১২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলি এরপর যথা সময়ে রুশ ভাষায় প্রকাশিতও হয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার কোথাও সমর সেন বা তাঁর মতো আর কোনও বাঙালি অনুবাদকের প্রাথমিক ভূমিকার সাহায্য স্বীকৃতিও আমার অন্তত চোখে পড়েনি। এর একটি কারণ অবশ্য এই যে, সেটা ছিল দু’জনের মধ্যে অলিখিত চুক্তি– সেই চুক্তি অনুযায়ী অর্থমূল্য সমর সেন নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন; কিন্তু সেটা প্রকাশ্য নয়, প্রকাশ ভবনেরও জানার কথা নয়। এরকম অভিজ্ঞতা আমারও আছে।
১১.
অনুবাদকের সুযোগ সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
প্রকাশালয়ে নিযুক্ত অনুবাদকদের মধ্যে অনেকে আবার তাঁদের নিজেদের দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। মস্কোবাসের সময় অনুবাদকর্মের পাশাপাশি তিনটি ভারতীয় পত্রপত্রিকার– Economic Weekly, Hindusthan Standard ও আনন্দবাজার পত্রিকাতেও সমর সেন লিখতেন।
কখনও কখনও আরও কিছু বাড়তি রোজগারের সুযোগও ঘটে যেত। আমরা জানতে পারছি, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে ১২ খণ্ড রচনাবলি প্রকাশের যে আয়োজন সোভিয়েত সরকার করেছিল, তারই প্রয়োজনে বেশ কিছু কবিতার ফরমায়েশি অনুবাদ ইংরেজিতে সমর সেন করেছিলেন। সেরকম অন্তত ৭৩টি কবিতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সমর সেন নিজে লিখেছেন, “রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর সময় রবীন্দ্র-রচনাবলী কয়েক খণ্ড প্রকাশের ব্যবস্থা হয়। ‘কবিতা বাছাই’ ও ইংরেজিতে আক্ষরিক অনুবাদে আমি সাহায্য করি। একজন নবীন রুশ সাহিত্যিকের সঙ্গে বসতাম। মূল তিন লাইন এক লাইনে অনুবাদ করলে তিনি আপত্তি করতেন, কেননা তাহলে পারিশ্রমিক কম মিলবে। ইংরেজি অনুবাদ তিনি রুশিতে (রুশ গদ্যে) রূপান্তরিত করতেন। সেগুলিকে শেষরূপ ‘কবিতায়’ দিতেন যাঁরা তাঁদের একজন ছিলেন পাস্তেরনাক…।” (বাবুবৃত্তান্ত, দ্র. ‘বাবুবৃত্তান্ত ও প্রাসঙ্গিক’ পৃষ্ঠা ৬১, দে’জ ২০০৩)
কবিতা অনুবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে সমর সেন যা যা বলেছেন, সবই ঠিক, তবে ‘কবিতা বাছাই’-এ কিছু সাহায্যের কথা যে তিনি বলেছেন, আমার অভিজ্ঞতায়, সেটা ঠিক নয়। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচনের দায়িত্ব কোনও বিদেশির হাতে থাকত না। এমনকী, সেই নবীন রুশ সাহিত্যিকের হাতেও থাকার কথা নয়– যে প্রকাশন সংস্থা থেকে অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তার সম্পাদকমণ্ডলীই তা স্থির করে দিতেন।
১২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলি এরপর যথা সময়ে রুশ ভাষায় প্রকাশিতও হয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার কোথাও সমর সেন বা তাঁর মতো আর কোনও বাঙালি অনুবাদকের প্রাথমিক ভূমিকার সাহায্য স্বীকৃতিও আমার অন্তত চোখে পড়েনি। এর একটি কারণ অবশ্য এই যে, সেটা ছিল দু’জনের মধ্যে অলিখিত চুক্তি– সেই চুক্তি অনুযায়ী অর্থমূল্য সমর সেন নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন; কিন্তু সেটা প্রকাশ্য নয়, প্রকাশ ভবনেরও জানার কথা নয়। এরকম অভিজ্ঞতা আমারও আছে।
অনুবাদের বাস্তব সমস্যা
অনুবাদের কাজের একটা বিরক্তিকর দিকও ছিল অনুবাদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশন দপ্তরে বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ রুশ সম্পাদকদের সঙ্গে বসা। অনুবাদ রুশ থেকেই হোক বা ইংরেজি থেকে, বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ স্থানীয় সম্পাদকরা মূল রুশের সঙ্গে সেগুলি মিলিয়ে দেখতেন, অনুবাদে বিচ্যুতি চোখে পড়লে তাঁরা প্রশ্ন রাখতেন অথবা কোনও বিকল্প প্রস্তাব রাখতেন। সেগুলি মীমাংসা করতে হত। অনুবাদক রুশ ভাষায় দক্ষ না হলে সম্পাদককে বোঝানো দুষ্কর হত। অনেক সময় বেশ কয়েকদিন ধরে এই রগড়ারগড়ি চলত। অনুবাদক হাল ছেড়ে দিয়ে সম্পাদকের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লে প্রকাশিত অনুবাদে অদ্ভুত ও হাস্যকর কিছু বেরিয়ে আসাও বিচিত্র ছিল না।
মস্কোয় আসার পর সেই বছরই মার্চ মাসে প্রথম যে বইটি অনুবাদের জন্য করি, সমর সেনের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল, সেটা ছিল N. Vinogradov-এর ‘Health care in the USSR’। খুবই হতাশাব্যঞ্জক, কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, তাছাড়া একজন পেশাদার অনুবাদককে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো যে কোনও বিষয়ের অনুবাদের জন্য প্রস্তুত থাকতে হত।
অনুবাদক হিসেবে মস্কোতে কাজ করার সময় ‘সোভিয়েত নারী’ পত্রিকার জন্য অনুবাদ ও সম্পাদনা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কুরুশ কাঁটা আর উলবোনার পদ্ধতির সঙ্গে পর্যন্ত পরিচিত হতে হয়েছে, আবার প্রকাশালয়গুলি উঠে গেলে জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্যিক চুক্তিপত্র, ব্যাবসায়িক চিঠিপত্র ইত্যাদি কত বিচিত্র বিষয়ের যে রুশ থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে রুশ ভাষায় তর্জমা আমাকে করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমরা জানতে পারছি, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে ১২ খণ্ড রচনাবলি প্রকাশের যে আয়োজন সোভিয়েত সরকার করেছিল, তারই প্রয়োজনে বেশ কিছু কবিতার ফরমায়েশি অনুবাদ ইংরেজিতে সমর সেন করেছিলেন। সেরকম অন্তত ৭৩টি কবিতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সমর সেন নিজেও বলেছেন: in the four and half years I stayed in Moscow, I translated books and pamphlets, ten which were fictions, and the rest about housing, the great plan, geography, astronomy etc…
খুবই স্বাভাবিক, যেহেতু ‘বৈদেশিক ভাষার সাহিত্য প্রকাশালয়’ বা ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিল মার্কসবাদী লেনিনবাদী সাহিত্য এবং আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রন্থাদির অনুবাদের প্রকাশ ও প্রচার।
এমনই ছিল পরিস্থিতি। কিন্তু তাই বলে ‘দাদুর দস্তানা’র মতো আবহমান কাল ধরে প্রচলিত উক্রাইনীয় রূপকথার অনুবাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে কেউ কেউ যে কমিউন প্রথার গন্ধ পান, সেটা কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক, আর তা যদি হয়ও তাতেই তার শিল্পগুণ কমে যায় নাকি?
আমাদের আক্ষেপের একটি বিষয় এই যে, মস্কোর অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশালয় তার দীর্ঘ অর্ধ শতাধিক বর্ষের ইতিহাসে রুশ ক্ল্যাসিকের অনুবাদ যতটুকু যাও বা প্রকাশ করেছে, রুশ কবিতার অনুবাদ, সেই তুলনায় প্রায় প্রকাশই করেনি। সাধারণভাবে রুশ কবিতার যতটুকু অনুবাদ হয়েছে, তা শিশুপাঠ্য ছড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একমাত্র সাতের দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছিল দু’টি অনুবাদ কাব্যসংকলন: একটি পঞ্চাশজন সোভিয়েত কবি– অনুবাদক হায়াৎ মামুদ, অন্যটি পুশকিনের কবিতা সংকলন: অনুবাদক ননী ভৌমিক ও মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কবিতার প্রতিনিধিস্থানীয় কোনও কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না? তাতে সোভিয়েত প্রচারাভিযানের লাভ বই ক্ষতি কী হত?
(চলবে)
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি