সুর এমনই অনুঘটক স্মৃতির, যা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। সেই স্মৃতি সততই বেদনার, কারণ সুসময়ের ভেতরেও সেখানে ডিপার্চার ঘাপটি মেরে আছে, হাঁটু মুড়ে বসে থাকা বিষণ্ণ সেই লোকটার মতো, যাকে ঘিরে ব্যস্ত শহর আপনিই বয়ে যায়। ইন্টারলিউড, প্রিলিউডেও তাই লুকিয়ে থাকে কত অব্যক্ত আবির, ভূতুড়ে বাড়ির মতো অজস্র দিনরাত। ঠিক যেভাবে ‘না জানে কিঁউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগি কে সাথ’ শুনলে অমল পালেকর-বিদ্যা সিনহার অব্যবহিত ছবি ভেসে ওঠে।
১৮.
‘ও শাম কুছ আজিব থি, ইয়ে শাম ভি আজিব হ্যায়’ শুনে আনমনা হয়ে যেত পাড়ার লোফার! ‘আপনজন’-এর রবি-ছেনোদের মতোই। ‘যদুবংশ’-র সেই ভবিষ্যৎহীন, হিংস্রতা পোষা তরুণরাও ঠেকে বসে ‘গাইড’-এর গান শুনেছিল তাই।
গান, সিনেমার গণস্মৃতি নির্মাণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জনপ্রিয় সিনেমার মন্ত্রগুপ্তি, প্রাণভোমরা হয়ে থেকেছে মেলডির জাদুঘর। তাই ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’ শুনে উত্তুরে চিলেকোঠায় কিশোরীর মন বসেনি পড়ায়। গ্রীষ্মের দাবদাহ পেরিয়ে আসা, গা-ধোয়া ধূপধুনোর আলতো সন্ধেবেলা, পাখার ঘটাং ঘটাং শব্দ পেরিয়ে, সদ্য আগন্তুক টেলিভিশনকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে দূরের পাড়ার মাইক থেকে ভেসে আসা ‘ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হাম’। জরুরি অবস্থার ছটফটে সময়ে বাড়ি না-ফেরা ছেলেমেয়ের জন্য উৎকণ্ঠায় মশগুল বাবা-মায়ের কানে এসেছে পাশের বাড়ির রেডিও থেকে উড়ে আসা ‘জিন্দেগি কে সফর মে গুজর যাতে হ্যায় জো মাকাম, ও ফির নেহি আতে…’। বেকার ছেলে হয়তো রোয়াকে বসে সন্ধের শেষতম সিগারেটে টান দিতে দিতে শুনেছে, ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা’।
হোটেলের আলো-আঁধারিতে খুন হওয়া স্যামসনদের কথা গানে বলেছিলেন অঞ্জন দত্ত। স্যামসনের স্যাক্সোফোন মদ্যপ কানে পৌঁছত না। পার্ক স্ট্রিট ও মধ্য কলকাতার বহু পানশালায় তখন জ্যাজ বাজে, রক অ্যান্ড রোল কিঞ্চিৎ অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। ক্যাবারে-তে তখন কলকাতা জমজমাট। কিন্তু একইসঙ্গে রয়েছে ‘গালিব’-এর মতো বার, যেখানে গজল তৈরি করে আবহ। এমন বহু নেশামহলে কিন্তু আজও বেজে চলে একমনে সেই ‘৬০-‘৭০ কাঁপানো রেট্রো সুর। এমন কিছু কিছু পানশালায় তখনও ‘কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল।
‘ব্লু ফক্স’, ‘ফার্পোজ’, ‘ট্রিংকাস’-এর পাশ্চাত্য জৌলুস ছিল। কবি ডম মোরেজ লোলা ওরফে লরেন সুইনটনকে বলছেন শ্রেষ্ঠ ফ্লোরশো আর্টিস্ট, সেই লোলা থাকতেন ক্রিক লেনে। এইসব ঠেকে তখন প্যাম ক্রেন, ঊষা উত্থুপদের গান শোনা যায়। তরুণ গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা ট্রিংকাসের ব্যান্ডে বাজাচ্ছেন সেই সময়। সেই একই সময়ের আশপাশেই মাইকেলও স্যাক্সোফোন বাজাতেন। মাইকেলকে ক’জন চেনে বলা মুশকিল, এই উত্তর কলকাতা দিয়ে, রামধন মিত্র লেন দিয়ে তাঁকে হেঁটে যেতে দেখেছি শৈশব-কৈশোর জুড়ে। বিদেশি ছিপছিপে চেহারার মাইকেলের নাম আদৌ মাইকেল কি না আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম না। মাইকেল কি স্যাক্সোফোনই বাজাতেন? না কি অঞ্জন দত্তর গানের সূত্রেই তাঁকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম ওরকম? তবে জানি, আগের প্রজন্মের অনেকেই মাইকেলকে বাজাতে শুনেছে বিবিধ হোটেল-রেস্তোরাঁ ও মাচায়, অনুষ্ঠানে ‘পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়, মস্তানা হোতা হ্যায়/ হর খুশি সে হর গম সে বেগানা হোতা হ্যায়’ অথবা ‘আঁচল কে তুঝে ম্যায় লেকে চলু, এক অ্যায়সে গগন কে তলে’। মাইকেলকে আমরা যেন সেভাবেই চিনেছি।
জেনেছি, সেসব পানের আখড়ায় আরব্য রজনী থেকে উঠে আসা নাচের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে না থেকে, বরং নির্লিপ্ত পুরুষ-কণ্ঠে ‘ইয়ে শাম মস্তানি, মদহোঁশ কিয়ে যায়ে’-তে বুঁদ হয়ে উঠেছে অনেকেই। যে কোনও করুণ রসের দৃশ্যেই বলিউডি মদিরালয়েও তাই পুরুষ গায়কদের বেদনাতুর সুরের ভিড় হয়েছে বারবার। নয়তো ‘শ্রী চারশোবিশ’-এর সেই সম্মিলিত কার্নিভালের ‘মুড় মুড়কে না দেখ’-এর মতো অভূতপূর্ব আনন্দের যৌথখামার তৈরি হয়েছে। মিস শেফালিদের জীবনকাহিনি থেকেছে আড়ালেই, বরং কুহকিনী হয়ে ওঠা বার-নর্তকীদের আমরা সিনেমার দৃশ্যে পেয়েছি হয় রহস্য, নয় আবেদন, নয় চক্রান্তের চুম্বক হিসেবে।
শুধুই কি শরাবি ব্যাপারস্যাপার? তা নয় মোটেও। বাড়ি বদলের স্মৃতি, দীর্ঘদিনের ভাড়াবাড়ির গঞ্জনা ছেড়ে, একই সঙ্গে একপাড়া আদর ছেড়ে চলে যাওয়ার স্মৃতিও তো অমলিন থেকেছে এমন স্মৃতিতে, “সেই সেই সময় ‘শোর’-এর গান খুব হিট করেছিল, পাড়ার অমুকদা ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল মনে আছে, ‘কুছ পা কর খো-না হ্যায়, কুছ খো কর পা-না হ্যায়/ জীবন কা মতলব তো আনা অউর যানা হ্যায়…’ গেয়ে!” বাসে করে কোনও চেনা ঠিকানায় যাওয়ার নিত্যনৈমিত্তিকতায় কি কখনও বেজে ওঠেনি, ‘ইয়ে দিন কেয়া আয়ে, লাগে ফুল হাসনে, দেখো বাসন্তি বাসন্তি’?
সুর এমনই অনুঘটক স্মৃতির, যা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। সেই স্মৃতি সততই বেদনার, কারণ সুসময়ের ভেতরেও সেখানে ডিপার্চার ঘাপটি মেরে আছে, হাঁটু মুড়ে বসে থাকা বিষণ্ণ সেই লোকটার মতো, যাকে ঘিরে ব্যস্ত শহর আপনিই বয়ে যায়। ইন্টারলিউড, প্রিলিউডেও তাই লুকিয়ে থাকে কত অব্যক্ত আবির, ভূতুড়ে বাড়ির মতো অজস্র দিনরাত। ঠিক যেভাবে ‘না জানে কিঁউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগি কে সাথ’ শুনলে অমল পালেকর-বিদ্যা সিনহার অব্যবহিত ছবি ভেসে ওঠে, তেমনই কত ক্লাসরুমের এলোমেলো দুপুর, অফিসফেরতা ক্লান্ত বিকেলও জুড়ে যায় তার সঙ্গে। ‘এক আজনবি হাসিনা সে’ শোনার সঙ্গে কত পাড়ার জলসার জন্মান্তরের স্মৃতি জেগে থাকে, ‘রিমঝিম গিরে সাওয়ান, সুলগ সুলগ যায়ে মন’-এর সঙ্গে অজস্র নিষ্পাপ নিষিদ্ধ আবহ জড়িয়ে যায়। রাজেশ খান্নার নাম উচ্চারণে সিনেমার নামের চেয়ে বেশি ফিরে আসে অন্তরে লালিত গুনগুন সেইসব সুর। ‘লাগ যা গলে’-র সুরে লতা মঙ্গেশকরের পাশাপাশি কি ভেসে আসে না ‘ওহ কৌন থি’-র সাধনার অভিনয়ের প্রতিটি বাঁক? প্রতিটি বায়োস্কোপ সফরে জেগেছিল মহম্মদ রফি, কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, মুকেশ, তালাত মাহমুদরা।
‘রিমেমব্রেন্স অফ থিংস পাস্ট’, মার্সেল প্রুস্তের এই উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গিলেস দেলুজ স্মৃতিকে দেখতে চেয়েছিলেন এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে গৌণ উপাদান হিসেবে, বরং শিল্পের চিহ্ন বা ‘সাইন’ আবিষ্কারে কতটা জোর দিচ্ছেন প্রুস্ত, তা ছিল দেলুজের ভাবনার মূল সূত্র। আমরা সেইসব সারেগামা পেরিয়ে যদি ভাবি, স্মৃতিকে পেরিয়ে গিয়েও সময়কে চেনা যায়, হয়তো সেখানে চিহ্ন হিসেবে আমরা পেয়ে যাব গানকেই। গান এখনও জীবিত, তাই সেই সময়ে না বেঁচেও, তার সূত্রেই, এক অদৃশ্য সময়যানে সিনেমাহলের স্মৃতি বুকে জমিয়ে রাখা যায় না কি, অদৃশ্য টিকিটের মতো?
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল
জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।