বুড়ো বললে, গ্রামের রাস্তায় এত কাঁটা কেন জানো, বামুন ঠাকুর? কখন রাজকর্মচারী বা দস্যু এসে অরক্ষিত বাড়ির শেষ সম্বলটুকুও ভেঙে নিয়ে যাবে সে-ই ভয়ে অসহায় গ্রামবাসীরা কাঁটা গাছ এনে নিজের নিজের বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে রাখে। আগে যখন সপরিবার বাড়িতে থাকত তখন যেখানে ফুলগাছ লাগাত, এখন সেখানে কাঁটার ঝাড়। তুমিই বল, আমাদের রাজা ছাড়া আর কাকে এর জন্য দায়ী করব?
১৯.
অনাচার আর মন্ত্রী-সান্ত্রীদের চুরি-জোচ্চুরি শুধু একালের কথা নয়। সেকালেও ছিল বিলক্ষণ। সে-ই জাতকের কালেও।
যেমন কম্পিলারাজ্য। তার রাজধানী উত্তর পঞ্চাল নগর। রাজার নাম পঞ্চাল। তিনি নিজে লোভী। শাসক হিসেবেও অকৃতকার্য। সেই সুযোগে রাজসভার অমাত্যরা যথেচ্ছাচার শুরু করলেন। দেশবাসীদের কাছ থেকে নানা ছুতোয় কর আদায় করতেন, জোরজুলুম চালাতেন, বিরোধিতা করলে জুটত অত্যাচার আর অসম্মান। এই নৈরাজ্যে চোর-ডাকাতদের পোয়াবারো! অতিষ্ঠ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে লাগল। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা গেল ভিনদেশে। গরিব মানুষ দোর বন্ধ করে বনে গিয়ে বাস করতে লাগল, মাঝে মাঝে মনের টানে ফিরে এসে একবার করে নিজেদের জীর্ণ ভিটে মাটি দেখে যেত। গ্রামের পর গ্রাম উজার!
একদিন রাজার কী খেয়াল হল, রাজপুরোহিতকে তিনি বললেন, চলুন, আজ ছদ্মবেশে কয়েকটি গ্রাম ঘুরে আসি। দেখি প্রজারা কেমন সুখে আছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন নব জাতক-এর আগের পর্ব: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভোরবেলা এক বৃদ্ধ বন থেকে চুপিচুপি এসে তার জীর্ণ কুঁড়েতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় সদর দোরের সুমুখে তার পায়ে এক তীক্ষ্ণ কাঁটা বিঁধল। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে রক্তাক্ত পা থেকে কাঁটাটা টেনে বের করতে করতে সে বিড়বিড় করতে লাগল, আমাদের হতচ্ছাড়া রাজা যেন যুদ্ধে শরবিদ্ধ হয়ে তিলতিল করে মরে।
রাজপুরোহিত ঢোক গিলে বললেন, এ কেমন কথা তোমার, বুড়ো? চোখের মাথা খেয়ে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়েছ আর শাপ দিচ্ছ আমাদের রাজাকে!
বুড়ো বললে, গ্রামের রাস্তায় এত কাঁটা কেন জানো, বামুন ঠাকুর? কখন রাজকর্মচারী বা দস্যু এসে অরক্ষিত বাড়ির শেষ সম্বলটুকুও ভেঙে নিয়ে যাবে সে-ই ভয়ে অসহায় গ্রামবাসীরা কাঁটা গাছ এনে নিজের নিজের বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে রাখে। আগে যখন সপরিবার বাড়িতে থাকত তখন যেখানে ফুলগাছ লাগাত, এখন সেখানে কাঁটার ঝাড়। তুমিই বলো, আমাদের রাজা ছাড়া আর কাকে এর জন্য দায়ী করব?
পুরোহিত পঞ্চালের দিকে তাকালেন। রাজা শুকনো মুখে অন্য পথ ধরলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বৃদ্ধার ব্যাখ্যা যেন সমাজবিজ্ঞানীকেও হার মানায়। তার কথা শুনে পুরোহিতের হাসি শুকিয়ে গেল। তিনি তাকালেন রাজামশাইয়ের দিকে। ছদ্মবেশে তাঁকে তো কেউ চিনছে না। তবু মনে হচ্ছে তিনি যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যেতে যেতে দেখা হল এক বৃদ্ধার সঙ্গে। গাছ থেকে ফল পাড়তে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে গেছে ঝোপের মধ্যে, তার পোঁটলা করা ফলপাকুড়, শাকপাতা সব মাটিতে গড়াগড়ি। কোনওরকমে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে গজগজ করে, আমাদের কসাই রাজাটা যে কবে যমের বাড়ি যাবে?
রাজপুরোহিত হাসতে হাসতে বললেন, বুড়িমা, বয়সকালে তোমার বুদ্ধিনাশ হয়েছে। ভাঙা কোমর আর ক্ষয়ে যাওয়া দুটো হাঁটু নিয়ে কোন বুদ্ধিতে তুমি ফল পাড়তে গাছে উঠেছিলে? এখন আবার রাজাকে দুষছ!
–উঠেছি কী আর সাধে, সে তো ওই হতভাগা রাজাটার জন্যই!
বিধবা বৃদ্ধার দুই বিবাহযোগ্যা কন্যা। অরাজক রাজ্যে রাজকর্মচারী আর তাদের প্রশ্রয়পুষ্ট দুষ্কৃতিরা পথঘাট এতই বিপদসংকুল করে রেখেছে যে মা তার দুই মেয়েকে রাস্তায় বের করতে ভরসা পায় না। তিন গরিব পেট চালানোর জন্য নিজেকেই তাই অশক্ত শরীরে বেরতে হয়। আবার অতিরিক্ত কর এবং কর্মসংস্থানের অভাব রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাকে এতই সংকটজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে যে যুবকেরা ভরণ-পোষণের ভরসা দিয়ে কোনও গরিব মেয়েকে বিয়ে করতেও পারছে না।
বৃদ্ধার ব্যাখ্যা যেন সমাজবিজ্ঞানীকেও হার মানায়। তার কথা শুনে পুরোহিতের হাসি শুকিয়ে গেল। তিনি তাকালেন রাজামশাইয়ের দিকে। ছদ্মবেশে তাঁকে তো কেউ চিনছে না। তবু মনে হচ্ছে তিনি যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইছেন।
রাজধানীতে ফেরার পথে তাঁরা দেখলেন, এক গাভি পাগলের মতো দৌড়চ্ছে আর কী এক আক্রোশে যাকে সামনে পাচ্ছে গুঁতোতে যাচ্ছে! একদল কিশোর তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কৌতূহল দেখানোয় পুরোহিতকে তারা বলল, আমাদের রাজা যতদিন না নির্বংশ হবে ততদিন এমন কত গরু উন্মাদ হয়ে যাবে।
কেন? কেন?
জানা গেল, রাজস্ব সংগ্রহকারীদের তলোয়ারের শৌখিন খাপ তৈরির জন্য চকরা-বকরা বাছুরের নরম চামড়া লাগে। নিরুপায় মা গরু তাই শোকে পাগল।
রাজা বুঝলেন, রাজ্যের সব অব্যবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, তাঁর অকর্মণ্যতাই দায়ী।
তিনি চাপা স্বরে বললেন, পুরোহিত মশাই, চলুন রাজধানী ফিরে যাই। দেখি আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করা যায় কি না।
ঋণ: গন্ডতিন্দু জাতক
…………………………………………………..নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব………………………………………………..
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?
শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর।