Robbar

সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 17, 2023 8:23 pm
  • Updated:November 18, 2023 9:18 am  

যাঁকে আনার ব‌্যাপারে ঋতুদার বিরাট ভূমিকা ছিল, উত্তমকুমারের মৃত‌্যু নিয়ে যিনি কখনওই তার আগে মুখ খোলেননি, সুপ্রিয়া-কন‌্যা সোমা এসে পৌঁছলেন আমাদের প্রোগ্রামে। ওইর’ম সুন্দরী জীবনে খুব কম দেখেছি। দু’চোখে পরে আছেন বিষাদের কাজল, দৃষ্টি এ পৃথিবীর কারও জন‌্য নয়। একটা সাধারণ সালোয়ার পরে কাউকে যে অমন দেখাতে পারে, সোমাকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। উত্তমকুমারের মৃত‌্যুর আগের দিন তাঁর ‘বাবি’র সঙ্গেই ছিলেন তিনি।

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়

১৩.
উত্তম থিম তো তৈরি হয়ে গেল, এবার অপেক্ষা গেস্ট লিস্ট তৈরির। আমি হাত তুলে দিলাম। কাউকেই প্রায় চিনি না, ডাকবটা কাকে? ঋতুদা বিপদতারণ হয়ে এগিয়ে এল। একটা করে তুই-তোকারির ফোন, ব‌্যস– পটাপট সব রাজি হয়ে যাচ্ছে। আমি পরিচালক সেজে অবাক চোখে ম‌্যাজিক দেখছি। অতিথি তালিকায় সুচিত্রা সেন আর উত্তমকুমার বাদে সকলেই আছেন। জীবনে প্রথম চার ক‌্যামেরায় শুট, অনলাইন এডিট করবে সোনামণিদা, তাই ঠিক ছিল। শেষমেশ ব‌্যাপারটা কেঁচে যায়। চারটি ক‌্যামেরার যাবতীয় মেটিরিয়াল ডাম্প করে, তাকে ছানবিন করে তবে এডিট হত। আমার সঙ্গে রাত জাগত ইন্দ্র!

‘অচেনা উত্তম’ অনুষ্ঠানের সেটের পরিকল্পনাও ঋতুদার। যেন পুরনো কলকাতার একটা অবিকল সেট হয়, এমনটাই হুকুম করেছিল। তাই ‘পথ যদি না শেষ হয়’ টাইপ সেট হল। পুরনো শহরের গ‌্যাসলাইট, পার্ক-বেঞ্চ, হাতে টানা রিকশা-সমেত। ব‌্যাপারটাকে মায়াবী করে তুলতে ডিওপি ইন চিফ গিরিশ পাধিয়ার এইচএমআই-এর মুখে নীল কাগজ-টাগজ দিয়ে একটা কেলেঙ্কারিয়াস কেস করলেন! ডিরেক্টরের মোটেই পছন্দ হয়নি এত আড়ম্বর। কিন্তু বদলে যে কী বলব, সেই টেকনিক‌্যাল টার্ম-ই জানতাম না। ভেতরে ভেতরে প্রবল একটা টেনশন চলছে, ওদিকে সেট দেখে আপসেট দশা। এইসব নিয়েই এত ব‌্যতিব‌্যস্ত ছিলাম, উত্তম পাঁচের সঙ্গে বসাই হয়নি। বসার পর আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! কোথায় উত্তম কী ভুল করেছেন, তার সাতকাহন তৈরি করে সকলে রেডি। ভাবখানা এমন, যত বড়ই তুমি অতিথি হও না কেন, আমরা প্রমাণ করে দেব উত্তম সম্পর্কে তুমি কিসুই জানো না। এ যেন জমিদারের বিরুদ্ধে লেঠেল বিপ্লব হতে চলেছে। আমি ভালোমতো বুঝিয়ে বললাম, আফটার অল, যাঁরা আসবেন তাঁরা আমাদের গেস্ট। অসম্মানজনক কোনও প্রশ্ন যেন না করা হয়! দেবুদা, বিকাশদার ওপর কিছুটা জোর আছে আমার, বাকিদের তো ঠিকমতো চিনিই না ছাই। ‘জয় উত্তম’ বলে নেমে তো পড়লাম খেলায়।

উত্তমকুমার-সুপ্রিয়া দেবী

প্রথম দুটো পর্বের অতিথি অতি অবশ‌্যই সুপ্রিয়া দেবী। সেসময় শুধু ঋতুদা নয়, জগৎসুদ্ধু লোক ওঁকে ‘বেণুদি’ বলে ডাকছে। কারণটা খুব সহজ। অন‌্য এক চ‌্যানেলে ‘বেণুদির রান্নাঘর’ বলে জনপ্রিয় একটি কুকারি শো করতেন তিনি। ‘কোমল গান্ধার’-এর নায়িকাকে চোখের সামনে দেখব, ভেবেই বুকটা দুরুদুরু করে ওঠে। সব বাঙালি বাড়িতে সুপ্রিয়াকে নিয়ে কুকথার শেষ নেই, মূল জেলাসি উনি উত্তমকুমারকে সংসারচ‌্যুত করে নিজের কাছে রেখেছেন।

আমি অবশ‌্য উত্তম-সুচিত্রার চেয়ে সুপ্রিয়ার ফ‌্যানই বেশি ছিলাম। ডি সিকার ছবি দেখতে বসে সোফিয়া লোরেনকে যে-ই দেখতাম, সুপ্রিয়া ভেসে উঠতেন। যে বয়সে প্রথম সাক্ষাৎ, কম তো বয়স হয়নি তখন, কিন্তু ক‌্যারিশমা ও ব‌্যবহারে এক বালিঝড় উপস্থিতি। সুপ্রিয়াতে বুঁদ হয়ে প্রথম অ‌্যাকশন বললাম ‘অচেনা উত্তম’-এ। আমার সব আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে প্রোগ্রামটা তরতর করে এগোতে থাকল। ‘পঞ্চ মঞ্চবীর’ সুপ্রিয়াকে সামনে পেয়ে যথেষ্ট ভ‌্যাবাচ‌্যাকা খেয়ে সমীহের সঙ্গেই কথা বলতে শুরু করল। প্রথম এপিসোডটা তো ঠিকঠাকই গেল। ‘আপনাদের দাদা’ নিয়ে বহু মর্মস্পর্শী সব ঘটনা একটানা বলে চলেছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে এমন একটা কথা বললেন কন্ট্রোল রুমে সকলে নড়েচড়ে বসল। এর আগে কখনও শুনিনি তেমন তথ‌্য। উত্তম-সুপ্রিয়ার এক সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। যদি মেয়ে হত, তার নাম ঠিক করে রেখেছিলেন উত্তম। ভ্রমর। কখনও কখনও কিছু সত‌্যির সামনে পৃথিবী থমকে যায়। সুপ্রিয়া সামলে নিয়ে আবার উত্তমের প্রিয় খাবারে ফিরে গেলেন। কোনও না-ফোটা কুসুমের সজল দৃষ্টি সেটের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে লাগল অজান্তে।

No photo description available.
উত্তমকুমার ও তরুণকুমার

খুব অদ্ভুত একটা পর্ব হয়েছিল তরুণকুমারের। সেসময় তিনি অনেকটাই অসুস্থ। মেয়ে, নাতিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ঋতুদা দেখা করতে এসেছিল ‘বুড়োদা’র সঙ্গে। পর্দার মতোই হইহই করা এক ব‌্যক্তিত্ব। বয়স শরীরে যতটা, হাসিতে নয়। তরুণকুমার ওঁর নাতির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ক্লাস থ্রি না ফোর-এ পড়া এক মিষ্টি বাচ্চা। কথায় কথায় তরুণকুমারের মেয়ে জানালেন, বাচ্চাটি একটি ছবিতে অভিনয় করছে। ছবির নাম ‘পাতালঘর’, প্রযোজনা করছে ‘ব্ল‌্যাক ম‌্যাজিক’ বলে একটি সংস্থা। জীবন সত‌্যি বড় প্রাপ্তির গাছকৌটো। জানিই না, ‘পাতালঘর’ যখন রিলিজ করবে, তখন আমার ঠিকানা একদিন ব্ল‌্যাক ম‌্যাজিকই হবে। প্রথমে ঠিক ছিল তরুণকুমারেরও দু’টি পর্ব হবে। কিন্তু শুটিংয়ে একটা বিচিত্র সমস‌্যা দেখা দিল। উনি যা কথা বলছেন, তার সবটাই এমন জড়িয়ে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তরুণকুমার ভাবছেন, সবাই বুঝতে পারছে তাঁর কথা, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না একেবারেই। ঋতুদাকে বললাম স‌মস‌্যার কথা। ঠিক হল একটাই এপিসোড হবে।

উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী ও সোমা

পড়ুন ‘ঋইউনিয়ন’-এর আগের পর্ব: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান

আমার ভীষণ প্রিয় এক অভিনেতা তরুণকুমার। তাঁর এপিসোড কাটতে মরমে মরে গিয়েছিলাম। ওইরকম দুর্বোধ‌্য টক শো আর কখনও টিভির পর্দায় হয়েছে কি না সন্দেহ। যাঁকে আনার ব‌্যাপারে ঋতুদার বিরাট ভূমিকা ছিল, উত্তমকুমারের মৃত‌্যু নিয়ে যিনি কখনওই তার আগে মুখ খোলেননি, সুপ্রিয়া-কন‌্যা সোমা এসে পৌঁছলেন আমাদের প্রোগ্রামে। ওইর’ম সুন্দরী জীবনে খুব কম দেখেছি। দু’চোখে পরে আছেন বিষাদের কাজল, দৃষ্টি এ পৃথিবীর কারও জন‌্য নয়। একটা সাধারণ সালোয়ার পরে কাউকে যে অমন দেখাতে পারে, সোমাকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। উত্তমকুমারের মৃত‌্যুর আগের দিন তাঁর ‘বাবি’র সঙ্গেই ছিলেন তিনি। নানা ফিসফাস, গল্পগাছা ছড়িয়ে তাঁদের সম্পর্কে। বিকাশদা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, এ এপিসোডটায় আমায় একটু ফ্রি-হ‌্যান্ড দাও। উত্তমের মৃত‌্যুরহস‌্য মানুষের জানা উচিত।