Robbar

বাঙালির বাজার সফর মানেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 13, 2025 1:58 pm
  • Updated:July 13, 2025 6:54 pm  
21st episode blotting paper by swapnomoy chakraborty

আমাদের স্ত্রীর নাম ‘পরিবার’। কিছু লোক আছে, দেখলেই বুঝি, ওদের স্ত্রীরা ‘মিসেস’, কারওর স্ত্রীরা ‘গিন্নি’। এদের স্ত্রীরা ‘পার্টনার’। এরা ধুঁধুল, ঝিঙের তফাত বোঝে না। পুঁই-পালং-এর ভেদ জানে না। তবে এদের কাছে ঢ‌্যাঁড়শ জাতি নিরাপদ। এদের হাত থেকে ঢ‌্যাঁড়শের সতীত্ব রক্ষা হয়। এরা ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটায় না। ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটানো খরিদ্দারদের স্ত্রীরা সাধারণত ‘গিন্নি’ হয়। এরা লুঙ্গি পরে বাজারে আসে। ঢ‌্যাঁড়শের স্তূপের পাশে বসেই ঢ‌্যাঁড়শের গতরটা হাতের মুঠোয় ভরে, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটিয়ে কচিত্ব পরীক্ষা করে। কিন্তু সতীত্ব তো যায়!

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

২১.

বাজারে বসা বিক্রেতার জন‌্য খরিদ্দার মাত্রই লক্ষ্মী। হাফপ‌্যান্ট পরা খরিদ্দার, শাড়ি পরা, লুঙ্গি পরা– প্রত্যেকেই লক্ষ্মী। আমি লক্ষ্মীদের ভজনা করি। এখন আমি মাছ বেচি, আগে ফল বেচেছি, আনাজপাতি বেচেছি, ফলে ‘লক্ষ্মী’ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। লক্ষ্মী না বলে নারায়ণ বললে অসুবিধা ছিল না। অনেক সময় লক্ষ্মী-নারায়ণ যুগলে আসেন। বোঝা যায়, ওরা ফ্ল‌্যাট-বৈকুণ্ঠে নতুন। মানে নতুন সংসার ধর্ম শুরু করেছে আর কী! হাফপ‌্যান্ট পরা লক্ষ্মী ডাঁই করা সবুজ সবজিগুলোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করছে ‘ওগুলো কী গো?’ ফুলপ‌্যান্ট পরা নারায়ণ বলছে– ‘এটাও চেনো না? পটল পটল। কচি পটল।’ আমি বুঝি, ওরা সব আইটি, আইআইটি। বলি– ‘স‌্যর, পটল নয়, এটার নাম কুঁদরি’।

–কুঁদরি? ও ইয়েস। আমাদের হোস্টেলে রান্না হত।
–এটা কী করে খায়? পটলের মতো ফ্রাই করে?

আমি বলি, রান্না কে করে?

মা লক্ষ্মী বলে, ‘আছে, কুক মাসি আছে। ওই কুক মাসি জানে।’

আরে, আমি তো সবজি বেচি, রেসিপি তো বেচি না। কী করে বেচব? আমি তো জানি না। আমার পরিবার জানে। আমাদের স্ত্রীর নাম ‘পরিবার’। কিছু লোক আছে, দেখলেই বুঝি, ওদের স্ত্রীরা ‘মিসেস’, কারওর স্ত্রীরা ‘গিন্নি’। এদের স্ত্রীরা ‘পার্টনার’।

এরা ধুঁধুল, ঝিঙের তফাত বোঝে না। পুঁই-পালংয়ের ভেদ জানে না। তবে এদের কাছে ঢ‌্যাঁড়শ জাতি নিরাপদ। এদের হাত থেকে ঢ‌্যাঁড়শের সতীত্ব রক্ষা হয়। এরা ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটায় না।

ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটানো খরিদ্দারদের স্ত্রীরা সাধারণত ‘গিন্নি’ হয়। এরা লুঙ্গি পরে বাজারে আসে। ঢ‌্যাঁড়শের স্তূপের পাশে বসেই ঢ‌্যাঁড়শের গতরটা হাতের মুঠোয় ভরে, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটিয়ে কচিত্ব পরীক্ষা করে। কিন্তু সতীত্ব তো যায়!

শিল্পী: শান্তনু দে

এরকম পিছনফাটা ঢ‌্যাঁড়শগুলি অন‌্য খরিদ্দাররা নিতে চায় না। আমি কত নিষেধ করব বলুন? তাই আমি লিখে রেখেছিলাম, দয়া করিয়া ঢ‌্যাঁড়শের পিছন ফাটাইবেন না। বেচারা বেগুনগুলো নিয়েও সমস‌্যা। বেগুনটাকে হাতের তালুতে নিয়ে টেপে। কতটা কচি দেখে। বেগুনের সর্বনাশ হয়। লিখেই ফেললাম, ‘অযথা বেগুন ধরিয়া টেপাটেপি করিবেন না’।

আমার একজন চাপ দাড়িওলা খদ্দের আছে। ওর স্ত্রী হল ওর মিসেস। বললেন, ‘দেখতে বড় খারাপ লাগছে। ওখানে বরং লিখে দাও, বেগুনের শ্লীলতাহানি করিবেন না।’ আমি বলি, বড্ড কঠিন বানান। উনি বললেন, ‘তাহলে মানহানি করে দাও’। তাই করলাম।

কিছু খদ্দেরের চোখে এক্স-রে মেশিন বসানো থাকে। ওরা শালগমের ভিতরে জালি দেখতে পায়, বেগুনের ভিতরে পোকা দেখতে পায়, আমের ভিতরে আঁটির সাইজ দেখতে পায়। নইলে কী করে বলে, ‘ওটা তো আঁটি সর্বস্ব’। কিছু কিছু খদ্দের আছে, ওরা রাঙা আলুর রং বেশ লাল না হলে নেয় না। দেখে তো সবজান্তা মনে হয়, কিন্তু এটুকু বোঝে না যে, এগুলো রং করা মাল! কী করব? ওই রং কাতুরেদের জন‌্যই রং করা রাঙা আলু, রং করা পটল আনতে হত।

ফলের কারবার যখন করতাম, তখন আমার সমস‌্যা হত ‘ফাটিয়ে দাও’ দাদাদের নিয়ে। ঢ্যাঁড়শ ফাটিয়ে কচিত্ব বোঝা যায়, নারকোল ফাটিয়ে বুড়োত্ব বোঝা যায়। নারকোলটা হাতে নিয়েই প্রথম কথা ‘ঝুনো হবে তো?’ ফলওলাদের ডাক্তার হতে হয়। ডাক্তার যেমন বুকে নল লাগিয়ে, চোখের পাতা টেনে, বুকে নল বসিয়ে ভিতরের ব‌্যাপারস‌্যাপার বুঝতে পারে, আমাদেরও তেমনি নারকোলকে নাড়িয়ে জলের শব্দ দেখে বুঝতে হয় নারকোলের ভিতরের অবস্থা।

কখনও নখের টোকা দিয়ে শব্দ শুনেও বুঝতে হয়। বেলকে আবার ফুটপাথে লাফাতে দিতে হয়। একটু উপর থেকে বেলকে শক্ত জায়গায় ফেলে বেলের নৃত‌্য দেখে বুঝতে হয় সে কতটা পেকেছে। না পাকলে নাচুনে হয় না। আবার বেশি পাকলেও মুশকিল। সেটা রং দেখে বুঝতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ খদ্দেরই বলে ফাটিয়ে দিন। ফাটাতেই হয়। তখন আবার ফ‌্যাচাং। আমার ডাক্তারিও তো ফেল করতে পারে! কত বড় বড় ডাক্তাররাও রোগ ধরতে পারে না। খদ্দের তখন নেয় না।

ওসব গেল। আবার কচিত্ব-বুড়োত্ব নিয়ে চিরকেলের সমস‌্যা। আমার চোখে যেটা কচি, আপনার চোখে সেটা না-ও হতে পারে। বুড়োরাও তো চুলে-গোঁফে কলপ মেরে কচি হতে চায়। ফলের তো কলপ হয় না। আবার নারকোল ফাটানোর পর শাঁস দেখে, বা তাতে নখ মেরে খদ্দেরের মনে হয় ঝুনো নয়, কী করা যাবে, দু’-অর্ধেক পড়ে থাকে। বেলও তাই।

তরমুজও ফাটাতে হয়। ভিতরে লাল না হলে আবার নেয় না। ফলের ব‌্যবসা বড় খতরনাক। এজন‌্যই গীতায় নাকি লিখেছে ‘মা ফলেষু কদাচন’। মানে কক্ষনও ফলের দিকে যেও না। কিন্তু ফলের লাইনে পড়তাও আছে। চারআনা নষ্ট জেনেই দাম ফেলা হয়। লগনসা এলে ফলের দামটা খুব বেড়ে যায়। ফলে ফলাফল ভালোই হয়।

ফলের কারবারের হ‌্যাপা হল গন্ধ-শোঁকা বাবুরা। কোনও কোনও বাবু আছে, যারা ফলটা হাতে নিয়েই বোঁটার দিকে নাক বেঁকিয়ে গন্ধ শোকে। অনেক খদ্দের আবার শোঁকা ফল নেয় না। বলে, ‘ঠাকুরকে দেব এঁটো ফল!’ বলি, এঁটো কেন? ‘শুঁকেছে তো। জানো না। ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম্‌। গন্ধেই আধা খাওয়া হয়ে যায়।’

কী যে করি! কতগুলো ফল আছে, বাবুরা শুঁকবেই। যেমন আম, বেল, কত্‌বেল, অনেকে পারলে কাঁঠালও শোঁকেন। ওটা গতরে ভারী বলে পারেন না। এখন যদি লিখে দিই শোঁকা নিষেধ, কেউ আসবে না। ফলে বড্ড হ‌্যাপা, তাই মাছের লাইনে চলে এসেছি। এতে একটা সুবিধে আছে। বিকেলটা বেশ ফাঁকা এবং ফিরি।

এক্কেবারে সুয‌্যি ওঠার আগে আড়তে গিয়ে মাছ নিয়ে আসতে হয়। সাতটার মধ‌্যে বাজারে। যখন ফলের বা সবজির লাইনে ছিলাম, তখন এত ভালো করে মানুষ চিনিনি। মাছের লাইনে মানুষ চিনতে পারছি। থলের সাইজ, থলেটা ছুড়ে দেওয়া– এসব থেকেই বোঝা যায় লোকটা প্রোমোটার, বড় নেতার বড় চামচা, নাকি দালাল, নাকি কম মাইনের সিকিউরিটি গার্ড বা দোকান কর্মচারী।

কার্টুন: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘বড় দেখে বেছে বেছে এককিলো চিংড়ি’– কথাতেই তো বোঝা যাচ্ছে! রেস্তওয়ালারা ইলিশের দাম জিজ্ঞাসা করার আগেই জিজ্ঞাসা করে ‘গঙ্গার না পদ্মার?’ কই মাছ দেখে বলে ‘হাইব্রিড না দেশি?’ দাম কোনও ব‌্যাপার নয়। দামে কিছু যায় আসে না। আবার উল্টোদিকে এমন খদ্দেরও আছে, যারা একটু বেলার দিকে আসে, যখন জ‌্যান্ত, খাবি-খাওয়া ট‌্যাংরা বা ল‌্যাটা মাছের কয়েকটার অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। যেহেতু মাছেদের ভেন্টিলেশন হয় না, তাই মৃত‌্যু সময়ের অপেক্ষা। জ‌্যান্ত ল‌্যাটা যদি ৪০০ টাকা কিলো হয়, মরা ল‌্যাটা ২০০ হয়ে যায়। এই খদ্দেররা যমরাজ হয়ে মাছেদের শিয়রে বসে থাকে। একটা একটা করে মাছ মরে, সেটাকে আলাদা করে রাখে। এইভাবে গোটা কয়েক জড়ো হলেই পাল্লায় চাপাতে বলে।

কিছু আছে– একটু পেটগলা, নরম হয়ে যাওয়া মাছগুলোই নেয়। আসলে মাছের যা দাম, নিজেরই মাঝে মাঝে বেচতে লজ্জা হয়। যারা একটু গলা মাছ নেয়, রসুন বেচা এক বুড়ি ওদের চেনে। একজন মাছ বেচনেওলা আছে, আমার বন্ধু, ও আড়ত থেকে একটু নরম মাছই নিয়ে আসে।

নরম মাছের খদ্দেরের সংখ‌্যা কম নয় কিন্তু। একজন পেঁয়াজ-রসুন বেচা বুড়ি আছে। ঠিক ওই মাছওলার পাশে এসে বসে যায়, বলে, ‘প্যাঁজ-নংকা-রসুন দে ভালো করে কষিয়ে নেবা। খুব ভালো সোয়াদ পাবা।’

ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়

একজন খদ্দেরের কথা বেশ মনে পড়ে। বেশ রাশভারী চেহারার। উনি আর নেই। প্রায়ই আসতেন, মাছের চোখটা খুব ভালো করে দেখতেন। মাছের কান উঠিয়ে কানকোটা দেখতেন, ডাক্তারবাবুরা যেমন করে রোগীকে হাঁ-করিয়ে গলা দেখে। পেটটাও টিপে দেখতেন। তারপর চলে যেতেন। আমি একদিন রগড় করেই বলেছিলাম, ‘কী ডাক্তারবাবু, ফি না নিয়েই চলে যাচ্ছেন, রুগি বাঁচবে তো?’

উনি কী বুঝলেন কে জানে? এরপর আর দেখিনি। পরে শুনলাম উনি মারা গিয়েছেন। ব‌্যাঙ্কে কাজ করতেন, কিডনির অসুখ ছিল। মাছ-মাংস খাওয়া একদম নিষেধ ছিল। কিন্তু মাছ বড় ভালোবাসতেন। খেতে তো পারতেন না, ছুঁয়ে যেতেন, নাড়াচাড়া করে যেতেন।

ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম কি না!

…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…

২০. জাত গেল জাত গেল বলে পোলিও খাব না!

১৯: ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়!

১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে

১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম

১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল

১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক

১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?

১৩. ভারত কিন্তু আম-আদমির

১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’

১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না

১০. জনতা স্টোভ, জনতা বাসন

৯. রামেও আছি, রোস্টেও আছি!

৮. বাঘ ফিরেছে বাগবাজারে!

৭. রেডিওর যত ‘উশ্চারণ’ বিধি

৬.হৃদয়ে লেখো নাম

৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু

৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য

৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল

২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন

১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী