মৈথিলি রাও লিখেছিলেন, জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয় নারীর বোঝাপড়া অবিরত ভালবাসা-ঘৃণার টানাপোড়েনের। ভারতীয় চলচ্চিত্র বারবার তাকে করে তুলেছে ভোগ্যবস্তু। ইমেজে ইমেজে ‘এরোটিসাইজড কমোডিটি’ করে তোলার ছকে তাকে ফেলা হয়েছে সযত্নে। তবে, এই প্রকল্পের জন্ম কিঞ্চিৎ পরের দিকে। প্রাথমিকভাবে সেই ‘অচ্ছুৎ কন্যা’-র স্পর্ধিত প্রেমিক থেকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র মাতৃকল্প থেকে ‘পাকিজা’-র যন্ত্রণাদীর্ণ, অথচ আগুনের মতো শাণিত নারীরা জনপ্রিয় সিনেমার অঙ্গনে ছিল।
১৯.
‘প্লেন প্লেন প্লেন, পাইলট প্লেন/ প্লেন থেকে নেমে এল সুচিত্রা সেন’– প্রায় খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া কথার প্যাঁচ। সুচিত্রা সেন তাঁর নাম ছাড়িয়ে আইকন হয়ে উঠেছিলেন, এবং আকস্মিক কুয়াশা জমিয়ে অন্তরিনও হয়েছিলেন, বাঙালির একরাশ কল্পনার মৌতাত জুগিয়ে। নায়কনির্ভর এই দেশে নায়িকারা সহযোগী হয়ে থেকেছে ঠিকই, কিন্তু মহাকাব্যের নায়িকা যেভাবে চোরাগোপ্তা কথনের মধ্যে দিয়ে গোষ্ঠীর অচেতনে থেকে গেছে, বড় হয়ে উঠেছে, পর্দার নায়িকারাও আদতে সেভাবেই মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দৃপ্ত থেকেছেন। দেবিকা রাণীরা দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন বলেই হয়তো নার্গিস, মধুবালা, ওয়াহিদা রহমান, রেখা, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, মাধুরী দীক্ষিত-রা কেবল পুতুল-আখ্যানের চরিত্র হননি। ট্র্যাজেডিতে, শৌর্য ও তীক্ষ্ণ আদর্শবোধে, চাহনিতে, ঋজুতায়, প্রেম-বিরহ-যাচনায়, অসূয়া-অবিশ্বাসে, কখনও অটল অপেক্ষায় তাঁরা দর্শকমানসকে রোমহর্ষক কাহিনির খল নারীদের মতোই মোহিত করে রেখেছিলেন। তার জন্য তাঁদের চিরাচরিত ভারতীয় অপ্সরাসুলভ ছলনার খেলা খেলতে হয়নি। তাঁরা গৃহস্থালির অথবা রূপকথার সহজ গল্পের মানুষী চরিত্র হয়ে এসেছেন, কিন্তু কী এক নিষেধ তাঁদের ঘিরে তৈরি হয়েছিল, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রে নারীদের নানাবিধ অবমূল্যায়নের বিপ্রতীপে রাতের তেপান্তরের অলৌকিক বাঁশির মতো, নিশির ডাকের মতো জেগে ছিল। শিহরন জাগানো প্রতিরোধ হয়ে, দুর্গের মতো।
কিন্তু নারীদের চোখে নায়িকারা কি তাই ছিল? মৈথিলি রাও লিখেছিলেন, জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয় নারীর বোঝাপড়া অবিরত ভালবাসা-ঘৃণার টানাপোড়েনের। ভারতীয় চলচ্চিত্র বারবার তাকে করে তুলেছে ভোগ্যবস্তু। ইমেজে ইমেজে ‘এরোটিসাইজড কমোডিটি’ করে তোলার ছকে তাকে ফেলা হয়েছে সযত্নে। তবে, এই প্রকল্পের জন্ম কিঞ্চিৎ পরের দিকে। প্রাথমিকভাবে সেই ‘অচ্ছুৎ কন্যা’-র স্পর্ধিত প্রেমিক থেকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র মাতৃকল্প থেকে ‘পাকিজা’-র যন্ত্রণাদীর্ণ, অথচ আগুনের মতো শাণিত নারীরা জনপ্রিয় সিনেমার অঙ্গনে ছিল। অন্যদিকে, বলিউডের এবং জনপ্রিয় ভারতীয় ছবির পৌরাণিকতার কারখানা গড়ে উঠেছে নায়ক নির্মাণে। আদর্শ মায়ের বদ ছেলে হোক বা বদরাগী প্যাট্রিয়ার্কের সামনে ঋজু হওয়া, চাবুক খাওয়া নায়ক, একান্ত আশিক থেকে দিওয়ানা ব্যর্থ প্রেমিক, ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে শ্রমজীবীর ধ্রুবতারা, খাকি উর্দির বিদ্রোহী থেকে অ্যান্টি হিরো– বিবিধ ঢেউয়ের সমন্বয় যেখানে নায়কোচিত উত্থানে জড়ো হয়েছিল, সেখানে নায়িকারা, ব্যতিক্রম বাদে, বিভিন্ন সময় কি একমুখী হয়ে উঠল? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সহজ হয়ে উঠবে না, হাজারো অন্তঃসলিলা স্রোত এড়িয়ে।
