‘মাসান আংরি’ এই বছরই জানুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইয়ের মলাট, এমনকী, পাতা উল্টে আলগা স্রোতে চোখ বোলালে মনে হবে হাস্যরসের আঁকিবুকি বুঝিবা। গল্প খুঁড়ে তার ভিতরে হাঁটা লাগালে কক্ষান্তরে ছিটকে যাবে মাথা-মন-চিন্তন। প্রশ্ন আসবে মনে, একাধিক। উত্তরের খেই মিলবে না। মূর্তমান অশরীরীর মতো একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলবে সামনে। (তাই জন্যই কি বইয়ের প্রচ্ছদে এগারো গল্পের এগারোটি চোখহীন চরিত্র এবং পিছনে কেউ একজন; অশরীরী গোছের?)
‘পাখি ধরতে তো পারবি না, বেশি সময় নেই। ব্যাঙ ধরতে পারবি?’ কালো রং, বোঁচা নাক, এক চোখ বোজা, কোঁকড়ানো কালো ঝাঁকড়া চুলে সাধুবাবার নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেনি লালু। করতই বা কী করে? দৈন্যয় নিকোনো সংসারে ব্যাং-পিছু একটাকা করে লাভ, মুখের কথা নাকি! পনেরোটা ব্যাং। পনেরো টাকা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সাধুবাবা ব্যাং নিয়ে কী করবেন কেউ জানে না। অনুমান– সন্ধেবেলা খাবেন, কাঁচা। অথবা, মেরে আবার বাঁচিয়ে তুলবেন, ম্যাজিক! আদতে হল কী, পাখির বদলে ব্যাং নামক জীবাত্মাটিকে পরমাত্মায় মেলানোর খেলায় মাতলেন সাধুবাবা। কীভাবে? না, কারও কাছ থেকে টাকা না-নিয়ে উল্টে উৎসাহীদের পাঁচ টাকা করে দিয়ে আবেদন জানালেন, পরাধীন ব্যাংগুলোকে মুক্ত করে দেওয়ার। ভণ্ড সাধুকুল এবং তাদের অসৎ ব্যবসার এই ঢক্কানিনাদের মধ্যে এই সাধুর কথা শুনে মনে হয় না, আজগুবি, অবাস্তব, অলৌকিক? মনে হয় না, রূপকথার তুলতুলে আঁচিলের মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘মানুষ’ নামক ধন? সাধুবাবাকে ব্যাং জোগাড় করে এনে দিয়েছিল লেবু ফিরি করা লালু। তাঁর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এহেন অভিনব কৌশলে মুগ্ধ সাত বছরের লালু। অথচ, বনদুর্গার মেলায় আলাপ হওয়া এমন একজন মানুষকে হারিয়ে ফেলে সে। তার সঙ্গে লালুর আবার দেখা হবে লালু যখন একুশ। ঘটনাচক্রে তাঁরই সূত্রে লালুর জুটে যাবে একটা চাকরিও। এবং এখানেও অনুঘটক হয়ে থেকে যাবে সেই ব্যাং।
মানুষকে প্রাণীদেহের প্রাথমিক পাঠ দিতে যে-জীবকে আত্মাহুতি দিতে হয়, তাকে মুক্ত করার মাধ্যমেই মানুষের আত্মা স্বাদ পাচ্ছে ‘পরম’-এর। এমন জাদুবাস্তব নিজের লেখার উল-কাঁটায় বুনেছেন নিবেদিতা ঘোষ রায়। ‘এক টাকার ব্যাঙ’-এর মতো আরও দশটি গল্প নিয়ে তাঁর আখ্যানমঞ্জরী: ‘মাসান আংরি’। নিবেদিতা-র বইয়ের চুরি করতে যাওয়া চোরের কাটা আঙুল লুকোনো থাকে ঠাকুমার সুপুরির কৌটোয়– নিমপাতা, কর্পূর আর নিশিন্দের ডালের মধ্যে। লর্ড ক্লাইভের বিশুদ্ধ বাংলায় উচ্চারণে স্তম্ভিত খুড়োকে সাহেব স্বয়ং মনে করিয়ে দেন, ‘তোমরা ভুলিয়াছ, আমি শিখিয়া লয়েছি। পান্তা ভাত খাও, জিভ সহজ হইবে, আমি প্রত্যহ খাই।’ মহামায়া-রা এখানে ‘দেবী’ নয়। তারা শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক অলৌকিকতার স্বাদু বাতাবরণে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং তাদের ডাক্তারি-কোবরেজি বিদ্যা সুস্থ করে তোলে বৃদ্ধ মুসলমান ফকিরকে। দেউলপোঁতা গ্রামে শ্বশুরের উৎসাহে বউমা শুরু করে কোবরেজি। হাওয়ারূপী অদৃশ্য দেবী ‘মাসান’কে পুজো করে রাজবংশীরা। বাঁশঝাড়ের সেই দেবীর কোপ চিন্তন শক্তির চেয়েও দ্রুত। তাঁর কোপে জিয়ন্ত মানুষ শুধু অসাড় হয়েই পড়ে থাকে না, রীতিমতো উধাও হয়ে যায়।
নিবেদিতা-র মতোই তাঁর গল্পগুলি বোধে আধ্যাত্মিক। যাপনে অ্যাথেইস্ট। গ্রাম-গঞ্জ-মফস্সলের দেহাতি আখড়া থেকে দাঁড়িয়ে তারা শাণিত চ্যালেঞ্জ ছোড়ে শহুরে বাবুবিবিয়ানার দিকে। ‘রুরাল’-এর যাপন, জীবন, দারিদ্র, অস্বচ্ছলতা, মাঘের শীত, ভুসো কুয়াশা, ধু ধু আলপথ, ছমছমে অন্ধকার, মাটির খোদল, ভাতের গন্ধ, অভুক্ত পেট চিরে বেরিয়ে আসে পর্দাহীন রগরগে বাস্তব। ভণিতাহীন। যে-বাস্তব আকছার অবহেলিত শহুরে সুললিত সাহিত্য কালচারে।
প্রচ্ছদ ও অলংকরণে নিবেদিতার লেখার যথাযথ সঙ্গত করেছেন সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য। ‘মাসান আংরি’ এই বছরই জানুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইয়ের মলাট, এমনকী, পাতা উল্টে আলগা স্রোতে চোখ বোলালে মনে হবে হাস্যরসের আঁকিবুকি বুঝিবা। গল্প খুঁড়ে তার ভিতরে হাঁটা লাগালে কক্ষান্তরে ছিটকে যাবে মাথা-মন-চিন্তন। প্রশ্ন আসবে মনে, একাধিক। উত্তরের খেই মিলবে না। মূর্তমান অশরীরীর মতো একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলবে সামনে। (তাই জন্যই কি বইয়ের প্রচ্ছদে এগারো গল্পের এগারোটি চোখহীন চরিত্র এবং পিছনে কেউ একজন; অশরীরী গোছের?)
তবে বইয়ের প্রুফ সংশোধন নিয়ে গায়ত্রী রায় আর-একটু সাবধানী হলে মন্দ হত না। প্রচ্ছদের ‘আংরি’ এবং বই-মধ্যস্থ শিরোনাম পৃষ্ঠার ‘আঙরি’-র মতোই খুচখাচ বহু অযত্নের ছাপ গল্পের প্রবহমানতার খানিক পথ আটকেছে বইকি। এই বাধা কাটিয়ে উঠলে ‘মাসান আংরি’ আরও ধারালো হয়ে উঠবে, আশা।
মাসান আংরি
নিবেদিতা ঘোষ রায়
৯ঋকাল বুকস
২৫০্