গোলসোরখি তাঁর ভাষণ শুরুই করেছিলেন– ‘আমি একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী…’ এই বলে। তাঁর পুরো বক্তৃতা জুড়ে ছিল, কেন কমিউনিজ়ম মানবমুক্তির একমাত্র পথ এবং সামন্তবাদী শাহ-রাজতন্ত্রকে উৎখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম কেন অনিবার্য– তারই বিশদ ব্যাখ্যা। এই সময়ে প্রধান বিচারপতি কর্নেল গজ়ফ্ফরজ়াদা তাঁকে থামিয়ে নির্দেশ দেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বলা ছাড়া আর একটিও শব্দ না উচ্চারণ করতে।
১০.
তুমি জেনেছ, ইরানে শাহ-রাজতন্ত্রবিরোধী লড়াইটা লড়েছিল শুধু খোমেইনির অনুগামী ইসলামি মৌলবাদীরা। ঠিক যেভাবে তুমি আজকে জানছ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইটা লড়ছে শুধুই হামাস, ইসলামি ব্রাদারহুডকে সঙ্গে নিয়ে! পপ্যুলার ফ্রন্ট কিংবা ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অভ প্যালেস্তাইন-এর মতো বামপন্থী দলগুলির কথা তুমি জানো না, সেই আগ্নেয় ষাট-সত্তর থেকে আজও যাদের গেরিলা-বাহিনীগুলি লাগাতার প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন যাদের ফিদায়িঁরা শহিদ হচ্ছেন। সুতরাং তুমি জানো না ফাদায়াঁ-ই-খাল্ক-এর গেরিলাদের কথা! তুমি জানোনি খোমেইনিদের সমান্তরালে জনতার জন্য আত্মত্যাগী (‘ফাদায়াঁ-ই-খাল্ক’ মানেই তো তাই!) এই গেরিলারাও ইরানের পার্বত্য গ্রামাঞ্চলে মরণপণ লড়াই চালিয়ে গেছে। তুমি জানোনি, কারণ তোমাকে তাই জানানো হয়নি। ওরা তোমাকে জানতে দিতে চায়নি (বিশেষত যদি তুমি তরুণ হও, তাহলে তো আরওই নয়) যে প্রতিরোধের যুদ্ধে একটা প্রগতিশীল বামপন্থী ধারাও রয়েছে, যা শ্রেণিশোষণে দীর্ণ এই ব্যবস্থাটার স্থায়ী অবসান চায়। এটাতে ওদের সকলের আপত্তি। সকলের! সে মোহাম্মদ রেজ়া শাহ হোক বা খোমেইনি, কিংবা গণতন্ত্রের বিশ্ব-ঠিকাদার মার্কিন মিডিয়া। ওরা বলে, আমরা নেই। যদি নাই থাকি, তাহলে আমাকে ওরা মারল কেন?
………………..
পৃথিবীখ্যাত ইরানীয় রাজনীতি বিশ্লেষক হুমান মাজ্দ গোলসোরখিকে ‘ইরানের চে গেভারা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বস্তুত ওখানকার তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর চিরবিদ্রোহী ইমেজের আবেদন সত্যিই ছিল চে গেভারার সমতুল। দাদ্গাহি খোসরো গোলসোরখি। কবি। বিপ্লবী। জন্ম ১৯৪৪-এ, ‘ইউরোপের দরজা’ বলে পরিচিত রাশ্ত শহরে। অল্প বয়স থেকে লেখালিখিতে জলচল, ছয়ের দশকে এসে সম্পাদক হলেন ‘কাহায়ান’ খবরের কাগজে। দু’হাতে লিখে গিয়েছেন, যদিও সাংবাদিক গদ্য নয়, ইরানে গোলসোরখি বিশিষ্ট হয়ে আছেন তাঁর নিজের কবিতা এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনামূলক লেখার জন্য। ‘পোলিটিকস অভ আর্ট, পোলিটিকস অভ পোয়েট্রি’ বা ‘লিটরেচার অভ দ্য মাসেস’-এর মতো বইগুলিতে প্রতিরোধ সাহিত্য নিয়ে তাঁর প্রথাবিরোধিতার অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে। ‘পোলিটিকস অভ আর্ট, পোলিটিকস অভ পোয়েট্রি’-তে গোলসোরখি কবিতায় রাজনৈতিক শব্দের সরাসরি প্রয়োগের বদলে সন্ধ্যাভাষা ব্যবহারের কায়দাকে প্রত্যাখ্যান করে লিখছেন, ‘রাজনৈতিক কবিতায় সন্ধ্যাভাষার ব্যবহার হচ্ছে অন্ধকার ঘরের মধ্যে গুলি ছোঁড়ার সামিল!’ তাঁর মতে, রাজনৈতিক কবিতার লক্ষ্যবিন্দু হবে শত্রুর হৃৎপিণ্ড। একটি বস্তুগত কবিতার কখনও– মানুষের কাছে ভুল ব্যাখ্যা হলেও হতে পারে– এমন ঝুঁকি নেওয়া মোটেও উচিত নয়। পড়লে বোঝা যায়, ফিলাস্তিনি কমিউনিস্ট কবি মাহ্মুদ দারভিশের ‘অন অল-শির’ (প্রসঙ্গ কবিতা) দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘ইরানিয়ান পিপলস ফেদায়ি গেরিলাস’ নামের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলের সমর্থক ছিলেন, যদিও দলটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাঁদের নিজেদের একটি গ্রুপ ছিল– সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী– যার কেন্দ্রে ছিলে তিনি এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় সহযোদ্ধা চিত্রনির্মাতা ও কবি কেরামত দানাশিয়ান। ১২ জনের এই গ্রুপটি শাহ-রাজতন্ত্রের হিংস্র দমননীতি আর প্রতিবাদী কবি-শিল্পী-সাংবাদিকদের গুপ্তহত্যার পালটা হিসাবে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ রেজ়া পহ্লভি শাহ-কে অপহরণ ও খতম করার ছক বানিয়েছিল। ১২ জনই ধরা পড়ে যান। ১৯৭৪-এ তেহরানের মিলিটারি কোর্টে তাঁদের বিচার শুরু হয়। ১২ জনের মধ্যে অনেকেই খোলাখুলি ‘দোষ’ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা করেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গোলসোরখিও পুরোপাক্কা কমিউনিস্টই হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। ‘ইরানিয়ান পিপলস ফেদায়ি গেরিলাস’ নামের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলের সমর্থক ছিলেন, যদিও দলটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তাঁদের নিজেদের একটি গ্রুপ ছিল– সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী– যার কেন্দ্রে ছিলে তিনি এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় সহযোদ্ধা চিত্রনির্মাতা ও কবি কেরামত দানাশিয়ান। ১২ জনের এই গ্রুপটি শাহ-রাজতন্ত্রের হিংস্র দমননীতি আর প্রতিবাদী কবি-শিল্পী-সাংবাদিকদের গুপ্তহত্যার পালটা হিসাবে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ রেজ়া পহ্লভি শাহ-কে অপহরণ ও খতম করার ছক বানিয়েছিল। ১২ জনই ধরা পড়ে যান। ১৯৭৪-এ তেহরানের মিলিটারি কোর্টে তাঁদের বিচার শুরু হয়। ১২ জনের মধ্যে অনেকেই খোলাখুলি ‘দোষ’ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা করেন। মহীরুহের মতো অটল থাকেন পাঁচজন– তায়ফুর বাতাহি, আব্বাস আলি সামাকার, রেজ়া আলমাজ়াদা, কেরামত দানাশিয়ান এবং খোসরো গোলসোরখি। এখানেই গোলসোরখি যে বক্তব্যটি রাখেন, সেটিকে সারা পৃথিবীর বিপ্লবীদের শ্রেষ্ঠ ‘কোর্টরুম স্পিচ’-এর একটি বলে ধরা হয়ে থাকে।
গোলসোরখি তাঁর ভাষণ শুরুই করেছিলেন– ‘আমি একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী…’ এই বলে। তাঁর পুরো বক্তৃতা জুড়ে ছিল, কেন কমিউনিজ়ম মানবমুক্তির একমাত্র পথ এবং সামন্তবাদী শাহ-রাজতন্ত্রকে উৎখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম কেন অনিবার্য– তারই বিশদ ব্যাখ্যা। এই সময়ে প্রধান বিচারপতি কর্নেল গজ়ফ্ফরজ়াদা তাঁকে থামিয়ে নির্দেশ দেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বলা ছাড়া আর একটিও শব্দ না উচ্চারণ করতে। সিংহগর্জনে গোলসোরখি তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাকে হুকুম দিতে এসো না! হুকুম দাও তোমার অধস্তনদের। আমি মানুষের জন্য বলব, নিজের জন্য নয়।’ আদালত তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে না দেওয়ায় নিজের সপক্ষে একটি কথাও না বলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে যান। তখন আদালত তাঁকে জিগ্যেস করেছিল যে ছাড়া পেলে তিনি এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যাবেন কি না। একশব্দে উত্তর দিয়েছিলেন গোলসোরখি, ‘হ্যাঁ।’ মৃত্যুদণ্ড শুধু ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল!
গোলসোরখির সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় দানাশিয়ানেরও। উচ্ছ্বসিত গোলসোরখি বলে ওঠেন, ‘কমরেড!’ দানাশিয়ান উত্তর দেন, ‘আমার সেরা কমরেড’ বলে! পরের পর্বের জন্য সেকথা তোলা থাক?
রেয়্-র রাস্তায় যত বাচ্চা, তাদের সব্বার চোখে
বসন্ত হবে সবুজে পল্লবিত আর টাটকা!
তারা যেন জানে বসন্ত কী।
আমরা যেন জানি কষ্ট পাওয়াটা কী!
যেমন তিনদিনের জ্বরে ভুগে
রহ্মানের ছোট মেয়েটার মরে যাওয়া।
আমরা যেন এ ওকে ভালোবেসে চলি!
পতাকায় দুলে ওঠা গানের মতো হৃদ্স্পন্দনে।
[রেয়্ দক্ষিণপূর্ব ইরানের শহর। ‘রেয়্-র রাস্তা’ দক্ষিণ তেহ্রানের দরিদ্রতম এলাকার মাঝখান দিয়ে যায়।]
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