লেখালিখির সূত্রে সাহিত্যজগতে তাঁর যেমন অবাধ আনাগোনা ছিল, তেমনই পেশার সুবাদে তিনি জুড়ে ছিলেন সমকালীন বিনোদন জগতের সঙ্গেও। একদিকে ‘নাচঘর’-এর মতো পত্রিকার সম্পাদক, অন্যদিকে ‘বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার’-এর মতো বইয়ের লেখকও তিনি। স্টুডিওতে অভিনেত্রীদের নাচ শেখানো থেকে নাটকের জন্য গান লেখা, আবার প্রাচীন ভাস্কর্য থেকে ছাঁদ বুঝে নিয়ে ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকে সতীর জন্য বিশেষ ধরনের খোঁপার পরিকল্পনা, নিজেকে নানাদিকে ছড়িয়ে রেখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। আর সেই সূত্রেই রকমারি অভিজ্ঞতায় উপচে উঠেছিল তাঁর ভাঁড়ার।
মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জ্ঞানীগুণী মহলে প্রভূত খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন বটে, কিন্তু বন্ধুমহলে তাঁর খ্যাতির মূল উৎস ছিল তাঁর বাড়ির ভোজসভাগুলি। মুক্তহস্ত রাখালদাস যেমন ভোজের বিপুল আয়োজন করতেন, তেমনই খেতে বসে নিজেদের হাতকে উদারভাবে মুক্তি দিতেন তাঁর নামী-অনামী সাহিত্যিক বন্ধুরাও। এমনই এক দিনে দেখা গেল, বৈঠকখানার ঢালা বিছানার ওপর এক অতিথি অর্ধনিমীলিত চোখে শুয়ে পড়েছেন, আর দু’জন তাঁকে ধরাধরি করে এপাশ থেকে ওপাশে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর কি অসুখ করেছে? এ প্রশ্নের জবাবে জানা গেল, ‘অসুখ হয়নি। তিনি অত্যধিক সুখ ভোগ করেছেন।’ অর্থাৎ এত বেশি পেট ভরে খেয়েছেন যে নিজে নিজে আর পাশ ফিরতেও পারছেন না।
এ গল্প করেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, যিনি ছিলেন রাখালদাসের ওই ভোজসভার নিয়মিত সভ্য। শুধু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ই নন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে স্বর্ণকুমারী দেবী, রবীন্দ্রনাথ থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, শিশির ভাদুড়ী থেকে উদয়শঙ্কর, গামা থেকে গোবর গোহ- কাকে দেখেননি তিনি! স্বর্ণকুমারীর বাড়িতে আগে থেকে খবর দিয়ে যেতে হত, যাতে তিনি খাবার তৈরি করে রাখতে পারেন। না খাওয়াতে পারলে ভারী মনঃক্ষুণ্ণ হতেন রবীন্দ্রনাথের ন-দিদি। আবার খোদ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই প্রথম সাক্ষাতে প্রাচ্যের শিল্পকলা নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। এমনই নানারকম দেখাসাক্ষাতের গল্প দু’-মলাটে ধরে আছে তাঁর স্মৃতিকথাধর্মী লেখাগুলি। যেমন ধরা যাক, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হয়েছিল বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট আর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের সংযোগস্থলে। তার কিছুদিন পরেই সন্ন্যাস রোগে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। একই ঘটনা নাকি ঘটেছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। ঠিক ওই মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চলন্ত ট্রামে বসা লেখককে দেখতে পেয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার, আর সেই সন্ধ্যাতেই সন্ন্যাস রোগ কেড়ে নিয়েছিল প্রভাতকুমারের জীবন। খবর পেয়ে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। তিনি লিখেছেন, ‘আমি আর একবার তাঁকে দেখলুম বটে, কিন্তু প্রভাতকুমার আমাকে দেখতে পেলেন না।’ আর সেই গল্প শোনা ইস্তক ভয়ে ভয়ে ছিলেন অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী। পাছে কোনও দিন ওই এলাকাতেই তাঁকেও দেখে ফেলেন হেমেন্দ্রকুমার!
আসলে হেমেন্দ্রকুমারের ব্যক্তিগত জীবনটিও যে বৈচিত্র্যে ভরা। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত পাঠক রহস্য-রোমাঞ্চের ভুবনের সঙ্গেই হেমেন্দ্রকুমারকে এক করে দেখতে অভ্যস্ত। জয়ন্ত-মানিক, বিমল-কুমারের মতো একাধিক চরিত্রের সিরিজ তৈরি করে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালিকে দীর্ঘদিন মনের খোরাক জুগিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। বিশ্বসাহিত্যের ভাঁড়ার থেকে বহু অভিযান আর ভৌতিক কাহিনির বঙ্গীকরণও হয়েছে তাঁরই হাতে। আবার রাতের কলকাতাকে ভেতর থেকে চিনেছিলেন তিনি, ‘কলকাতার রাত্রি রহস্য’-এ রেখেছিলেন শহরের সেই গোপন দলিল। লেখালিখির সূত্রে সাহিত্যজগতে তাঁর যেমন অবাধ আনাগোনা ছিল, তেমনই পেশার সুবাদে তিনি জুড়ে ছিলেন সমকালীন বিনোদন জগতের সঙ্গেও। একদিকে ‘নাচঘর’-এর মতো পত্রিকার সম্পাদক, অন্যদিকে ‘বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার’-এর মতো বইয়ের লেখকও তিনি। স্টুডিওতে অভিনেত্রীদের নাচ শেখানো থেকে নাটকের জন্য গান লেখা, আবার প্রাচীন ভাস্কর্য থেকে ছাঁদ বুঝে নিয়ে ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকে সতীর জন্য বিশেষ ধরনের খোঁপার পরিকল্পনা, নিজেকে নানাদিকে ছড়িয়ে রেখেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। আর সেই সূত্রেই রকমারি অভিজ্ঞতায় উপচে উঠেছিল তাঁর ভাঁড়ার। সেই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিল নানা ধরনের, নানা পেশার মানুষের সঙ্গ। আর তা নিয়েই তিনি লিখেছিলেন তিন-তিনটি বই- দুই খণ্ডে ‘যাঁদের দেখেছি’, আর ‘এখন যাঁদের দেখছি’। এর পরেও যে তাঁর বলার কথা ফুরোয়নি, তার সাক্ষ্য ছড়িয়ে রয়েছে ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’, ‘শুভেন্দ্রনারায়ণ ও সেরাইকেলার নাচ’, ‘নায়ক-নট নির্মলেন্দু’-র মতো আরও গুটিকয় নিবন্ধে। আর এইসব লেখা একত্র করেই সম্পাদনা করেছেন রাহুল সেন। হেমেন্দ্রকুমার নানা বৃত্তের যত মানুষের কথা লিখে গিয়েছেন, তাঁদের পরিচিতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ টীকাও এ বইয়ে যোগ করেছেন সম্পাদক। সে পরিচিতি একান্ত দুর্লভ না হলেও, মূল টেক্সটের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া বইটিকে সম্পূর্ণ করেছে। বাংলা ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ফেলে আসা সময়ের খোঁজ করতে চাইলে হেমেন্দ্রকুমারের এই স্মৃতিকথা যে বিশেষ সহায়ক হবে, তা বলাই যায়।
যাঁদের দেখেছি
হেমেন্দ্রকুমার রায়
রাবণ
১২৫০