Robbar

এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 19, 2024 7:05 pm
  • Updated:February 19, 2024 7:05 pm  

‘রুশকথা’– রাশিয়ার জার্নাল রাশিয়ার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনার খণ্ডচিত্র এবং তারই মধ্য দিয়ে এক অর্থে রাশিয়ার নেপথ্য দর্শনও। মূলত ‘রাশিয়া’ নামে দেশ ও রুশ জাতির অনন্যতা, যুগ যুগ ধরে ভাঙাগড়া, পতন ও অভ্যুদয়ের বিচিত্র কাহিনি, বর্তমান রাশিয়াকে উপলক্ষ্য করে তার অতীত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা। এর মধ্যে কোনও তত্ত্বকথা নেই, ভালোমন্দ বিচারের কোনও প্রশ্ন নেই। রাশিয়া– রাশিয়াই। তাকে গ্রহণ করতে হলে ভালোবাসতে হবে, আর কাউকে ভালোবাসতে গেলে তার ভালোমন্দ সমস্ত কিছু নিয়েই ভালোবাসতে হয়।

অরুণ সোম

১.

রাশিয়ার জার্নাল লিখতে শুরু করেছিলাম অনেক বছর আগে। মাঝে লেখায় ভাটা পড়েছিল। কিন্তু এই লেখাটা যে লিখবই, তা নিশ্চিত ছিল। ’৯৬-এ মস্কো থেকে ফিরে এসেছিলাম প্রায় কিছু না নিয়ে। ওই দেশে ২৩ বছর কাটানোর পর ফিরে আসা বেদনার ছিল। তাই জার্নাল লেখা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ‘রুশকথা’– রাশিয়ার জার্নাল রাশিয়ার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনার খণ্ডচিত্র এবং তারই মধ্য দিয়ে, এক অর্থে রাশিয়ার নেপথ্য দর্শনও। মূলত ‘রাশিয়া’ নামে দেশ ও রুশ জাতির অনন্যতা, যুগ যুগ ধরে ভাঙা-গড়া, পতন ও অভ্যুদয়ের বিচিত্র কাহিনি, বর্তমান রাশিয়াকে উপলক্ষ করে তার অতীত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা। এর মধ্যে কোনও তত্ত্বকথা নেই, ভালো-মন্দ বিচারের কোনও প্রশ্ন নেই। রাশিয়া– রাশিয়াই। তাকে গ্রহণ করতে হলে ভালোবাসতে হবে, আর কাউকে ভালোবাসতে গেলে তার ভালো-মন্দ সমস্ত কিছু নিয়েই ভালোবাসতে হয়।

ভালোবাসার রসায়নটাও আসলে ভারি জটিল: এর মধ্যে আছে যেমন মুগ্ধতা, আছে মান অভিমান, আছে ঘৃণা– এমনকী, শত্রুতাও। শত্রুভাবেও তার সাধনা করা যায়।

ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা ও সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন

সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার পতনের মধ্যে ভবিষ‌্যতের জন্য বেশ কিছু ভাবনাচিন্তার খোরাক আছে। বিশ্ব ইতিহাসে কার্ল মার্কসের উল্লেখযোগ্য অবদান বা তত্ত্ব যা-ই বলি না কেন, বোধহয় তিনটি: দর্শনে দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত মূল্য এবং সমাজবিজ্ঞানে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব।

এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে; কিন্তু আমাদের মতো আনাড়িদের মনে যে প্রশ্নটি থেকে যায়, তা হল– প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে কি সমস্তরকম দ্বান্দ্বিকতার অবসান ঘটবে? ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’-র অনুরূপ কোনও তত্ত্বই কি তাহলে তখন শেষ সত্য হয়ে দাঁড়াবে? কিন্তু, সেটা বোধহয় কোনও দিক থেকেই হওয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রতিককালে অভিজ্ঞতা থেকেও দেখা যাচ্ছে, একটা বিরোধের অবসান ঘটলে তার জায়গায় আরেকটি বিরোধ এসে জোটে:  ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে!’

মার্ক্‌স দূরদর্শী ছিলেন, কিন্তু সর্বদর্শী হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়– মার্কসের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর বিপ্লবও কোনও শিল্পোন্নত দেশ থেকে না হয়ে আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব‌্যবস্থা-সম্পন্ন রাশিয়া থেকে হল। আবার পরবর্তীকালে কিউবার মতো দেশপ্রেমের যুদ্ধ দিয়ে শুরু করে কোনও কোনও দেশ যে সমাজতন্ত্রের পথে গেছে, তাও আমরা জেনেছি।

মার্কসবাদ থেকে পরবর্তীকালে আরও নতুন নতুন যে সমস্ত তত্ত্ব বা ‘বাদ’-এর উদ্ভাবন ঘটেছিল, সেগুলি আসলে সব পন্থা: কোনওটা লেনিনবাদ, কোনওটা ট্রোৎস্কিপন্থা, কোনওটা স্তালিনবাদ, কোনওটা বা মাওবাদ– অনেকটাই বাইবেল-কুরআন ধর্মগ্রন্থের পরবর্তীকালে রচিত ভাষ্যের মতো।

সমাজতন্ত্রকে জিইয়ে রাখার জন‌্য যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তত্ত্ব মাও জে দং খাড়া করেছিলেন, সেটা দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-ভিত্তিক বলে মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু তার ফলে ভালো কিছু হয়নি। দেখা গেছে, একশ্রেণির ক্ষমতাবান মানুষ তার সুযোগ গ্রহণ করে সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছে। যা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত পেরেস্ত্রৈকা বা পুনর্গঠনের নীতি ঘোষণার মধ্যে– তাতে গোটা ব‌্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ে– এক কালে যারা পার্টির নেতৃস্থানীয় ছিল, তারাই এর সুযোগ গ্রহণ করে বড়লোক হয়ে ওঠে। এসবের কারণে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনই আজ প্রশ্নের মুখে, এক চরম সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।

কমিউনিজম আজ সত্যি সত্যি পরাভূত দেবতা। হালচাল দেখে মানুষের প্রত‌্যয় হয়েছে যে, সকলে সমান হতে পারে না। তা-ই যদি হয়, তাহলে পুঁজিবাদের আদর্শটাই পরখ করে দেখা যাক না কেন? একুশ শতকের মানুষের এটাই তাই একমাত্র ধ‌্যানজ্ঞান। বিশ শতকটা ছিল স্বপ্ন দেখার কাল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে আগে, মনে আছে, ধুয়ো উঠেছিল: ‘তুমি যদি বুদ্ধিমানই হও তাহলে ধনী নও কেন?’ মানুষ তাই মেতে উঠেছিল নতুন এক পরীক্ষায়– না, নতুন বলব কেন, ওটাই তো প্রকৃতির নিয়ম, মানুষের আদিম প্রবৃত্তি– শোষিত শ্রেণি থেকেই একশ্রেণির শোষকের উদ্ভব ঘটবে– অপরকে শোষণ করেই তাকে উঠতে হবে। সে-ই হবে উদ্বৃত্ত মূল্যের স্রষ্টা।

চিনের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান দেং‌ জিয়াও পিং স্লোগান তুলেছিলেন: ‘ধনী হওয়াটা গৌরবের।’ আশ্চর্য! এটাই তো আজকের দিনে সারা দুনিয়ার মানুষের একমাত্র স্লোগান। ‘পৃথিবীতে বড়লোক বলে কেউ থাকবে না’ বা ‘গরিব বলে কেউ থাকবে না’, এই দুটোর যে কোনওটার থেকে ‘সবাই বড়লোক হবে’– এই স্লোগানটাই কি বেশি লোভনীয় নয়? সোভিয়েত ইউনিয়নে পেরেস্ত্রৈকার সময় দেশের সবাই কোটিপতি হবে– এরকম একটা ধুয়োও উঠেছিল।

Blogtrotter Revival - the 70s & 80s: June 2006
পেরেস্ত্রৈকার আগের মস্কো

কোনও কোনও তাত্ত্বিক পুঁজিবাদে নতুন আইডিয়া বা ভাবাদর্শ সঞ্চারের কথাও বলেছেন। কিন্তু পুঁজিবাদের ভাবাদর্শ পুঁজি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কী হতে পারে? পুঁজিবাদের সর্বশেষ নতুন আইডিয়া বিশ্বায়ন, তথা এক নতুনতর অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ।

ধনী হওয়াই যদি আদর্শ হয়, তাহলে তো ধনী শ্রেণির বিরুদ্ধে কোনও সংগ্রামই চলে না। মানুষ তো আর তার উপাস‌্য দেবতার বিরোধিতা করতে পারে না। কিন্তু সকলে যদি সমান নাও হতে পারে (সমান বণ্টনব‌্যবস্থা হলে সেটা কতকটা সম্ভব হলেও হতে পারত), সকলে ধনী হওয়া যে কোনও মতেই সম্ভব নয় মানুষ যখন তা বুঝতে পারবে, একমাত্র তখনই বর্তমানের বদ্ধমূল এই সমাজব‌্যবস্থার পতন ঘটতে পারে– ততদিন মানব জাতিকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে। দ্বান্দ্বিকতার অবসান তো আর তাই বলে ঘটতে পারে না। তাহলে কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে?

Image
পেরেস্ত্রৈকা। মস্কো। ১৯৮৮। ছবি: ক্রিস নিয়েনডেনথাল

এই কলামের অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখাই অবশ‌্য ‘পেরেস্ত্রৈকা’ নামে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রত‌্যক্ষদর্শীর বিবরণ। বড় কষ্ট করে লিখতে হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই চোখের জলে লেখা। কেননা আদর্শহীন দিশাহীন পরিবর্তন বড়ই কষ্টের, বিশেষত পুরনো প্রজন্মের কাছে, যখন তার চোখের সামনে তার আদর্শ জগতের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, যখন তারই কাছের কেউ স্রেফ টিকে থাকার জন‌্য ভোল পাল্টায়, কেউ-বা নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তখন কাল গোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তবে হতাশাই যে এই লেখার শেষবার্তা, তা-ও বোধহয় নয়– একমাত্র এই ভরসাতেই প্রকাশের আয়োজন।