পিটার্সবার্গ শহরটাই মার্ক শাগালের মধ্যে জন্ম দেয় রাজনৈতিক চেতনার। উপহার দিয়েছিল নতুন সম্পর্ক। এই সমস্ত কিছুই তাঁর চেতনাকে শিকড় সমেত নাড়া দেয়। ‘শিকড় সমেত’ কথাটা খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করতে হয়, কারণ মহৎ শিল্পীদের মতোই মার্ক শাগালের শিল্প চেতনার গভীরে নিহিত ছিল তাঁর নিবিড় যাপনের শিকড়টি। আর সেই যাপনের সমস্ত উথাল-পাতাল ঢেউ– অর্থাৎ তাঁর প্রেম, তাঁর পারিপার্শ্বিক ও সমসময়কে নিপুণ যত্নে তুলে এনেছেন ‘শাগাল’ বইটির রূপকার।
মানুষ, মানুষের তৈরি জনপদ, সভ্যতা, সব কিছুরই বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গে এক ধরনের চরিত্র আছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরলয়ে বদলাতে থাকে। তার সঙ্গে তাল মেলায় পরস্পরের পরিপূরকের মতো মানুষের জীবন ও মানুষের তৈরি শিল্প। মানুষের জীবন ও শিল্পের এই ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার মূল সুরটিকেই পরম যত্নে দু’মলাটের মধ্যে ধরেছেন গৌতম সেনগুপ্ত, তাঁর ‘শাগাল’ নামক বইটিতে। কোনও শিল্পীর শিল্পকে জানতে গেল শরণাপন্ন হতে হবে তাঁর যাপনের কাছে, তাঁর সময়ের কাছে। লেখক হিসেবে মার্ক শাগালের মতো একজন বিরাট মাপের শিল্পী এবং তাঁর ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে যেটা কঠিন, তা হল তথ্য, ঘটনার বিবরণ এবং শিল্পের ব্যাখ্যা– এ সমস্ত কিছুকে এক সহজিয়া গল্পের মতো বুনে চলা। বইটি পড়তে বসে অনুভব করা যায়, কী অনায়াস দক্ষতায় লেখক এক অনুচ্ছেদ থেকে আরেক অনুচ্ছেদ অতিক্রম করে চলেছেন সাবলীল প্রসাদগুণের ছোঁয়ায়।
শিল্পী মার্ক শাগালের জন্ম ১৮৮৭ সাল নাগাদ জাঁর শাসিত রাশিয়ার এক নিতান্ত সাদামাটা মফস্সল ভিটেবস্ক-এ। সেখানে প্রাথমিকভাবে ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয় শাগলের। সেখান থেকে শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইও শুরু। ভাগ্যসন্ধানে তিনি এসে পড়েন শহর সেন্ট পিটারর্সবার্গ-এ।
জীবনের এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন পরতে পরতে শিল্পীর শিল্পবোধকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। কারণ, নতুন শহর তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় রাজনৈতিক চেতনার। উপহার দেয় নতুন সম্পর্ক– এই সমস্ত কিছুই তাঁর চেতনাকে শিকড় সমেত নাড়া দেয়। ‘শিকড় সমেত’ কথাটা খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করতে হয়, কারণ মহৎ শিল্পীদের মতোই মার্ক শাগালের শিল্প চেতনার গভীরে নিহিত ছিল তাঁর নিবিড় যাপনের শিকড়টি। আর সেই যাপনের সমস্ত উথাল-পাতাল ঢেউ– অর্থাৎ তাঁর প্রেম, তাঁর পারিপার্শ্বিক ও সমসময়কে নিপুণ যত্নে তুলে এনেছেন ‘শাগাল’ বইটির রূপকার।
চিত্রভাষার সন্ধানে জীবনের প্রারম্ভিক পর্বেই শাগাল উপলব্ধি করেন, ‘সত্যি বলতে কী আমাকে কেউই শেখাতে পারবে না। আমাকে শেখানোর কিছু নেই। আমি শিখতে পারি না কারও কাছ থেকে। আমার স্বভাবটাই এমন।’ ‘Last for life’ বইটিতে আরভিং স্টোন শিল্পী ভ্যান গগের ছবি আঁকার বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখছেন, ‘He became a blind painting machine, dashing off one sizzling canvas after another without even knowing what he did. All this eight years of intense labour were at last expressing themselves in a great burst of triumphal energy.”
মার্ক শাগালের ক্ষেত্রেও এই উদ্যোগ এই অনুপ্রেরণার কোনও কমতি ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিপর্যয়, স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটানো, নিজের ছবি বিক্রির টাকা না পাওয়া কিংবা বিপুল অর্থ এবং স্বীকৃতি না মেলা– এই বেদনাবিধুর দিনযাপনের মধ্যেই অব্যাহত ছিল তাঁর শিল্পসৃষ্টি। ৯৭ বছরের দীর্ঘ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাজের মধ্যে মজে।
মার্ক শাগালের শিল্পকীর্তি ও জীবন নিয়ে লেখা এই বইটির প্রকাশনার মান অত্যন্ত ভাল। বর্ণনার সঙ্গে শাগালের চিত্রিত ক্যানভাসের ছবি দেওয়া আছে পাতায় পাতায়। এক ধরনের আবহমানতার স্বাদ পাওয়া যায়, যা যে কোনও মহৎ শিল্পকর্মের প্রাথমিক ও আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য। যেখানে মানুষের মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করণীয় নেই। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল লিখেছিলেন কমলকুমার মজুমদার, তাঁর ‘বঙ্গীয় শিল্পধারা’ প্রবন্ধে, ‘গঙ্গাতীরে বসিয়া একটি বালক দেখিয়াছিল অধ্যাত্মস্রোত। ওখানে কাহারা নাম-গান করে তাহার আওয়াজ সমস্ত সৃষ্টিকে বাস্তবতায় পরিণত করিয়াছে, হাতে একটি তাস লইয়া কে যেন বসিয়া আছে, নিচে গঙ্গার স্রোত প্রবাহিত, কেমন করিয়া ইহারই মধ্য হইতে, ওই তো আকাশ এই তো আমি, মৃত্যু আসে, কে যেন গোঙায়, তবু, তবু ইহার মধ্য দিয়া আসে একটি হঠাৎ হাওয়া, চমকে দেওযা একটি আনন্দ, সমস্ত শিরা-উপশিরা স্পন্দিত হইয়া ওঠে, আনন্দের সে কী লীলা, গঙ্গার স্রোত আর আকাশ সমস্ত কিছুই, এমনকি মাটির উপর, মৃত্যুর উপর, নারায়ণ ধ্বনির সমস্ত বাস্তবতাকে একটি রূপান্তর আনিয়া দিল, সে আনন্দকে নমস্কার।’
শাগাল
গৌতম সেনগুপ্ত
ধ্যানবিন্দু। মূল্য ৬০০