Robbar

অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 26, 2024 5:30 pm
  • Updated:January 27, 2024 12:17 pm  

শুধু অভিজ্ঞতাই পারফর্মারের ‘নাগমণি’ হলে তারুণ্যের পিছনে কেউ দৌড়োত না। হাটে-বাজারে তা বড় সস্তাতেও পাওয়া যেত। তাছাড়া অভিজ্ঞতা বার্ধক্যের সম্পদ, যৌবনের নয়। আছে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু, কোনও অজ্ঞাত ঐশ্বরিক শক্তি, যা ক্রিকেট জীবনের প্রথম অর্ধে নিজেও টের পাননি অনুষ্টুপ। আজ পাচ্ছেন, এখন পাচ্ছেন, এই ৩৯-এ এসে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

অনুষ্টুপ মজুমদারকে চিনতে আমাদের প্রায় বছর কুড়ি লেগে গেল। অনুষ্টুপ মজুমদারকে চিনতে অনুষ্টুপ মজুমদারেরও প্রায় বছর কুড়ি লেগে গেল!

Bengal Cricket Team | Anustup Majumdar excels for Bengal in Ranji Trophy - Telegraph India
অনুষ্টুপ মজুমদার

আমাদের দোষ নেই। যে তিথিতে আদতে ‘জন্ম’ ক্রিকেটার অনুষ্টুপের, সেই সময় বাংলা টিমে প্রতিভার রাসপূর্ণিমা চলছে রীতিমতো। যে-দিকে দৃষ্টি যায়, যতদূর যায়, হীরকদ্যুতি শুধু। কেভিন পিটারসেনের আদলে জার্সির হাতা ঈষৎ তুলে ব্যাট করতে যাওয়া মনোজ তিওয়ারি, ঝকঝকে অভিষেক ঝুনঝুনওয়ালা, ব্যাটিং-বোলিংয়ে তুখোড় পারদর্শী লক্ষ্মীরতন ‘সব্যসাচী’ শুক্লা, নিখুঁত লাইন ও লম্বা চুলের রণদেব বসু কিংবা মাথায় ফেট্টি বেঁধে তেড়ে আসা অশোক দিন্দা, প্রতিভা-আকর্ষণ-সম্মোহনে এক-একজন সাক্ষাৎ মহাতারকা বিশেষ! কে আর‌ তার মাঝে ফিনফিনে, মুখচোরা, প্রচারবিমুখ, চন্দননগরের এক ছেলেকে নিয়ে আলাদা আদিখ্যেতা করবে? বাড়তি খেয়াল রাখবে? যাঁকে নিয়ে দু’লাইন আলাদা লেখার মশলা বলতে, ফেলু মিত্তিরের পরম ভক্ত। রায় সাহেবের সৃষ্টির ঠিকুজি-কোষ্ঠী গুলে খেয়েছেন মজুমদার মহাশয়। কিন্তু সে ‘কীর্তি’ তো এ-পাড়ার বিল্টে থেকে ও-পাড়ার মিনুমাসিমার মেয়ে, কত জনেরই আছে! বাঙালি ফেলু না পড়লে এখনও জাতে ওঠে না, পাতেও দেওয়া যায় না। একজন বাঙালি ক্রিকেটার সে পথের পথিক বলে ঊর্ধ্ববাহু হওয়ার কিছু নেই। আছে নাকি মনোজের মতো কভার ড্রাইভের কবিতা তাঁর, অথবা এলআরএস-এর মতো মাঠ পেরনো মার? ধুস! মিডল অর্ডারে ব্যাট করেন। ভাল করেন। ব্যস। বাকি সব অত্যন্ত মধ্যবিত্ত। নিতান্ত ছাপোষা।
ছোটবেলায় ইংরেজি বইয়ে পড়েছিলাম, ‘আ ক্যাট হ্যাজ নাইন লাইভস’। তা, ন’টা না হলেও অনুষ্টুপ মজুমদারের দু’টো জীবন আছে। রেলওয়েজ-পূর্ব সময়ে বাংলা ক্রিকেটে প্রথম জীবন। আর রেলওয়েজ-পরবর্তী সময় বাংলায় দ্বিতীয় জীবন। মাঝের রেলের আমল ভাল যায়নি। অনুষ্টুপকে কথায়-কথায় একবার জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, এককালে আঞ্চলিক পর্বে এত ভালো খেলছিলেন যে, ভারত ‘এ’-তে সুযোগ পাচ্ছিলেন বারবার। জাতীয় দলের দরজার দূরত্ব বড়জোর ছিল আর ১০০ মিটার। সেখান থেকে কী এমন ঘটল যে, কক্ষচ্যুত হয়ে আচম্বিত নিঃশেষ হয়ে গেলেন? এবং শেষে সে ব্যর্থতার শ্যাওলা সরিয়ে উইলোয় নতুন পরশপাথরও বা ছোঁয়ালেন কী করে? তা-ও ৩৪-৩৫-এ?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

যে তিথিতে আদতে ‘জন্ম’ ক্রিকেটার অনুষ্টুপের, সেই সময় বাংলা টিমে প্রতিভার রাসপূর্ণিমা চলছে রীতিমতো। যে-দিকে দৃষ্টি যায়, যতদূর যায়, হীরকদ্যুতি শুধু। কেভিন পিটারসেনের আদলে জার্সির হাতা ঈষৎ তুলে ব্যাট করতে যাওয়া মনোজ তিওয়ারি, ঝকঝকে অভিষেক ঝুনঝুনওয়ালা, ব্যাটিং-বোলিংয়ে তুখোড় পারদর্শী লক্ষ্মীরতন ‘সব্যসাচী’ শুক্লা, নিখুঁত লাইন ও লম্বা চুলের রণদেব বসু কিংবা মাথায় ফেট্টি বেঁধে তেড়ে আসা অশোক দিন্দা, প্রতিভা-আকর্ষণ-সম্মোহনে এক-একজন সাক্ষাৎ মহাতারকা বিশেষ! কে আর‌ তার মাঝে ফিনফিনে, মুখচোরা, প্রচারবিমুখ, চন্দননগরের এক ছেলেকে নিয়ে আলাদা আদিখ্যেতা করবে?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

স্মিত হেসেছিলেন অনুষ্টুপ। দুইয়ের উত্তরেই। বলেছিলেন, ‘ভারত খেলিনি কারণ তখন আমি ভাল খেলিনি। ভারত ‘এ’-র পর একটা সজোর ধাক্কা দিতে হয়, ভারতীয় টিমের সদর-দরজা খুলতে‌। কেউ কেউ পারে, তবে আমি পারিনি। আর‌ এখন আমায় খেলায় অভিজ্ঞতা! টানে অভিজ্ঞতা।’

Ranji round-up: Goswami, Majumdar tons lead Bengal rescue act - Rediff.com

শুনে বিশ্বাস হয়নি। আজও হয় না। শুধু অভিজ্ঞতাই পারফর্মারের ‘নাগমণি’ হলে তারুণ্যের পিছনে কেউ দৌড়োত না। হাটে-বাজারে তা বড় সস্তাতেও পাওয়া যেত। তাছাড়া অভিজ্ঞতা বার্ধক্যের সম্পদ, যৌবনের নয়। আছে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু, কোনও অজ্ঞাত ঐশ্বরিক শক্তি, যা ক্রিকেট জীবনের প্রথম অর্ধে নিজেও টের পাননি অনুষ্টুপ। আজ পাচ্ছেন, এখন পাচ্ছেন, এই ৩৯-এ এসে। না পেলে এমন অবলীলায় গত কয়েক বছর ধরে বাংলার বিপদ-বন্ধু বা ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হয়ে উঠতে পারতেন না। পারতেন না কেরিয়ার সায়াহ্নে এমন সন্ধ্যাতারা হয়ে ফুটতে!

‘আরে, বেশি বলো‌ তোমরা। শোনো, আজকাল টিম চাপে পড়লে অ্যাড্রিনালিন‌ ক্ষরণ হয়। খেলা আপনাআপনি ভাল হয়ে যায়’, সলজ্জ জবাব দেন ‘সাধক’। যা শুনতে সহজ, করা কঠিন। ভয়ঙ্কর কঠিন। টিম প্রতিবার ৫০-৫, সে রাহুদশা থেকে সহজ নয় বছরের পর বছর প্রতিনিয়ত বাংলাকে বাঁচানো, শেষে জেতানো। অন্তত তথাকথিত কোনও মধ্যবিত্তের কম্ম নয়‌। আজ থেকে বছর চার আগে ইডেনে রনজি সেমিফাইনালে যে মার মেরেছিলেন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে, স্কুলের হেডমাস্টারের বেত্রাঘাত মনে পড়ে গিয়েছিল! গত বছরও রনজি ফাইনাল খেলল বাংলা, নানান বিপদ-আপদ-শ্বাপদ সামলে অনুষ্টুপ করলেন মরশুমে প্রায় আটশো! এবার এখনও পর্যন্ত দু’টো সেঞ্চুরি, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনই এল দ্বিতীয়টা, অসমের বিরুদ্ধে, বাংলা ৪-৫৭ হয়ে যাওয়ার পর।

চলতি রনজিতে নির্ঘাৎ আসবে আরও। যে ফর্মে আছেন অনুষ্টুপ, যে খেলা তিনি খেলছেন, আজও বিকল্পহীন। আগামী কয়েক বছরেও তা থাকবেন। এবং কালে-কালে বাংলার ‘রজার মিল্লা’ হয়ে দেখা দিলেও তা আশ্চর্যের হবে না।

Anustup Majumdar to lead Bengal in Mushtaq Ali T20, Shami's younger brother gets call-up
বঙ্গ-ক্রিকেটের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ অনুষ্টুপ

মাঝে-মাঝে বড় দোটানা হয় অনুষ্টুপকে নিয়ে। তিনি কি শুধুই অ্যাড্রিনালিনের আশীর্বাদেই ম্যানড্রেক? নাকি প্রতিশোধও নেন অতীতের ওপর? কোথাও গিয়ে একটা বিচ্ছিন্ন প্রতিহিংসা কাজ‌ করে, নিজেরই উপর, দশ বছর পুরনো অনুষ্টুপ মজুমদারের ওপর? আরশির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে তিনি কি নিজের যৌবনকে মনে করান, যদি তুমি পারতে? জানেন হয়তো অনুষ্টুপ। বলেন না। কিংবা হয়তো জানেন না।
না রে তোপসে, অনুষ্টুপ মজুমদারকে চিনতে আমাদের আরও বছর কুড়ি লাগবে। ফেলু মিত্তিরকে বলে-টলে দ্যাখ, যদি আগে পারে!

…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে