সিনেমা হলের ওই অপার অন্ধকারে, দেশব্যাপী ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের মাঝে, আদতে দর্শক তো আলোই চেয়েছে। নিহত আদর্শবাদী পুলিশ অফিসারের ছেলে, ডকের গুন্ডা থেকে অপরাধ-দমনকারী হয়ে ওঠা বিজয়, আবার তেমনই ভালো পুলিশ অফিসারের অনুপ্রেরণায় ডন সেজে মাফিয়া-পুলিশ অলাতচক্র ভাঙা বিজয়, ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের হত্যা দেখে সেই ব্যাটম্যানের মতো ডার্ক নাইট হয়ে ওঠা বিজয়– আসলে ‘বিজয়’ নামের একই চরিত্র কি ভেঙেচুরে ফিরে আসছিল অমিতাভ বচ্চনের কাছে? গণবিদ্রোহের অচেতন হয়ে উঠছিল কি সেই চরিত্রগুলো?
রাষ্ট্রবিপ্লবে ক্ষতবিক্ষত, যৌবনের হননকালের ভারী স্মৃতি বুকে নিয়ে সাতের দশক ফুরিয়ে আসছিল। দেশজুড়ে যখন বিপ্লবের স্বপ্ন মরেছে, অজস্র তরুণের লাশ তার প্রতিনিধি হয়েছে, ব্ল্যাকআউটের সন্ধে পেরিয়েছে প্রতিবেশী দেশের শরিক হয়ে; তখনও আসমুদ্রহিমাচলের হাজার হাজার সিনেমা হল লালন করেছে গণস্বপ্নবিলাস। রাগী যুবক, প্রেমিক ও দিওয়ানা পুরুষ, সর্বহারা নায়ক ও সর্বত্যাগী নায়িকা, কুহকিনী, ডেয়ারডেভিল, সমাজবিরোধী, ফেমে ফাতাল, গব্বর সিং-রা ছিল, ছিল ‘আপ কি আঁখো মে কুছ’-এর মোহমুগ্ধতা, ‘কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’-র বিষণ্ণতা বা ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো’-র উন্মাদনা। একদিকে বিজয় তেন্ডুলকর, সত্যদেব দুবে, ইসমত চুগতাইরা ভারতীয় নবতরঙ্গের ছবির চিত্রনাট্য-সংলাপ লিখেছেন যখন, তখন সেলিম-জাভেদের একচেটিয়া সংলাপের মস্তানিতে আলোড়িত হয়েছে উপমহাদেশ, জটায়ুর সেই অমোঘ উক্তি অনুসারে, হলে বারবার পায়রা উড়েছে।
সেই সত্তরে দেশপ্রেমের ধ্বজা কাঁধে তুলে নেওয়া মনোজ কুমারের হাত ধরে ইন্দিরা গান্ধী কথিত ‘রোটি কাপড়া মকান’ এসেছে যেমন, তেমনই খোদ ইন্দিরা গান্ধীর জীবননির্ভর বলে মার্কামারা ‘আঁধি’-ও মুক্তি পেয়েছে, একেবারে জরুরি অবস্থার বছরেই, বাঙালি আইকন সুচিত্রা সেন ও সঞ্জীব কুমারকে নিয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় শ্লেষাত্মক অভিব্যক্তিতে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রেমহীনতায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, এই ছবি আবার ঢুকে পড়ল ইন্দিরা গান্ধীর বৈবাহিক জীবনের ভেতরঘরে, অন্তত অনেকের তাই বিশ্বাস ছিল তখন। বিশ্বাসকে দোষারোপ করেও লাভ নেই, কী আক্কেলে কে জানে, এ ছবির নির্মাতা গুলজার সরাসরি তারকেশ্বরী সিনহা-ইন্দিরা গান্ধীর চেহারার অনুসৃতিতেই তৈরি করলেন আরতি দেবী ও জে. কে, অর্থাৎ এই ছবির মূল দুই চরিত্রকে। রাহুল দেববর্মনের অপূর্ব সুরে ও গুলজারের লিরিকে ‘ইস মোড় পে যাতে হ্যায়’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’, ‘তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি’, ‘তুম আ গয়ে হো নুর আ গয়া’-র সুর তখন ‘রেডিও সিলোন’-এ আমিন সায়ানির ‘বিনাকা গীতমালা’-র সূত্র ধরে তখনকার ঘোরতর ইন্দিরা-বিরোধী, এমনকী, অতি বাম কানের ভেতর দিয়েও মরমে পশিতে লাগল। প্রতিবিপ্লব বা বিচ্যুতি হলেও ক্ষমার যোগ্য, কারণ অমন মেলডিতে সাড়া না দেওয়াও মানবিক নয়। ‘অভিমান’-এর মতো ছবি তৈরি হয়েছে তখন, যেখানে সেলিব্রিটি দম্পতির ‘ইগো ক্রাইসিস’ ও বিচ্ছেদের আখ্যান জন্ম নিয়েছে। তখনকার পক্ষে অমন জটিল বিষয়ও, অমিতাভ-জয়ার অবিশ্বাস্য জুটি এবং ‘পিয়া বিনা পিয়া বিনা’ বা ‘তেরি মেরি মিলন কি ইয়ে রহেনা’-র অনুরণনে স্পন্দিত হয়েছে, যেভাবে ‘ঘর’-এ, ধর্ষণের ঘটনায় নড়ে যাওয়া দাম্পত্যের গল্পের অন্ধকার ‘তেরে বিনা জিয়া যায়ে না’ বা ‘আজ কাল পাও জমিন পর’ বা ‘ফির ওহি রাত হ্যায়’-এর সুরের আলোয় মিলিয়ে গিয়েছে।
……………………………………………………………………………..
ইন্টারভালে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাই বোধহয় জানতে চেয়েছিলেন তাঁর সতীর্থদের থেকে, ‘আমজাদকে কেমন বুঝছ?’ আবার সেই বছরেই নিষিদ্ধ রোমান্সের হলিউডি ছবি ‘দ্য ব্লু লেগুন’ দেখার জন্য গোপন ভিড় হচ্ছে উত্তর কলকাতার হলগুলিতে, আর পাড়াতুতো গোয়েন্দারা সেসব খবর যথাস্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন। তারকাখচিত ‘দ্য বার্নিং ট্রেন’-এর অর্থহীন হারাকিরিও হুমড়ি খেয়েই দেখছে দর্শক।
……………………………………………………………………………..
যেভাবে হোক, সিনেমা হলের ওই অপার অন্ধকারে, দেশব্যাপী ঘনিয়ে আসা নানাবিধ অন্ধকারের মাঝে, আদতে দর্শক তো আলোই চেয়েছে। নিহত আদর্শবাদী পুলিশ অফিসারের ছেলে, ডকের গুন্ডা থেকে অপরাধ-দমনকারী হয়ে ওঠা বিজয়, আবার তেমনই ভালো পুলিশ অফিসারের অনুপ্রেরণায় ডন সেজে মাফিয়া-পুলিশ অলাতচক্র ভাঙা বিজয়, ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের হত্যা দেখে সেই ব্যাটম্যানের মতো ডার্ক নাইট হয়ে ওঠা বিজয়– আসলে ‘বিজয়’ নামের একই চরিত্র কি ভেঙেচুরে ফিরে আসছিল অমিতাভ বচ্চনের কাছে? গণবিদ্রোহের অচেতন হয়ে উঠছিল কি সেই চরিত্রগুলো? আশিস নন্দী জনপ্রিয় সিনেমা সংক্রান্ত তাঁর একটি সন্দর্ভে লিখেছিলেন, গ্রামপতনের স্মৃতি বুকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত শহর বা ‘আনইন্টেন্ডেড সিটি’, আর সেই শহুরে বস্তিই হয়ে উঠছে সিনেমার প্রতিরূপ, কারণ প্রতিদিনের সংগ্রাম ও টিকে থাকায় মিলে গিয়েছে এরা। অমিতাভ বচ্চনকে এই রূপকের মধ্যেই ধরতে চেয়েছেন তিনি। দেখাতে চেয়েছেন, কীভাবে রাজনীতির অবক্ষয় পালিশ বাড়াল খলনায়কদের, নায়ককে করে তুলল অবৈধ, মেঘনাদের মতো গোপন যোদ্ধা। ‘নিশান্ত’ বা ‘মন্থন’-এর প্রতিরোধের পাশাপাশি তাই এই গণ-অচেতনের প্রায় পৌরাণিক হয়ে ওঠা নায়করা রইল। পূর্ণ, শ্রী, উত্তরা-র মতো চাপা পড়া এলডোরাডো হয়ে যাওয়া ধূসর হলের ইতিহাস যদি কখনও অলৌকিক কোনও মোকামে হঠাৎই দৃশ্যমান হয়, তবে ‘ইয়াদো কি বরাত’ বা ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’ দেখতে বসে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠা, খলনায়ককে মরতে দেখে তৃপ্তি পাওয়া দর্শকদের কি আমরা পাব না? গোবিন্দ নিহালনি-র ‘আক্রোশ’-এর শেষে যে পরিণতি দেখি আমরা, তা আসলে তো শোষকের কাছে কোথাও না কোথাও হার। তাই জনপ্রিয় ছবির এক নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা ছিল।
মনে রাখতে হবে, অ্যাংরি অমিতাভ বচ্চন, প্রবলপরাক্রমী ধর্মেন্দ্রর পাশাপাশি ‘ছোটি সি বাত’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘গোলমাল’, ‘বাতো বাতো মে’, ‘রজনীগন্ধা’-র অমল পালেকরও ছিলেন। ওপরচালাক আসরানিকে টপকে, অশোককুমারের সাহায্যে, ওই ‘ইয়ে দিন কেয়া আয়ে’-র সলিল চৌধুরী-কৃত অপূর্ব ইন্টারলিউডে তাল মিলিয়ে চোস্ত প্রেমিক হয়ে উঠছেন অমল পালেকর, সেই জয়ও তো দর্শকেরই। প্রাচীন গ্রিক বা শেক্সপিয়রীয় নায়কদের হ্যামার্শিয়া পেরিয়ে দর্শক কেবল চেয়েছে, খানিক তাদের হয়েই, জিতে যাক সিনেমার বাস্তবতা।
সাতের দশক মুক্তির দশক হয়ে ওঠেনি, যুদ্ধ, রাজনৈতিক টালমাটাল, রক্তপাতের দশক হয়ে ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও বহতা ছিল মধ্যবিত্ত রোজনামচা, বাস-ট্রাম-ট্রেনের নিত্যযাত্রা, ভাড়াবাড়ির কলঘর, লোডশেডিং, টিউবকলের জীবন। ছোট ছোট মূল্যবোধের, কলোনিজীবনের গা সয়ে যাওয়ার, ফুটবল পায়ে মাঠ পেরিয়ে যাওয়া জীবনের স্বপ্ন দেখার গল্প তো থেমে থাকেনি বাঙালির শহর, গ্রাম, মফসসলের জীবনে। জনপ্রিয় সিনেমা, মূলত বলিউডের, সেই জীবনকে চেনায়নি, চিনিয়েছে তার অন্তর্লীন স্বপ্ন, কামনাকে।
কলকাতার বিদগ্ধজনরাও তাই গম্ভীর ছবির চর্চার সঙ্গে সঙ্গেই সেইসব জনতার সিনেমাহলে ঢুঁ মারতে দ্বিধা করেননি। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, তখন তরুণ কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ও গল্পকার প্রবুদ্ধ মিত্রকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘কুরবানি’ দেখে আসা যাক। সেই ছবিতেই জিনাত আমনের চোখধাঁধানো লাস্যে ‘লায়লা ম্যায় লায়লা’ এমনই হিট করল, এখনও ভাসানের ব্যান্ডপার্টি অসম্পূর্ণ এই গান ছাড়া, এবং এতে কিছুকাল আগে ‘রইস’-এ এই গানের রিমেক হওয়ার অবদান সামান্যই। সেই ১৯৮০ সালের গান এই চার দশক ধরে ধ্রুব হয়ে রয়েছে গণশ্রুতিতে। এই গানের দৃশ্যায়নে আমজাদ খানের কমিক টাইমিংও অভিশ্বাস্য। ইন্টারভালে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাই বোধহয় জানতে চেয়েছিলেন তাঁর সতীর্থদের থেকে, ‘আমজাদকে কেমন বুঝছ?’ আবার সেই বছরেই নিষিদ্ধ রোমান্সের হলিউডি ছবি ‘দ্য ব্লু লেগুন’ দেখার জন্য গোপন ভিড় হচ্ছে উত্তর কলকাতার হলগুলিতে, আর পাড়াতুতো গোয়েন্দারা সেসব খবর যথাস্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন। তারকাখচিত ‘দ্য বার্নিং ট্রেন’-এর অর্থহীন হারাকিরিও হুমড়ি খেয়েই দেখছে দর্শক।
আর ঠিক সেই ক্রান্তিকালের শেষে, আটের দশকের শুরুর বছরটায়, এই জুলাই মাসেই, বাংলা সিনেমার আকাশ থেকে খসে পড়ছে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি, যার নাম উত্তমকুমার।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল
পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল