কায়েরোস্তামি বলেছেন, ‘এখানে আমরা দার্শনিক নয়, কর্মী হিসেবে কাজ করছি।’ আব্বাস চাইছেন কেবলই ‘অনুঘটক’ হয়ে থাকতে তাঁর শ্রোতাদের সামনে। শ্রোতা কেন? কারণ প্রাথমিকভাবেই তো ‘শিক্ষকতা’ শব্দটা নিয়ে কায়েরোস্তামি তাঁর আপত্তি প্রকাশ করে ফেলেছেন। এই গদ্যাংশগুলি, যা আমরা বইতে পাচ্ছি, সেখানে সহকর্মীর মনন থেকেই কায়েরোস্তামি বানিয়ে চলেছেন যেন একটিই সিনেমা। এই টুকরো অংশগুলিকে জোড়ার পর যা দাঁড়িয়েছে, সায়ন্তন যাকে বলছেন, ‘মাস্টারক্লাস’, তা আসলে কোলাজে তৈরি হওয়া একটি চলচ্চিত্রই যেন।
কারখানার শ্রমিক ফিলিপ মোজ ক্যামেরা কিনেছিল সাধেই। নিজের সদ্যোজাত কন্যার কিছু মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করবে বলে। কে জানত, ওই আট মিলিমিটার ক্যামেরা ওর জীবন বদলে দেবে। হঠাৎই ও যা দেখবে, তাকেই ওর মনে হবে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র! আর ক্যামেরা নিয়ে, চলমান দৃশ্য নিয়ে এই পাগলামি তার জীবনে আর কিচ্ছু রাখবে না, কেবল তার ক্যামেরার লেন্স আর সে ছাড়া! ফিলিপ সিনেমাকে বরণ করেছিল ভয়হীন, দ্বিধাহীনভাবে। ক্রিস্তভ কিসলভস্কি-র ‘ক্যামেরা বাফ’-এর চরিত্রের এই যাত্রাপথই যেন আব্বাস কায়েরোস্তামি তাঁর কর্মশালায় উচ্চারণ করছেন, যা সায়ন্তন দত্তর অনুবাদে, ‘…আমি দেখেছি, চলচ্চিত্রনির্মাণ বিষয়ে যারা তুলনামূলক ভাবে অনভিজ্ঞ, তারাই অনেকসময় অনেক কম ভয়ভীতি নিয়ে দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।’
পল ক্রোনিন, মহম্মদ রেজা সানি এই দু’জনের বই থেকে আব্বাস কিয়োরোস্তামি-র বেশ কিছু কর্মশালায় বলা কথার সংকলন ও অনুবাদ করেছেন সায়ন্তন দত্ত। ‘একলব্য’ থেকে প্রকাশিত ‘মাস্টারক্লাসে কিয়ারোস্তামি’ বইটি নির্মিত। সব মিলিয়ে নির্দেশকের ১০৭টি এন্ট্রি বা বক্তব্য সংকলিত হয়েছে এই বইতে। কেবলই চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলী বা চলচ্চিত্রবিদ্যার সারস্বত অঙ্গনে ঘোরাফেরা করেনি তাঁর বক্তব্য, জীবন নিয়ে, চারপাশ নিয়ে, মানুষ নিয়ে কথা বলছেন ‘টেস্ট অফ চেরি’-র পরিচালক, ‘ক্লোজ আপ’-এর পরিচালক। প্রথম লেখায় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর বলা কথায় তাই কিয়োরোস্তামি বলেন, ‘‘আগাগোড়া ‘নিখুঁত’ ছবি বলে কিছু হয় না…’’; চলচ্চিত্রকে তাঁর শিল্পরূপের ডানায় উড়তে দিতে চেয়ে, বাণিজ্যিক নিগড়ের বাইরে ভাবতে চেয়ে, বইয়ের ‘উত্তরভাষ’-এ অনিন্দ্য সেনগুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘চলচ্চিত্র চিন্তা’ প্রবন্ধের উল্লেখ করে যেকথা বলতে চেয়েছেন।
‘যন্ত্রযুগের ক্রমবর্ধমান প্রাবল্যের সঙ্গে সঙ্গে নানা বৈষম্য বিরোধ ও শূন্যতাবোধের চাপে বিধ্বস্ত, যন্ত্রণাবিদ্ধ অসহায় মানুষের মুক্তির পথ কি আত্মহননে? আধ্যাত্মিক আত্মনিগ্রহে?’ আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’ দেখে মনে হয়েছিল মৃণাল সেনের (সূত্র: ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’, মৃণাল সেন, ‘আন্দ্রেই তারকোভস্কি’, সম্পাদনা: অদ্রীশ বিশ্বাস)। কায়েরোস্তামি তাঁর কর্মশালার ছাত্রছাত্রীদের মুক্তির মার্গ বাতলাচ্ছেন এই যন্ত্রসভ্যতার অন্ধকার ঔদাসীন্য থেকে– ‘এই সপ্তাহে তোমাদের কম্পিউটারগুলো সরিয়ে রাখো! ফোন সুইচ অফ করে দাও! কোথাও গেলে সারাক্ষণ ফোন সাথে করে নিয়ে যাওয়ার লোভটা ত্যাগ করো! যেখানেই তুমি যাও না কেন, এই যন্ত্রগুলো কাছে থাকলে গোটা পৃথিবীটা একইরকম দেখতে হয় যায়! তোমার পকেটে ফোন থাকার অর্থ পৃথিবীর সঙ্গে তোমার সংযোগের পথে বিরাট একটা বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। সারাক্ষণ এই যন্ত্রগুলোকে তোমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে দিও না। সব বাধাগুলো ঘরেই ছেড়ে এসো!’
এর ঠিক আগেই সংকলিত অংশটিতে কায়েরোস্তামি বলেছেন, ‘এখানে আমরা দার্শনিক নয়, কর্মী হিসেবে কাজ করছি।’ আব্বাস চাইছেন কেবলই ‘অনুঘটক’ হয়ে থাকতে তাঁর শ্রোতাদের সামনে। শ্রোতা কেন? কারণ প্রাথমিকভাবেই তো ‘শিক্ষকতা’ শব্দটা নিয়ে কায়েরোস্তামি তাঁর আপত্তি প্রকাশ করে ফেলেছেন। এই গদ্যাংশগুলি, যা আমরা বইতে পাচ্ছি, সেখানে সহকর্মীর মনন থেকেই কায়েরোস্তামি বানিয়ে চলেছেন যেন একটিই সিনেমা। এই টুকরো অংশগুলিকে জোড়ার পর যা দাঁড়িয়েছে, সায়ন্তন যাকে বলছেন, ‘মাস্টারক্লাস’, তা আসলে কোলাজে তৈরি হওয়া একটি চলচ্চিত্রই যেন। ‘সার্টিফায়েড কপি’ নিয়ে দর্শকদের কাছে প্রকাশ করা আফসোস, ‘ক্লোজ আপ’ নিয়ে তাঁর ভাবনার পাশাপাশি তিনি বলছেন, ‘না দেখায় দেখা আছে’– এ’রম একটা ছবি তিনি বানাতে চান। যখন তিনি একটি লিফটের চলাচল, বা একটি টেলিফোন ও একটি শিশুর আদানপ্রদান নিয়ে একটি চলচ্চিত্রভাবনার হদিশ দিচ্ছেন, তখন সেই ছবি ‘না দেখাতেও’ দেখা হয়ে যাচ্ছে না কি? যেমনটা তাঁর ছবি ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’-এর একটি দৃশ্যে ঘটছিল?
কায়েরোস্তামির সাক্ষাৎকার, ভাবনাগুচ্ছ নিয়ে ‘ছবি-কথায় আব্বাস কিয়েরোস্তামি: চেরির স্বাদ ও অন্যান্য’ হোক বা আব্দুল কাফির অপূর্ব অনুবাদে তাঁর কবিতার সংকলন ‘কথা চিত্র কণা’ বাংলা বইয়ের পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু কায়েরোস্তামির নির্মাণ-ভাবনার বীজ এই বইতে চমৎকার পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া গেল। সেজন্যই কিছু অনুযোগ থেকে যায়। প্রথমত পার্সিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনূদিত যে দু’টি বই থেকে এই কথাংশগুলো সংকলিত, তার উল্লেখ ভূমিকাতে একটিবার মাত্র পাওয়া গেল। কিন্তু ১০৭টি অংশের মূল সূত্রগুলি প্রতিটি লেখার সঙ্গে উল্লেখ করা কি সযত্ন সম্পাদনার অংশ হতে পারত না? এর মধ্যে বহু অংশে ক্রোনিন ও রেজা সানির প্রতিবেদনমূলক অংশ রয়েছে, আব্বাসের নিজের বয়ানের মধ্যে মধ্যে সেসব সংকলনের ক্রম অসংগত লাগবে না পাঠকের, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। সায়ন্তন বলছেন, প্রয়োজনবিশেষে সম্পাদনা ও পরিমার্জন করেছেন তিনি কিছু অংশ। সেক্ষেত্রে সংকলকের পাশাপাশি তাঁর ভূমিকা সম্পাদকেরও বটে। সেই কারণেই প্রতিটি অংশে সূত্র উল্লেখের পাশাপাশি সময়কাল ও টীকার সবিশেষ প্রয়োজন ছিল। পরিশিষ্টর
উল্লেখপঞ্জিটিতে জরুরি তথ্যের সংকলন রয়েছে, ব্যাখ্যা রয়েছে, বিশ্লেষণ রয়েছে, কিন্তু তা এতটাই অবিন্যস্ত, পাঠকদের কাছে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, তা বলা কঠিন। এমন জরুরি বইয়ের পরবর্তী সংস্করণ অবশ্যই হবে, তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাবা যায় কি? উপরোধ রইল।
ভূমিকাটি জরুরি এবং সংকলকের আত্মিক অনুভবের দর্পণ, কিন্তু একটি বাক্যে জোর খটকা লাগল। সায়ন্তন বলছেন, ‘এই বইটি পড়তে পড়তে অনেকেই হয়তো লক্ষ করবেন, বেশ কিছু অংশে ইংরেজি শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কলকাতা শহরের সমকালীন শিক্ষিত বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলেন, তাকে যতটা সম্ভব লিখিত ভাষায় প্রকাশ করা যায়, সেই চেষ্টাই করা হয়েছে (এর বাইরের বিপুল অংশের বাংলাভাষী মানুষকে এই নির্বাচনের মাধ্যমে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে না, বরং এ নিছকই অনুবাদকের সীমাবদ্ধতা)। তাই বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করার ছুৎমার্গকে এই বইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন ভাবেই পরিহার করা দরকার বলে মনে হয়েছে।’ অনুবাদকের কৈফিয়ৎ এটি হতেই পারে। কিন্তু ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজড’ বা মান্য লেখ্য বাংলার বাইরেও এই ‘কলকাতা শহরের সমকালীন শিক্ষিত বাঙালি’-র লব্জ হঠাৎ প্রয়োজন পড়ল কেন? যে ছুঁৎমার্গিতার কথা সায়ন্তন বলছেন, বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে, রুশ সাহিত্যের অনুবাদ ও অন্যান্য ভাষার কালজয়ী সাহিত্যের অনুবাদের সূত্র ধরে, তেমন কোনও রক্ষণশীলতার আর প্রয়োজনই পড়েনি। গদ্যে ‘সাথে’-র ব্যবহার নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত বলে যদি কেউ দাবি করেন এই অনুবাদ পড়ে, তবে তো লেখ্য বাংলার যুক্তিক্রমই খাটবে, বা তর্ক হলে তার সূত্রেই হবে, শিক্ষিত বাঙালির কথ্য ধরন সেখানে কেন গুরুত্বপূর্ণ হবে? মান্য বাংলায় বই প্রকাশ হওয়ার মধ্যে উপভাষার প্রতি সাম্রাজ্যবাদী অভিব্যক্তি থাকুক না থাকুক, এই বাক্যে অপরায়ন এড়ানো গেল কি? ভাবনার আভাস থেকে যায়।
এই বইয়ের বিশেষ পাওনা অবশ্যই অনিন্দ্য সেনগুপ্তর ‘উত্তরভাষ’। নিবন্ধ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল লেখাটি। সঙ্গে গ্রন্থসজ্জার যত্ন ও নিষ্ঠা অবশ্যই উল্লেখ্য। তর্পণ সরকারের প্রচ্ছদ ও কৌস্তুভ চক্রবর্তীর অনবদ্য অলংকরণগুলি বইটিকে যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনই পরিচালক ও তাঁর ছবির দৃশ্যের স্থিরচিত্রের চমৎকার ব্যবহারও।
মাস্টারক্লাসে কিয়ারোস্তামি
সংকলন ও তর্জমা: সায়ন্তন দত্ত
উত্তরভাষ: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
একলব্য
৫৫০ টাকা
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..