলে আসেন। তবে আলোচ্য কলোনিটি বয়সে একেবারেই নবীন; পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে নবীনতমও কি?
কলোনি-জন্মের বছর দেড়েকের মধ্যে একটি এনজিও জলের লাইনের ব্যবস্থা করে দেয়, শিশুদের জন্য একটি স্কুলও খোলা হয় সেইসঙ্গে। আড়াইশোরও বেশি বাসিন্দার জন্য বরাদ্দ কয়েকটি মাত্র কলঘর! প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি নলকূপ ও সাঁইবাবার মন্দির। তবে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলোর অবসান হয়নি। সারাদিন বিদ্যুৎ থাকে না; আসে সন্ধ্যা ছ’টায়, চলে যায় ভোর পাঁচটায়। এই ১১ ঘণ্টার লো-ভোল্টেজ বিদ্যুৎ পরিষেবাই বাসিন্দাদের সম্বল। কলোনির ঠিক পিছনেই কে.এম.ডি.এ.-র ‘মৃত পশুদহন বৈদ্যুতিক চুল্লি’। সেইসঙ্গে ভাগাড় তো রয়েইছে! কলোনির একাংশও খোদ ভাগাড়ের মাটি কেটেই তৈরি।
এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন কী করে? ধোঁয়া ও গন্ধে অসুবিধা হয় না? হাসলেন মনোরঞ্জনবাবু। সে-হাসি অভ্যাসের, বোঝা যায়। ‘ভাগাড় ও চুল্লির সব ধোঁয়া তো চিমনি দিয়ে ওপরে বেরিয়ে যায়, আমাদের সমস্যা হয় না’, সরল উত্তর তাঁর। অবগত নন বাতাসে সেই ধোঁয়া মেশার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে। আর গন্ধ? ‘কী আর করা যাবে! থাকতে থাকতে এখন আর কিছু মনে হয় না।’ তবে বিপদ আসে অন্যদিক থেকেও। ঝড়বৃষ্টিতে ভাগাড়ের পাহাড়প্রমাণ বর্জ্য নেমে আসে কলোনির একাংশে। কখনও আবার আগুন ছড়াতে-ছড়াতে কলোনিপ্রান্তে। বছর পাঁচেক আগে বাগজোলা খাল প্লাবিত হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল কলোনি। তবে এ সবই দৃশ্যমান সমস্যা। যখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু জুটেছে (ভাগাড়ের পাশে হলেও-বা), স্বাস্থ্যহানির কথা কে আর ভাবে!
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ‘স্থানীয় কাউন্সিলর (গোপা পাণ্ডে) জানিয়েছেন, অন্যত্র আমাদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। সেখানে সরে যাব আমরা।’ কিন্তু কবে? উত্তর নেই। আশা নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন একের পর এক বছর। কলোনি লাগোয়া তৃণমূলের একটি অফিস। বোধকরি বাসিন্দাদের ‘উন্নতিকল্পে’ই তৈরি। এখানকার বাসিন্দারা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বাদ পাননি কোনও দিন। চাকরি-বাকরি করেন না কেউই। কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ ছুতোর। কেউ আবার আয়া। দোকানও চালান দু’-একজন। আর একটা বড় অংশের মানুষের পেশা ভাগাড় থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা– প্লাস্টিকে ব্যাগ, বোতল ইত্যাদি; তারপর সেসব বিক্রি করে দিন গুজরান।
স্থানান্তর ও অর্থনৈতিক উন্নতি ছাড়া এ-কলোনির বাসিন্দাদের উন্নত জীবনযাপন অসম্ভব। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু উদ্বাস্তু কলোনিই দীর্ঘ সংগ্রাম পেরিয়ে বর্তমানে সমৃদ্ধির মুখে। নিশ্চিন্ত জীবন পেয়েছে উত্তরপ্রজন্ম। তবে আজও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করেন অনেক উদ্বাস্তুই– খালপাড়ে, রেললাইনের ধারে, বস্তিতে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষ উন্নত নয় সেখানেও। তবে ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড উদ্বাস্তু কলোনি’ বোধহয় ছাপিয়ে গিয়েছে সবকিছুকেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন কী করে? ধোঁয়া ও গন্ধে অসুবিধা হয় না? হাসলেন মনোরঞ্জনবাবু। সে-হাসি অভ্যাসের, বোঝা যায়। ‘ভাগাড় ও চুল্লির সব ধোঁয়া তো চিমনি দিয়ে ওপরে বেরিয়ে যায়, আমাদের সমস্যা হয় না’, সরল উত্তর তাঁর। অবগত নন বাতাসে সেই ধোঁয়া মেশার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে। আর গন্ধ? ‘কী আর করা যাবে! থাকতে থাকতে এখন আর কিছু মনে হয় না।’ তবে বিপদ আসে অন্যদিক থেকেও। ঝড়বৃষ্টিতে ভাগাড়ের পাহাড়প্রমাণ বর্জ্য নেমে আসে কলোনির একাংশে। কখনও আবার আগুন ছড়াতে-ছড়াতে কলোনিপ্রান্তে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পথচলতি মানুষজন নাক চেপে পেরচ্ছেন অঞ্চলটুকু। আমরাও, ঘণ্টাখানেক অবস্থান ও কথোপকথনের পর, কাহিল। শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবেশে বড় হওয়া আমরা দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎহীন (তাও এই তাপপ্রবাহের দিনকালে) থাকা যদিও-বা বুঝতে পারি, এমন পূতিগন্ধময় পরিবেশে বছরের পর বছর বসবাস কল্পনার বাইরে। আমি নিশ্চিত, মেলাতে পারবেন না বর্তমানের অজস্র উদ্বাস্তু পরিবারও (প্রাথমিক দশকগুলির সংগ্রাম ও দৈন্যদশা অনস্বীকার্য)। সেখানে প্রমোদনগর ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ‘পায়ের তলা’-য়, একটি-দুটি নয়, ৮০টি পরিবার। আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলের (আদর্শনগর, প্রমোদনগর ইত্যাদি) বাসিন্দারা ভাগাড় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকেও, গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ জানাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু যারা ঠাঁই হারানোর ভয়ে অভিযোগও জানাতে পারেন না, উদ্বাস্তু কলোনির সেইসব বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানা যায় না।
ভাগাড়ের আশপাশে বসবাসকারী মানুষজনের জীবন-জীবিকা ঈশান ঘোষ পরিচালিত ‘ঝিল্লি’ চলচ্চিত্রে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। এমন পরিবেশে বসবাসের দৃশ্য বিরল নয়। কিন্তু ওপার বাংলা থেকে নিয়ে আসা নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন ৫০ বছর পরেও এত অনিশ্চিত, এত ঠুনকো থেকে যাবে– কখনও ভেবেছিলেন মনোরঞ্জন দাস ও তাঁর প্রতিবেশীরা? উত্তরপ্রজন্মও কি মুক্তি পাবে এই নরকাবস্থা থেকে? এ কি নিছকই নিয়তি, না অন্য কিছু? প্রশ্ন অনেক। উত্তর অজানা।
প্রশাসন শীঘ্র তাঁদের স্থানান্তরিত করুক– শেষ বাক্যে, তীব্র চাওয়া, এটাই।
চিত্র ঋণ: দেবায়ন বোস