কিছুদিনের মধ্যে ভীমসেনের সামনে বড় পরীক্ষা এসে উপস্থিত। রাজার কাছে খবর এল, বন থেকে এক বাঘ সন্নিহিত গ্রামে এসে কয়েকটি মানুষ মেরেছে, সেখানের গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করার সাহস পাচ্ছে না। রাজা ভীমসেনকে ডেকে পাঠালেন, ওহে বাঘটার একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
বোধিসত্ত্ব সেবার জন্মেছিলেন বারাণসী নগরের বাইরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তক্ষশিলার এক সুখ্যাত আচার্যের কাছে বিদ্যাচর্চা শেষ করে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর মূল পারদর্শিতা ধনুর্বিদ্যায়। তিনি তখন জম্মুদ্বীপের অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর। লোকে তাঁকে খাতির করে ‘চুল্ল ধনুর্গ্রহ পণ্ডিত’ বলে ডাকত।
অথচ বোধিসত্ত্ব ভুগতেন হীনম্মন্যতায়। তার কারণ তাঁর চেহারা। সেই জন্মে তিনি ছিলেন বেঁটে। তাঁর পিঠে ছিল বড় কুঁজ। তিনি ভাবতেন, আমি কোনও রাজার কাছে গিয়ে কাজ বা পারিতোষিক চাইলে তিনি আমার চেহারা দেখে ভরসাই করবেন না; ভাববেন, এমন বামন কি আর ঠিকঠাক তীর-ধনুক চালাতে পারে?
কেউ তাঁকে আশ্বস্ত করেনি– তোমার চেহারা দেখে নয়, তোমার কেরামতি দেখে তোমার গুণ বিচার হবে। তাঁর নিজেরও সে কথা মাথায় আসেনি।
তাই তিনি ছাপোষা এক সুপুরুষ খুঁজতে বেরলেন। খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়লেন সেকালের মহীংসকরট্ঠ (অন্ধ্র) রাজ্যে। এখানের তাঁতি পাড়ায় লম্বা-চওড়া, বলশালী এক যুবক তাঁতির দেখা পেলেন। নামটিও তার চেহারার সঙ্গে মানানসই– ভীমসেন।
বোধিসত্ত্ব বললেন, ভাই ভীম, তুমি এত সুকান্তি, তাঁত বুনে সময় কাটাচ্ছ কেন?
ভীম বলল, কী করব, আমি যে আর কিছু জানি না।
অভিনয় তো করতে পারবে? জম্বুদ্বীপের সেরা ধনুর্ধরের ভূমিকায় তোমাকে অভিনয় করতে হবে, মূল কাজটা করব আমি।
বোধিসত্ত্বের পরিকল্পনা শুনে রাজি হয়ে গেল ভীমসেন। বোধিসত্ত্ব তাকে বারাণসীর রাজসভায় নিয়ে এলেন, মহারাজ ব্রহ্মদত্তকে প্রণাম করে দু’জনে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। রাজা বললেন, কী চাও?
ভীমসেন শিরদাঁড়া সোজা করে বললেন, মহারাজের জয় হোক। জম্বুদ্বীপের সেরা ধনুর্ধর আমি। মহারাজের সেবা করার সুযোপ পেলে কৃতার্থ হই।
–কত বেতন আশা করো?
–আজ্ঞে, প্রতি পনের দিনে সহস্র মুদ্রা।
–তোমার সঙ্গে এ কে?
