আমি ভেবেছিলাম, একটা কাল্পনিক রেলপথের কথা। কেওনঝড়ে পাথরের মধ্যে অনেক লোহার পাহাড় রয়েছে। কল্পনা করেছিলাম এই পাহাড়ের মধ্য দিয়েই রেললাইন যাচ্ছে, এবং তা ঢুকে পড়ছে আদিবাসী গ্রামের মধ্যে। তাঁদের যে ‘মিথ’, রেলপথ আসায় তা একটু একটু করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেমন, সীতা এসেছিলেন ওই গ্রামে, কেউ কেউ দেখিয়েছিল বাল্মিকীর আশ্রমও। একটা গুহার মধ্যে থাকা দুটো গোলাকৃতি পাথর– বলা হয় লব-কুশের বালিশ। এই যে মিথ, তা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ওই রেললাইন তৈরির মধ্য দিয়ে। শহর এগিয়ে আসছে। এটাই আমার দ্বিতীয় উপন্যাস, নাম: ‘নবম পর্ব’।
১৯৮১ সাল। প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম বই, গল্প সংগ্রহ, নাম: ‘ভূমিসূত্র’। সে নিয়ে কথা হয়েছে আগেও, নানা জায়গায় লিখেওছি। দ্বিতীয় বই যেটা, সেটাও গল্পের বই– প্রথম বইয়ের পাঁচ বছর পর, ১৯৮৬ সালে। সে বই: ‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু’। ‘ভূমিসূত্র’ আমাকে যতটা প্রচার দিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি প্রচার দিয়েছিল আমার দ্বিতীয় বই।
সেইসব অভিজ্ঞতাই মানুষকে লিখিয়ে নেয়, যেসব অভিজ্ঞতা মানুষকে আশ্চর্য করে। বাগবাজারে গলির ভেতরে মানুষ হয়েছি। আমার কাছে বড় জায়গা দেখতে যাওয়ার মানে ছিল গঙ্গা দেখতে যাওয়া। আমি যখন প্রান্তর দেখলাম, দেখলাম দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, ধানের খেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে কবিতার পঙক্তি থেকে উঠে এসেছিল চোখের সামনে। এগুলো এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা! সমস্ত সন্ধ্যার পাখি ফিরতেই মনে হচ্ছে গাছের ভেতর একটা উৎসব-উৎসব ভাব– বাড়ি এলাম বাড়ি এলাম। সব পাখিই বলছে ‘আমার বাড়ি, আমার বাড়ি’! ভোরবেলা সারিবদ্ধভাবে গাছ থেকে পাখিরা চলল আবার চারণক্ষেত্রে। মাঠের মধ্য দিয়ে বাচ্চা ছেলেগুলো ধান খুঁজছে। গোলায় উঠে গেলে ঝরতি-পরতি খানিক চালগুলো পড়ে যায়। সেই ধান খোঁজায় শুধু তারা নেই, রয়েছে অনেক ইঁদুরও। দেখা যাচ্ছে, ইঁদুর স্বাস্থ্যবান হচ্ছে। এই ইঁদুর আবার খুঁজছে কিছু কিছু মানুষ। কারণ, স্বাস্থ্যবান ইঁদুরগুলো খাবে। আমার দ্বিতীয় বই ‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু’তে এসেছে এই অভিজ্ঞতার ঝিলিক।
১৯৭৪ সালে আমি ভূমি সংস্কারের চাকরিতে যুক্ত হলাম। গ্রামে গেলাম। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছিলাম। যদিও বেশিদিন কাজ করিনি। দেড় বছরের কাছাকাছি। চাকরিটা ছিল ভূমিরাজস্ব দফতরের, এখন যাকে বলে ‘ব্লক ল্যান্ড রেভেনিউ অফিসার’। ’৭৫ সালে সেই চাকরি ছেড়ে গিয়েছিলাম আবহাওয়া দফতরে। ’৭৫-’৮০ এই সময়টায়। শেষ দু’বছর ছিলাম পানাগড়ে। এই পানাগড়ে একটা এয়ারপোর্টও রয়েছে। বিলুডিহা গ্রামের পাশে সেই বিমানবন্দর, পানাগড় শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বেশিরভাগ দিনই আমি ডিউটি করতাম রাতে, দিনের বেলা সাইকেল চালিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম। পানাগড়ের এই অভিজ্ঞতাও এসে পড়েছে অষ্ট চরণে।
‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু’ আসলে একটা ধাঁধার প্রথম লাইন। ‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু/ মাছ ধরিতে গেল লাটু/ শুকনো ভুঁয়ে ফেলে জাল/ মাছ ধরে সে চিরকাল।’ মানে, মাকড়সা। তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা গ্রান্ট দিত– পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হত। আমি সেই গ্রান্ট পেয়েছিলাম। ‘অনুষ্টুপ’ থেকে প্রকাশিত হল সেই বই। তখনই এই বইটা নাম করে। মনে আছে, এর কিছু দিন আগেই নবারুণ ভট্টাচার্যর কবিতার বই ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-ও বেরিয়েছে। এই বই দুটো তখন অনেকেরই হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত। ১৯৯৯ সালে প্রথম যে আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের উৎসব ‘এনএবিসি’-তে গেলাম, তা এই বইয়ের দরুনই। উদ্যোক্তার স্ত্রী প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন, তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল এই বই।
এখনও আমার লেখালিখি নিয়ে যখন কথা বলেন কেউ, অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু’ থেকে আমরা তাঁর পাঠক। নামগল্পটা বেরিয়েছিল ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায়। পূর্ণেন্দু পত্রীর এই গল্পটা ভালো লাগে। পূর্ণেন্দুদা আমাকে বলেন, ‘প্রচ্ছদটা আমি করব।’ করেওছিলেন। সাদা মোটা ব্রাশ দিয়ে লেখা ছিল বইয়ের নাম। এখানেই শেষ হয়নি পূর্ণেন্দুদার ভালো লাগা। বলেছিলেন, ‘এই গল্প কাউকে দিও না, আমি ফিল্ম করব।’ তা অবশ্য হয়নি। ওঁর যখন ক্যানসার হয়েছিল, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। পূর্ণেন্দুদা তখন বলেছিলেন, ‘করা হল না ছবিটা, তবে কী জানো, ছবির ব্যাপারটা হল এই, ছবি করব– এই ভাবনা বড্ড আনন্দ দেয়। করছি করছি ব্যাপারটা। কিন্তু ছবি করতে গেলে যাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়, তা বড় নিরানন্দের।’
এই গল্প নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন আরও দু’-তিনজন। একজন নদী-বিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্যর সুপুত্র, এই মুহূর্তে তাঁর নাম মনে পড়ছে না, শুটিং শুরু করেছিলেন, টাউন হলে একদিন দেখতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু ক’দিন পরেই অকালপ্রয়াত হন। শঙ্খ ঘোষ বলে একটি ছেলেও এই ছবিটা করতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়েছিল। ধার-দেনায় ডুবে সে যদিও ছবিটা শেষ করে, কিন্তু ভালো হয়নি।
………………………………………
‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু’ আসলে একটা ধাঁধার প্রথম লাইন। ‘অষ্ট চরণ ষোলো হাঁটু/ মাছ ধরিতে গেল লাটু/ শুকনো ভুঁয়ে ফেলে জাল/ মাছ ধরে সে চিরকাল।’ মানে, মাকড়সা। তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা গ্রান্ট দিত– পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হত। আমি সেই গ্রান্ট পেয়েছিলাম। ‘অনুষ্টুপ’ থেকে প্রকাশিত হল সেই বই। তখনই এই বইটা নাম করে। মনে আছে, এর কিছু দিন আগেই নবারুণ ভট্টাচার্যর কবিতার বই ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-ও বেরিয়েছে। এই বই দুটো তখন অনেকেরই হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত।
………………………………………
এই আমার দ্বিতীয় বই নিয়ে খানিক কথা বলা। কিন্তু এই সূত্রে দ্বিতীয় উপন্যাসের কথাও খানিক বলি। প্রথম বই ‘চতুষ্পাঠী’, ১৯৯২ সালে। সে বই, কেন লিখেছিলাম, কী বৃত্তান্ত– অনেকেই জানেন। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাসের কথা সেভাবে বলিনি। আজ বলছি।
১৯৯২ সালে, আমাকে বদলি হতে হল কেওনঝড়ে। আমি তখন আকাশবাণীতে চাকরি করি। কেওনঝড়ের আসল নাম ‘কেন্দুঝড়’। প্রচুর কেন্দুগাছ আছে সেখানে। কেন্দুপাতা বিড়ির তামাক বাঁধতে লাগে। বিড়ি বাঁধলে পরে পাতা ফাটে না, যেহেতু পাতা মোলায়েম, এমনকী, শুকিয়ে গেলেও ফাটে না। ট্রান্সফারে শহরও ছিল, কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই এই কেওনঝড় এলাকায় বদলি নিয়েছিলাম। আদিবাসী এলাকায়। এই এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আবারও সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হই।
কেওনঝড়ে এক পাহাড় আছে, যেখান থেকে বৈতরণী নদীর উৎপন্ন হয়েছে। যেটা উৎস, সে জায়গার নাম ‘গো-নাসিকা’। এই গো-নাসিকা অঞ্চলে থাকেন প্রচুর আদিবাসী। এঁদের বলা হয় ‘জুয়াঙ্গ’। ওঁদের নিজস্ব কোনও বর্ণমালা নেই। মৌখিক ভাষাটা রয়েছে, কিন্তু ওড়িয়া ভাষার চাপে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। জুয়াঙ্গদের সংখ্যা খুবই কম, সব মিলে হাজার তিনেকের বেশি হবে না। ওঁরা এখনও কিছু প্রিমিটিভ অভ্যাসের মধ্যে বেঁচে আছে। ১৯৯৪ সাল নাগাদও দেখেছি, শহরে এসে ওঁরা দেশলাই কিনছে, কিন্তু সেই দেশলাই গ্রামে ব্যবহার করছে না। তাহলে আগুন কী করে পাচ্ছে? কোমরে তারা রাখছে একটা লোহার টুকরো এবং একটা পাথর। পাথর এবং লোহার টুকরোর ঘষায় একটা স্পার্ক তৈরি হচ্ছে। ধুতরো জাতীয় ফলের মধ্যেকার ফাইবারের ভেতর সেই স্পার্ক পড়লেই আগুন জ্বলে ওঠে। ওঁরা এইভাবেই আগুন তৈরি করতেন। এবং সেই আগুন প্রিজার্ভ করেন। রয়েছে ‘মণ্ডঘর’ বলে একটা ঘরও। গোষ্ঠীর নিত্যব্যবহার্য জিনিস, মাদল, ধামসা, বিউগল ধরনের একটা যন্ত্র– ফলের খোপরা থেকেই তৈরি হয়, সেসবও রাখেন ওই ঘরে। সঙ্গে ওই আগুনও। যাঁদের দরকার হয়, আগুন নিয়ে যান এই মণ্ডঘর থেকে। এর বাইরে যদি দরকার হয়, তাহলে পাথর আর লোহার ঘর্ষণ তো রইলই।
এই জুয়াঙ্গদের জীবন দেখলাম। আশ্চর্য হলাম। আদিবাসী জীবন দেখে শুধু নয়, বৈতরণী নদীকে দেখেও। সেই নদী কখনও কখনও মাটির মধ্যে গোপনে ঢুকে পড়ছে, কিছুটা গিয়ে, খানিক দূরে সেই নদী আবার উদার হচ্ছে। ভদ্রকের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশছে যখন তখন নাম হচ্ছে ভিতরকণিকা। তখন আমি ভাবছিলাম, একটা কাল্পনিক রেলপথের কথা। এইসব অঞ্চলে পাথরের মধ্যে অনেক লোহার পাহাড় রয়েছে। ভেবেছিলাম এই পাহাড়ের মধ্য দিয়েই রেললাইন যাচ্ছে, এবং তা ঢুকে পড়ছে আদিবাসী গ্রামের মধ্যে। তাঁদের যে ‘মিথ’, রেলপথ আসায় তা একটু একটু করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেমন, সীতা এসেছিলেন ওই গ্রামে, কেউ কেউ দেখিয়েছিল বাল্মিকীর আশ্রমও। একটা গুহার মধ্যে থাকা দুটো গোলাকৃতি পাথর– বলা হয় লব-কুশের বালিশ। এই যে মিথ, তা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ওই রেললাইন তৈরির মধ্য দিয়ে। শহর এগিয়ে আসছে। এই উপন্যাসের নাম ‘নবম পর্ব’।
উপন্যাস লেখার বছর ২০ পর সত্যিই রেললাইন ঢুকে পড়ল সেই গ্রামে।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে এই উপন্যাসটা লিখেছিলাম, তা নয়। ১৯৯২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল আমার প্রথম উপন্যাস ‘চতুষ্পাঠী’। ১৯৯৪ সালে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার প্রিয়ব্রত দেব আমাকে বলেছিলেন এই উপন্যাসটা লিখতে। লেখার পর প্রতিক্ষণ-এ দিলাম বটে, কিন্তু সে বছর পুজোসংখ্যা বেরল না, কারণ প্রিয়ব্রত দেবের হার্ট অ্যাটাক হল। কিন্তু উপন্যাসটা যে লিখেছি, সে কথা কেউ কেউ জানতেন। আমাকে তখন ‘প্রতিবেশ’ নামের একটি পত্রিকা থেকে অনুরোধ এল উপন্যাসটা দিতে, সুধীর চক্রবর্তীর নাম করে। আমি সেই উপন্যাস দিলাম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ‘প্রতিক্ষণ’ সেসময় যত লোক পড়তেন, ‘প্রতিবেশ’ পড়তেন না। ফলে এই উপন্যাস অনেকটাই অন্তরালে রইল।
দে’জ থেকে বেরল ‘নবম পর্ব’, ‘চতুষ্পাঠী’র মতোই। তেমন প্রশংসিত হল না। কিন্তু বুদ্ধদেব গুহ অনেকবারই বলেছেন, ‘তোমার চতুষ্পাঠীর চাইতেও এটা আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে।’ এমনকী, পরে যখন ‘হলদে গোলাপ’ উৎসর্গ করেছিলাম বুদ্ধদেব গুহকে, তখনও বুদ্ধদেব গুহ বলেছিলেন, ‘‘তোমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কিন্তু ‘হলদে গোলাপ’ নয়, ‘নবম পর্ব’।’
‘নবম পর্ব’ নাম দিয়েছিলাম এই জন্য যে, উপন্যাসের শেষের দিকে একটা ট্রাজিক গল্প নিয়ে একজন সিরিয়াল করে, সেই সিরিয়ালের নাম ছিল ‘নবম পর্ব’। বইটা উৎসর্গ করেছিলাম ওড়িয়া সাহিত্যিকদের। তখন বিভূতি পট্টনায়ক ছাড়াও নানা ওড়িয়া সাহিত্যিককে চিনতাম। ওঁদের বইটা দিয়েওছিলাম।
শেষ করি, একটা মজার ঘটনা দিয়ে। উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জানকীবল্লভ পট্টনায়ক। তাঁর কিছু প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ দে’জ পাবলিশিং ছেপেছিল। একদিন দে’জ-এ তিনি এসেছেন, আমিও উপস্থিত হয়েছি। উনি বাংলা জানেন ভালোই। যেহেতু উড়িষ্যা নিয়ে লেখা, তাই জানকীবল্লভ পট্টনায়ককে এই ‘নবম পর্ব’ উপন্যাসটা দিয়েছিলেন প্রকাশক। তিনি বলেছিলেন, ‘এই একটা পর্ব নিয়ে আমি কী করব, বাকি আটটা পর্বও আমায় দিন!’