বাংলার ১৩০২ থেকে ১৪৩১ পর্যন্ত বিস্তৃত বাঙালির সময়কাল এই গ্রন্থে রয়েছে। অর্থাৎ, পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ, ক্রমে নকশাল আমল হয়ে আজকের পৃথিবী– এক ব্যাপক কালখণ্ডকে ধরেছেন লেখক। এই সময়কালে পঞ্জিকার পাতায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনকেই নিরীক্ষণ করেছেন কৃষ্ণপ্রিয়। তিনি লিখছেন “… অসংখ্য বিজ্ঞাপনের নিরিখে সেকাল থেকে একালের পথে যাত্রা-ই এই সন্দর্ভ।… এই জ্যোতিষবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা দৃঢ় অদৃশ্য ‘ভাগ্যচক্র’। এই চক্রেই নিরন্তর ঘুরপাক খাচ্ছেন দেশের ক্ষমতাবান সর্বশক্তিমান থেকে পরিযায়ী শ্রমিক পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ।”
যেদিন পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষিদ্ধ, সেদিনই কুমড়োর ছেঁচকি সহযোগে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরেছিল ‘লক্ষণের শক্তিশেল’-এর দূত। কারণটাও সে নিজেই জানিয়েছিল– ‘কুমড়োটা পচে যাচ্ছিল কিনা’… সুকুমার রায়ের বিখ্যাত নাটকে এভাবেই থেকে গিয়েছে বাঙালি হিন্দু ও পঞ্জিকার সম্পর্কের খতিয়ান। অর্থাৎ, কুমড়ো খেতে গেলেও পাঁজির দরকার পড়ে! এমন এক অমোঘ সম্পর্ককে কাল্টিভেট করাটা একান্তই প্রয়োজনীয় নয় কি?
বাঙালির আর্থসামাজিক পরিবর্তনকে বুঝতে এবং তার মধ্যে যা কিছু ধ্রুবকসম, তাকে খুঁজতে গেলে তো এই অন্বেষণ জরুরি বলেই মনে হয়। আর তাই কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তর ‘পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনে বাঙালির পোড়াকপাল আর জ্যোতিষব্যবসার শতবর্ষের ধারাবর্ণনা’ বইটি হাতে নিয়ে খানিক নড়েচড়ে উঠতেই হয়। কাঠখোদাই শিল্পী অসিত পালের ‘আদি পঞ্জিকা দর্পণ’-এর মতো বই অবশ্য আমরা আগেও পেয়েছি। তবুও কৃষ্ণপ্রিয়র বইটির চমৎকার নির্মাণ, অলংকরণ আপনাকে পাঠক হিসেবে আকর্ষণ করবে, একথা বলাই যায়। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কাজ রয়েছে। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক ছিলেন। লেখাতেও সেই অনুসন্ধিৎসা বর্তমান পুরোদমে। তাই এই বই পড়তে পড়তে এক যাত্রাপথের শরিক হয়ে পড়াটা কিছুটা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ঘটে।
বাংলার ১৩০২ থেকে ১৪৩১ পর্যন্ত বিস্তৃত বাঙালির সময়কাল এই গ্রন্থে রয়েছে। অর্থাৎ, পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ, ক্রমে নকশাল আমল হয়ে আজকের পৃথিবী– এক ব্যাপক কালখণ্ডকে ধরেছেন লেখক। এই সময়কালে পঞ্জিকার পাতায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনকেই নিরীক্ষণ করেছেন কৃষ্ণপ্রিয়। তিনি লিখছেন “…অসংখ্য বিজ্ঞাপনের নিরিখে সেকাল থেকে একালের পথে যাত্রা-ই এই সন্দর্ভ।… এই জ্যোতিষবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা দৃঢ় অদৃশ্য ‘ভাগ্যচক্র’। এই চক্রেই নিরন্তর ঘুরপাক খাচ্ছেন দেশের ক্ষমতাবান সর্বশক্তিমান থেকে পরিযায়ী শ্রমিক পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ।”
একশো এবং সঙ্গে আরও সিকি শতকের সামান্য বেশি সময়ে ‘অজর, অমর, অক্ষয়’ কারবারের অসংখ্য বিজ্ঞাপনকে খুঁটিয়ে দেখে চলেছেন লেখক। এবং সেই দেখাটা তিনি মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। একদিকে বিজ্ঞাপনগুলি নিজে যেমন বইয়ের পাতায় জেগে রয়েছে, সেই সঙ্গে চলেছে তাঁর ধারাবিবরণী। ফলে বছর, দশক, শতকের নিক্তিতে সবটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। তবে এখানে পঞ্জিকা বলতে হিন্দু বাঙালির পঞ্জিকাই কেবলমাত্র দেখা হয়েছে। অবশ্য মুসলমান তান্ত্রিক ও জ্যোতিষ-এর বিজ্ঞাপনও রয়েছে। এবং সেই সূত্রে জ্বিন, পরি, সোলেমানি তন্ত্রের প্রসঙ্গও এসেছে।
……………………………………….
স্বাধীনতার লড়াই চলতে থাকা দেশে কীভাবে দেশবাসীর সামনে বিজ্ঞাপনের ডালি সাজাচ্ছিল পঞ্জিকা, তার নানা নিদর্শন রয়েছে এই বইয়ে। সেই সঙ্গেই লেখকের পরিষ্কার দাবি, কেবল গ্রামগঞ্জের মানুষরাই নয়, শহুরেরাও পাঁজির ওপর সেযুগ থেকেই নির্ভরশীল। আর সেই যুগ থেকে সাতের দশকে এসে পড়ে আমরা দেখি পঞ্জিকার পাতায় বিজ্ঞাপনের চড়া রং মোটেই ম্লান হয়নি। বরং তা আগের মতোই ঝলমলে। সেই সময়ের একটি বিজ্ঞাপনে নেতাজির জ্যোতিষী তন্ত্রসম্রাট বাবা শ্রীভোলানাথ হাজির! অর্থাৎ, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নজর টানতে নেতাজিকে সামনে রেখে ‘বাজার গরম করার কৌশল’ নেওয়া হয়েছে।
……………………………………….
প্রায় ৩৫০ পাতার বইটি সম্পর্কে এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবু ‘বিন্দুতে সিন্ধু’ দেখতে বসে ‘হরিদাস বৈরাগী এন্ড কোং’-এর কথা বলতে ইচ্ছে হয়। এক ‘অদ্ভুত রৌপ্য মাদুলী’র বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের দাবি, ‘শত শত উৎকট উৎকট ব্যাধি’কে তাড়াতে এর জুড়ি নেই। আর সেখানে রোগ প্রসঙ্গে দাদ, চুলকুনি, ফোঁড়ার মতো অসুখকে ‘কুচুটে’ বলে অভিহিত করার বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেন কৃষ্ণপ্রিয়। “একটা মহার্ঘ্য শব্দও পাওয়া গেল কিছু রোগের চরিত্র চিহ্নিত করতে– ‘কুচুটে’! অসাধারণ একটা তকমা। আমি এই বিজ্ঞাপনের বয়ান পড়ার আগে পর্যন্ত কখনও কোনও রোগকেই ‘কুচুটে’ আখ্যায় অভিহিত করতে দেখিনি কাউকে।” এই সরস ধারাবিবরণী উপভোগ্য সন্দেহ নেই। পাশাপাশি ১৮৯৫-’৯৬ সালের পঞ্জিকার এই বিজ্ঞাপনে কীভাবে ‘ইংরেজি চিকিৎসা না দেশীয় আর্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান… ডামাডোলের মাঝেই দুই চিকিৎসাকে হটিয়ে দিয়েই রুপোর একটা মাদুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল’ সেদিকেও আলো ফেলে দেখান তিনি।
স্বাধীনতার লড়াই চলতে থাকা দেশে কীভাবে দেশবাসীর সামনে বিজ্ঞাপনের ডালি সাজাচ্ছিল পঞ্জিকা, তার নানা নিদর্শন রয়েছে এই বইয়ে। সেই সঙ্গেই লেখকের পরিষ্কার দাবি, কেবল গ্রামগঞ্জের মানুষরাই নয়, শহুরেরাও পাঁজির ওপর সেযুগ থেকেই নির্ভরশীল। আর সেই যুগ থেকে সাতের দশকে এসে পড়ে আমরা দেখি পঞ্জিকার পাতায় বিজ্ঞাপনের চড়া রং মোটেই ম্লান হয়নি। বরং তা আগের মতোই ঝলমলে। সেই সময়ের একটি বিজ্ঞাপনে নেতাজির জ্যোতিষী তন্ত্রসম্রাট বাবা শ্রীভোলানাথ হাজির! অর্থাৎ, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নজর টানতে নেতাজিকে সামনে রেখে ‘বাজার গরম করার কৌশল’ নেওয়া হয়েছে। আবার ১৯৭১-এর পাঁজির পাতায় প্রকাশিত রাষ্ট্রগত বর্ষফলেও এসে পড়েছেন নেতাজি। তিনি নাকি ‘সমর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে কয়েক বর্ষ মধ্যে ভারতে আবির্ভূত হবেন।’
একই সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রাণনাশের আশঙ্কা (যা ১৩ বছর পরে সত্যই হয়েছিল!) যেমন করা হয়েছে, তেমনই নকশাল আন্দোলনকে ‘ভয়াবহ’ বলেও দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। এই সব বিজ্ঞাপন ও রাশিফলের ভিতর দিয়ে সেই সময়টাকেই যেন নতুন করে আতশকাচের তলায় এনে ফেলা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আম-পাঠকের মনোজগৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকেই এই সব গণক ও বিজ্ঞাপনদাতারা তাঁদের আকৃষ্ট করার দিকটি মাথায় রেখে এমন সব দাবি করে চলতেন। আর এই সময়পথে এগোতে এগোতে নতুন সহস্রাব্দে পৌঁছেও দেখা যাচ্ছে ‘বশীকরণ এখনও চলেছে। চলেছে। চলেছে। তার এতটুকুও চাহিদা হ্রাস পায়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই আরও বেড়েছে। অর্থাৎ, বাঙালির ভাগ্য, যা ছিল, তেমন-ই আছে। এতগুলি বছরেও কিছুই করে উঠতে পারেনি বাঙালি।’ এভাবে চলতে চলতে একেবারে ২০২৪ সালেও ‘কী অদ্ভুত জ্যোতিষ-তান্ত্রিক সব ক্রিয়াকর্ম দিব্যি সচিত্র বিজ্ঞাপন দিয়ে, যেন একটা পৈশাচিক আনন্দে সোচ্চার।’
এই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং নানা উপলব্ধির সমান্তরালে আরও একটি ব্যাপারকে কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। এই সব পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন জুড়ে যেন এক অতিলৌকিক জগতের জলছাপও ফুটে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে এই বইয়ের এক পাতাজোড়া ‘আজব আয়না’র কথা বলা যায়। ‘বিখ্যাত য়্যামেরিকান সমিতি’ নাকি এই আয়না তৈরি করেছে। কী কাজ করে এই আয়না? ‘বিংশ শতাব্দীর অপূর্ব্ব আবিষ্কার’ আয়নাটির দিকে দেখলে নিজের ‘ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান’ জানা যাবে। দূরে থাকা বা মৃত আত্মীয়পরিজনের সঙ্গেও কথা বলা যাবে। আবার যে ‘প্রণয়িণীগণ’ বিচ্ছিন্ন, তাঁদেরও দেখা মিলবে। পাশাপাশি শরীরে কোনও রোগ দানা বেঁধেছে কি না, তাও নাকি বলে দেবে এই আয়না। আরও বহু কিছু। পড়তে পড়তে অসম্ভবের সীমানা পেরিয়ে যেতে হয়। বাঙালির দীর্ঘ যাত্রাপথে বিজ্ঞাপনগুলির সারিবদ্ধ মাইলফলক-অবস্থানকে তুলে ধরার পাশাপাশি কৃষ্ণপ্রিয় এই দিকটিকেও উসকে দিয়েছেন। পড়তে পড়তে সত্যিই বুঁদ হতে হয়।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
পাঁজি খুলে নিছক সময় কাটাতেও নানা বিজ্ঞাপন আমরা দেখি। কিন্তু এত বছর ধরে চলতে থাকা এই সব বিজ্ঞাপনকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই সব বিবিধ, বিচিত্র, অসম্ভব দাবিসর্বস্ব বয়ানও যে এক জাতির সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান হিসেবে গণ্য হতে পারে, তা হয়তো ভেবে দেখা হয়নি। এই বই তা ভাবতে শেখায়।
ছবি: ‘পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনে বাঙালির পোড়াকপাল আর জ্যোতিষব্যবসার শতবর্ষের ধারাবর্ণনা’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনে বাঙালির পোড়াকপাল আর জ্যোতিষব্যবসার শতবর্ষের ধারাবর্ণনা
কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত
মান্দাস
৬৫০ টাকা