–এ আমার ব্যক্তিগত ভৃত্য।
–বেশ, তোমায় নিযুক্ত করা গেল।
ভীমসেন খাস রাজকর্মচারী হল। বোধিসত্ত্ব তার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন।
পড়ুন নব জাতক-এর আগের পর্ব: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
কিছুদিনের মধ্যে ভীমসেনের সামনে বড় পরীক্ষা এসে উপস্থিত। রাজার কাছে খবর এল, বন থেকে এক বাঘ সন্নিহিত গ্রামে এসে কয়েকটি মানুষ মেরেছে, সেখানের গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করার সাহস পাচ্ছে না। রাজা ভীমসেনকে ডেকে পাঠালেন, ওহে বাঘটার একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
ভীমসেন এসে জানাল বোধিসত্ত্বকে। তিনি বললেন, সকল গ্রামবাসীর সামনে আমি তীর দিয়ে বাঘ মারলে সব জানাজানি হয়ে যাবে। অন্য কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
তাঁর বুদ্ধি অনুসারে ভীমসেন গ্রামবাসীদের জড়ো করল। তাদের সবার হাতে মোটা মোটা লাঠি, চোখে বাঘের প্রতি প্রতিহিংসার আগুন। তাদের সঙ্গে নিয়ে বাঘের আস্তানার কাছাকাছি গিয়ে সবাই মিলে মহা শোরগোল শুরু করল! বিরক্ত বাঘ এক হুংকার ছেড়ে গুহা থেকে বেরিয়ে আসতেই ভীমসেন দৌড়ে দূরের এক ঝোপে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। কয়েক শ’ লোকের লাঠিপেটায় বাঘটা মারা পড়ল।
বোধিসত্ত্ব যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলেন, বাঘ মরেছে নিশ্চিত হতেই ভীমসেন গাছের এক সরু লতা ছিঁড়ে হাতে দোলাতে দোলাতে ঝোপ থেকে তর্জন করতে করতে বেরিয়ে এল, কে বাঘ মারল শুনি? আমি বাঁধব বলে লতা আনতে ঝোপে গেছি, এর মাঝে মেরে ফেললে?
গ্রামবাসীরা অবাক চোখে একবার ভীমসেনের মুখ আর একবার তার হাতের লিকলিকে লতার দিকে তাকায়। ভীমসেন ওদিকে বলে চলে, যাহ্ মহারাজের কাছে আর জ্যান্ত বাঘ নিয়ে যাওয়া হল না!
আপ্লুত গ্রামবাসীরা তাকে নানা উপহার দিল। রাজা দিলেন দু’-হাত ভরা ধনরত্ন।
একই রকম বুদ্ধি প্রয়োগে কিছুদিন পর ভীমসেন ঘায়েল করল রাজপথে উপদ্রব করা এক বুনো মোষকেও। রাজার কাছ থেকে আরও পুরস্কার মিলল।
ভীমসেনের মাথা গেল ঘুরে। সে বোধিসত্ত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে লাগল। বলল, তোমাকে আর আমার কী দরকার?
দরকার যে কীসে, তা মালুম হল কিছুদিনের মধ্যেই। শত্রুদেশের রাজা অকস্মাৎ বারাণসী নগর অবরোধ করে খবর পাঠালেন, আত্মসমর্পণ করো। বারাণসীরাজ সৈন্য সাজিয়ে ভীমসেনকে আদেশ দিলেন, তুমি নেতৃত্ব দাও।
ভয়ে ফ্যাকাসে ভীমসেন এসে বোধিসত্ত্বের হাতদু’টি ধরে বলল, এখন উপায়?
মুচকি হেসে সামনের হাতির পিঠে ভীমসেনকে বসিয়ে বোধিসত্ত্ব তার পেছনে বসলেন। পেছনে আসতে থাকল সেনাবাহিনী। যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে ভয়ে আধমরা ভীমসেনকে হাতির পিঠ থেকে নামিয়ে বোধিসত্ত্ব বললেন, ঘরে ফিরে যাও, তুমি এত কাঁপছ আমার অসুবিধে হচ্ছে।
তারপর হাতির পিঠ থেকে বীরদর্পে হুংকার দিয়ে তিনি সেনা নিয়ে এগিয়ে চললেন; মনে মনে বললেন, কুঁজো বামন, আজ তোমার দিন।
সত্যিই তাঁর কুশলী নেতৃত্বে এবং ধনুর্বিদ্যার পরাক্রমে শত্রু শিবির অল্প সময় পরেই ছত্রভঙ্গ হল। আক্রমণকারী রাজাকে বন্দি করে নিয়ে এলেন বারাণসীরাজের কাছে। ব্রহ্মদত্ত কৃতজ্ঞতায় তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, তোমার সব কথাই আমি অবগত হয়েছি। তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য।
সমগ্র জম্বুদ্বীপে ‘চুল্ল ধনুর্গ্রহ পণ্ডিত’-এর জয়গাথা ছড়িয়ে পড়ল।
ঋণ: ভীমসেন জাতক