যতই বেশি পারিশ্রমিক নায়করা নিয়ে যান না কেন, এবং চিত্রনাট্যের সিংহভাগ ভালো সংলাপ যতই তাঁদের প্রতি নিবেদিত থাকুক না কেন, নায়িকারা সবসময়ই বম্বে ইন্ডাস্ট্রির উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ, খেয়াল করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সত্যিই তো, নলিনী জয়ন্ত, মীনা কুমারী বা বৈজয়ন্তীমালা ছাড়া দিলীপকুমার, নার্গিস ছাড়া রাজ কাপুর, নূতন, সাধনা, মধুবালা ছাড়া দেব আনন্দ, ওয়াহিদা রহমান ছাড়া গুরু দত্ত ভাবা যায়? এর সঙ্গে জুড়েছিল সংগীতের রত্নখচিত ভাণ্ডার। সুরাইয়া জামাল শেখের মতো নায়িকা-গায়িকার দাপট পরাধীন থেকে স্বাধীন ভারতে যেভাবে এসে পৌঁছেছিল, যেভাবে খুরশিদ-নূরজাহানের ছলনাময়ী কণ্ঠ থেকে রাজকুমারী, গীতা দত্তদের দাপট ভারতীয় চিত্র-সংগীতের মোড় ঘুরিয়েছিল, যেভাবে লতা মঙ্গেশকরের বিষাদমধুর গায়নে ধরা পড়েছিল ভারতীয় নারীর চিরন্তন হাহাকার অসীম তীব্রতায়, তাকে কে এড়িয়ে যাবে? গীতা দত্তর জীবনের নানামাত্রিক মোচড়ও কি এসে জড়ো হয়নি, যখন তাঁর অপার্থিব স্বর ধাক্কা দিয়েছে ‘বাবুজি ধীরে চল না’-র অনতিক্রম্য উচ্চতায়? কাইফি আজমি, সাহির লুধিয়ানভি, মজরু সুলতানপুরীদের মতো পুরুষ কবিদের গীতিকাব্যের ছোঁয়াচ জীবন্ত হয়েছে তো সেইসব অবারিত মহিলা কণ্ঠের বিস্ফারে! বাংলায় যেমন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তৈরি করছিলেন এক শান্ত অথচ দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্য, উৎপলা সেনরা বয়ে আনছিলেন অন্য স্বর, তেমনই ব্যাপক বলিউডি রাজত্বের পুরুষ শাসনে গোপন চিড়গুলো ধরিয়েছে সেই জীবন-ছাড়ানো কণ্ঠরাই।
এইসব ঝিলিকের পাশাপাশি মনে রাখার, সেই ১৯৫০ সালে, স্বাধীনতার পরপর প্রহ্লাদ দত্ত মধুবালাকে কেন্দ্রে রেখে যে ছবি বানালেন, তারও নাম ছিল ‘মধুবালা’, যেখানে এক সম্ভ্রান্ত নারী খুঁজে বেড়াচ্ছে তার আদত প্রেমিককে। মধুবালার উপস্থিতি যতটা বিষণ্ণ, ততটাই অনন্ত আলো সেখানে ঝলমলিয়ে ওঠে। নূতন বা সাধনা তুলনায় উজ্জ্বল, কিন্তু করুণ রস মধুবালাকে যে রহস্যের ব্যাপ্তি দিয়েছে, তা অন্য কেউ সেভাবে পেল কি? পাঁচ-ছয়ের দশকে যে বাঙালি সুচিত্রা সেনের এনিগমা-য় সম্মোহিত, তাদের কাছেও মধুবালা বারবার হয়ে উঠেছে দূরের তারা, যা আকাশের দিকে আড়চোখে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে, কিন্তু সরাসরি তার চোখে চোখ রাখলে মালিন্যের মধ্যেও তা অসম্ভবের ছন্দকে স্পন্দিত করবে। পুরুষরা নায়িকাদের প্রতি মোহাবিষ্ট হবে, আর মহিলাদের চোখে ঝিলমিল লাগাবে নায়করা- এই সনাতন সমীকরণকে উপেক্ষা করেই স্কুলপড়ুয়া মেয়েও নাকি তখন দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে– ‘কী সুন্দর!’
ষাটের শেষ, সত্তরের শুরু থেকে সময় বদলাচ্ছিল। ১৯৭১-এর ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’-এই যেমন, কিশোরকুমার-লতা মঙ্গেশকরের ‘কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে’ বা ‘ফুলো কা তারকা’-র ইনোসেন্সকে ধ্বংস করল সমান্তরালে থাকা আশা ভোঁসলে আর ঊষা উত্থুপের কণ্ঠ। তাঁদের কণ্ঠেই জ্বলে উঠল এক অন্য মশাল, যার নাম জিনাত আমন। সেই হিপি সভ্যতার সময় জিনাতের সেই নেশাতুর চরিত্রে যতই বিকৃতি থাক, আর মাদকবিরোধী নৈতিকতা আড়াল থেকে যতই উঁকি মারুক, ‘দম মারো দম’ সম্পূর্ণ হত না জিনাত ছাড়া। হিন্দি ছবির নিষেধাজ্ঞার বেড়া বাংলার শহর-মফসসলে একযোগে আরও মজবুত, এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ল, ওই তীব্র চৌম্বকীয় টানে। আবার সেই ছয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘হারকিউলিস’, ‘টারজান কামস টু দিল্লি’, ‘টারজান অ্যান্ড কিং কং’, ‘ডাকু মঙ্গল সিং’-এর মতো প্রায় ‘বি মুভি’ ও ‘স্টান্ট ফিল্ম’-এর নায়িকা হয়ে ওঠা মুমতাজ ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘আদমি অউর ইনসান’, ‘রিটা’ থেকে ধীরে ধীরে যৌন আবেদনকে মূল স্রোতের ছবিতে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলেন, কেবলই অভিনয়ের বিশেষ ভঙ্গিতে। ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে’-র আহ্বান তাঁকে অচিরেই করে তুলল ‘সেক্স সিম্বল’। সেই সাতের দশকে, যখন নৈরাজ্যই স্কুল-কলেজের রুটিন, বোমাবাজির ভয় যখনতখন, তখনও মুমতাজের ছবি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখার অপরাধে সাসপেন্ড হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক নিয়মনিষ্ঠ, অথচ সেই সময় প্রায় অচল হয়ে থাকা স্কুলের ছাত্র, ‘রাস্টিকেট’ করার হুমকিসমেত।
এর কিছু আগেই খোদ সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর বিকিনি-বিপ্লব ঘটিয়েছেন ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এ, নকশাল অভ্যুত্থান শুরুর বছরেই। এসেছেন ‘ফিল্মফেয়ার’-এর প্রচ্ছদেও, ওই একই অবতারে। জিনাত আমন, পরভিন বাবিরা যে উত্তরাধিকার বহন করলেন তারপর সাত-আটের দশক জুড়ে। সেই শর্মিলা ঠাকুরের ছবিওয়ালা ফিল্মফেয়ারের প্রচ্ছদ পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাত থেকে ছিঁড়ে বাড়িতে এনে ঘরে লেনিনের ছবির নিচে টাঙাতে গিয়ে কমিউনিস্ট বাবার গলাধাক্কা খেয়েছিল এক তরুণ। রাষ্ট্র যদিও তখন ওপরের ছবিটিকে বেশি সন্দেহের চোখে দেখে। তরুণটি তাও প্রচ্ছদটি খোয়াবে না বলে তারই প্রেমিকাকে লুকিয়ে রাখতে বলেছিল সেটি। মেয়েটি মাঝেমধ্যেই আনমনা হয়ে গোপনে সেই প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকত। লজ্জায় না অহংকারে, কে জানে!
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল