থানার ওয়্যারলেসে খবর আসছে। মোবাইল ফোন তো আছেই। ছোটবাবু নিখিল কর্মকার খুশির মেজাজে মাধাইকে বললেন, ‘এসব নিয়ে পুলিশের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার দরকারটা কী? আটকানো গেল? আরেকটু পরেই তো বাঁশরীবাবুরা এসে পড়বেন। ঝুটমুট বদনাম দিয়ে এলাকাছাড়া করে দেওয়া যায় না কি? বলি পুলিশ, আইন, আদালত বলে কি কিছু নেই?’
১২.
শিবনাথ সোরেনের নাতনির হত্যার পর বয়স্কদের আড্ডা কেমন কথা হারিয়ে ফেলেছে। আসেন সকলেই, প্রথম দু’-চারদিনের পর শিবনাথও। কিন্তু চারপাশ নিয়ে কথা যেন ফুরিয়ে গিয়েছে। সব যেন কেমন থমকে গিয়েছে। শিবনাথকে সান্ত্বনা দেওয়ারও ভাষা নেই। নারায়ণ মাহাতো বলেছিলেন, ‘থাকত যদি বয়স…।’ বয়স থাকলে কী হত, অসম্পূর্ণই থেকে গিয়েছে সংলাপ।
হারান ভটচায বললেন, ‘জানোয়ার দুটো গ্রামে ফিরছে। মাধাই বলেছে ঢুকতে দেবে না। গ্রামের মোড়ে অবরোধ ডেকেছে।’
শিবনাথ সোরেন বললেন, ‘আমি যাব, অবরোধে যাব।’
নারায়ণ বললেন, ‘আমরা প্রত্যেকে জানি ওরাই সব করেছে। কিন্তু আইনে ওরা দোষী নয়। পুলিশ থাকবে ওদের সঙ্গে।’
শিবনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমার শীতলার জীবনের কোনও দাম নেই?’
নারায়ণ বললেন, ‘অবশ্যই আছে। আমারই তো ইচ্ছে করছে বাঁশরীলাল আর ওর ছেলেকে পিটিয়ে মারতে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব, বলুন?’
হারান বললেন, ‘তবে একটা কথা। এই ঘটনায় দেখলাম গোটা কুসুমডিহা এক হয়ে ফুঁসছে, মাধাইটাও কোমর বেঁধে নেমেছে; আর যাকে এত ভালো ভাবছিলাম, পোস্টমাস্টার, সে একটা মেনিমুখো ভিতুর ডিম বেরল। যত সব শখের কাজ করে বেড়ায়, লোকদেখানি। আসল দরকারে ছেলেরা ডাকতে গেলে বলে, আমি সরকারি চাকরি করি, গোলমালে ভয় পাই। এরা মানুষ?’ নারায়ণ বললেন, ‘আমিও তাই শুনেছি। রাতবিরেতে পড়িয়ে বেড়ায়, ভাবতাম কত ভালো, এখন বুঝলাম টাকার নেশা। যাক গে, ও তো বাইরের লোক। ওর ভরসায় তো আমরা নেই। মাধাই যে অবরোধ ডেকেছে, তাতে সবাই থাকা যাক। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে মারামারি করতে পারব না। ওতে বিপদ বাড়ে।’
আরও পড়ুন: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
জল অতটাও গড়াল না। পুলিশ গ্রামের মাতব্বরদের ডেকে জানিয়ে দিল, আইনে দোষী নয়, কোর্টের অর্ডারও আছে, বাঁশরীলাল আর বিদ্যুৎকে বাড়ি ফিরতে দিতে হবে। মাধাই তিন-চারটে গ্রামের কয়েকজন ডাকাবুকোকে একজোট করেছিল, ফেরানোর আগের দিন তাদের তুলে নিল পুলিশ। থানায় বসিয়ে রাখল। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করল। সকালে কুসুমডিহাতে বারকতক টহলও দিল পুলিশ। চারপাশ থমথমে। বিদ্যুৎদের পোষা বাহিনীর গুটিকয়েক পরিবার ছাড়া, তাও অধিকাংশ এলাকার বাইরে, আর কেউ চাইছে না ওরা ঢুকুক। শিবনাথ সোরেনদের বাড়িতে নতুন করে হাহাকার চলছে।
থানার ওয়্যারলেসে খবর আসছে। মোবাইল ফোন তো আছেই। ছোটবাবু নিখিল কর্মকার খুশির মেজাজে মাধাইকে বললেন, ‘এসব নিয়ে পুলিশের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার দরকারটা কী? আটকানো গেল? আরেকটু পরেই তো বাঁশরীবাবুরা এসে পড়বেন। ঝুটমুট বদনাম দিয়ে এলাকাছাড়া করে দেওয়া যায় না কি? বলি পুলিশ, আইন, আদালত বলে কি কিছু নেই?’ বড়বাবু এর আগে মাধাইদের বলে দিয়েছেন, ‘এখন শুধু আটকে রেখেছি। বাড়াবাড়ি করলে গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান করে দেব।’ মাধাই ভাবছে সে কার কার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে, কে কে অবরোধে লোক নিয়ে আসবে, তারা কী করে আটক হল? তাহলে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করল, না কি ফোন ট্যাপ করল পুলিশ? ফোন ট্যাপ করলে তো আরও কিছু খোঁজ পেয়ে যাবে পুলিশ, চিন্তা হল মাধাইয়ের।
ওয়্যারলেসে ভেসে আসা কথাগুলো থানায় শুনতে পাচ্ছে সবাই।
পরপর দুটো খবর এল।
এক, রাহুল মিত্রের নেতৃত্বে পুলিশ ফোর্স সাগরটিলার ওপরের ঘরগুলিকে ঘিরে ফেলেছে। তল্লাশি চলছে। মাধাই চোখ বুজে ফেলল। আর বোধহয় আড়াল করা গেল না।
দুই, ওয়্যারলেসে প্রবল শব্দ। হইচই। থানায় সবাই অবাক হয়ে তাকাল। চিৎকার ভেসে এল, ‘মাওবাদীরা অ্যাটাক করেছে।’
(চলবে)
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।