গৌতম বুদ্ধ এই কাহিনি বলার শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, সেই সেরিবা এই জন্মে তাঁর তুতোভাই দেবদত্ত হয়ে জন্মেছে। সে যে বুদ্ধের পিতা শাক্যরাজ শুদ্ধোদনের ভাইপো, না কি তাঁর মাতা মহামায়াদেবীর ভাইপো, তা নিয়ে বৌদ্ধশাস্ত্রে মতভেদ আছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, দেবদত্ত কুটিল, অসৎ এবং বুদ্ধের শত্রু। সে এমন কী, বুদ্ধকে খুন করার চেষ্টাও করে।
২০.
বাসন নেবে গো, বা-আ-সন, পুরনো বাসন বদলে নতুন বা-আ-আ-সন—
অন্ধপুর নগরের রাজপথ দিয়ে এক ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে পড়ল এক শ্রেষ্ঠীগৃহ। নামেই শ্রেষ্ঠী, তাদের তখন নিতান্ত পড়তি দশা। বাড়ির এককোণে থাকে এক ঠাকুমা আর নাতনি। তাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। লোকের বাড়ি কাজ করে কোনওরকমে দু’টি পেট চলে। ফেরিওয়ালার ডাক শুনে বালিকাটি বলল, আম্মা, সেই পুরনো থালাটা একবার দেখাই? যদি কিছু দাম দেয়!
বৃদ্ধা কান্না লুকিয়ে হাসেন, ওই কালিঝুলি মাখা বাসনের আবার দাম!
কিন্তু ততক্ষণে হাত নেড়ে ফেরিওয়ালাকে ডাকা হয়ে গেছে। সে তেলচিটে থালাটা প্রথমে বিরক্তি ভরেই হাতে নিয়েছিল। বুড়ো আঙুল ডলে একটা জায়গার ময়লা একটু তুলতেই তার চোখমুখের চেহারা বদলে গেল। কষ্টিপাথর দিয়ে সামান্য একটু ঘষার পর তার দৃষ্টিতে যেন আগুন। কোনওরকমে নিজের অভিব্যক্তি সামলে নিয়ে নিতান্ত বেজার মুখ করে সে বললে, এ থালার দাম তো কানাকড়িও নয় রে বোন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গৌতম বুদ্ধের শ্রোতারা বুঝেই যায়, এই ফেরিওয়ালা জোচ্চোর। তারা মনে মনে কামনা করে, সেরিবা ফিরে এলেও মেয়েটি যেন থালা বিক্রি না করে; তারা অপেক্ষা করে, সংকটমোচনে সেই জন্মের বোধিসত্ত্ব নিশ্চয়ই হাজির হবেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মেয়েটি ফেরিওয়ালার মুখের দিকে চেয়েছিল। তার মনেও আশার আলো জ্বলে উঠছিল। হঠাৎ সেটা দপ্ করে নিভে গেল। সে বলল, ঠিক বলছেন?
আমি ঠিক বলব না? আমি হলাম সেরিব দেশের সেরা বাসনওয়ালা সেরিবা। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের অবস্থা তো খুবই খারাপ দেখছি, বুড়ি মা। আমি না-হয় আমার গ্যাঁট থেকেই তোমাদের পাঁচ কহাপণ দিচ্ছি। খানিকটা না-হয় ক্ষতিই হল আমার।
বুড়ি কী বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটা বলল, না না থাক। আমরা বেচব না।
দিয়ে দিলে পারতিস, বোন। এমনিতে তো বাজারে এর কোনওই দাম পাবি না।
মেয়েটি তবু রাজি হল না। সেরিবা বলে গেল, আমি শহর ঘুরে আবার ঘণ্টা খানেক পর ফিরে আসছি। দেখো, তোমরা ঠাকুমা-নাতনি মিলে আর একটু ভাবো।
গৌতম বুদ্ধ এই কাহিনি বলার শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, সেই সেরিবা এই জন্মে তাঁর তুতোভাই দেবদত্ত হয়ে জন্মেছে। সে যে বুদ্ধের পিতা শাক্যরাজ শুদ্ধোদনের ভাইপো, না কি তাঁর মাতা মহামায়াদেবীর ভাইপো, তা নিয়ে বৌদ্ধশাস্ত্রে মতভেদ আছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, দেবদত্ত কুটিল, অসৎ এবং বুদ্ধের শত্রু। সে এমনকী, বুদ্ধকে খুন করার চেষ্টাও করে।
সুতরাং, গৌতম বুদ্ধের শ্রোতারা বুঝেই যায়, এই ফেরিওয়ালা জোচ্চোর। তারা মনে মনে কামনা করে, সেরিবা ফিরে এলেও মেয়েটি যেন থালা বিক্রি না করে; তারা অপেক্ষা করে, সংকটমোচনে সেই জন্মের বোধিসত্ত্ব নিশ্চয়ই হাজির হবেন।
ঠিক তা-ই। একটু পরেই সেই পথে হাঁকতে হাঁকতে হাজির আর এক ফেরিওয়ালা– বোধিসত্ত্ব স্বয়ং। সেই জন্মে তাঁর নাম সেরিবান।
ঠাকুমা নাতনিকে বললেন, ডাকিস নে লো, আর লোক হাসাস নে।
মেয়েটি বলল, আগের লোকটার চাউনি যেন কেমন লোভীর মতো। এই লোকটির চেহারায় একটা শান্ত পবিত্রতা আছে।
সেরিবান থালাটি হাতে নিয়ে সেরিবার ঘষে দেওয়া অংশটুকু দেখেই চমকে উঠলেন। তবু নিজের কষ্টিপাথরে ঘষে নিশ্চিত হলেন। তারপর বললেন, এ খাঁটি সোনা। দাম অনেক। এ কেনার মতো অর্থ আমার কাছে নেই।
বৃদ্ধা বললেন, কিন্তু তোমার আগে এক ফেরিওয়ালা যে বলে গেল–
সামান্য হেসে সেরিবান হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দেখো বুড়িমা, বাইরের লোক যদি সন্ধান পেয়ে গিয়ে থাকে, তবে তোমাদের বিপদ। প্রাণেও মরতে পারো। তোমরা যদি আমায় বিশ্বাস করে থালাটা দাও, আমার কাছে যে পাঁচশো কহাপণ মুদ্রা আছে, তার থেকে শুধু আমার পথ খরচ আট কহাপণ রেখে বাকি সবটা তোমাদের দিয়ে রাজধানী যাব। সেখানে বিক্রি করে, আবার তোমাদের বাকি মূল্য দিয়ে যাব। ততদিন আমার এই সব পসরা তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি।
বৃদ্ধা কী বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে মেয়েটি বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বাস করা যায়, তুমি নিয়ে যাও। দেখো, যদি আমাদের দুর্দশা কাটাতে পারো।
সেরিবা-সেরিবানের কাহিনির অনিবার্য এক উপসংহার আছে। লোভী সেরিবা এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে ফিরে এল, হাতের লক্ষ্মী হাতছাড়া হওয়ায় হা-হুতাশ করল, সেরিবানের পিছন ধাওয়া করে ব্যর্থ হল, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব তো বোঝাই যাচ্ছে।
কিন্তু যেটা বোঝা যাচ্ছে না বলে আফসোস হচ্ছে, তা হল বালিকাটির পরিচয়। যার নাম অবধি উল্লেখ করা হল না, সে পরের, পরের জন্মে কী হিসেবে জন্মাল? তার মতো এক মেয়ে, যে গুরুজনদের প্রতি যত্নশীল, ভালো-মন্দ চিনে নেওয়ার স্বচ্ছ দৃষ্টি যার জাগ্রত, চরম দুঃসময়েও যে আশায় বুক বাঁধতে পারে– তার যে বারবার জন্ম নেওয়া দরকার।
…নবজাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?