একটি টেলিফিল্ম দিয়ে যেটি কলকাতা দূরদর্শনের এক মূল্য সম্পদ বলেই আমার মনে হয়। ছবির নাম, ‘মুখগুলি’, দিব্যেন্দু পালিতের গল্প অবলম্বনে তৈরি। রাজা ও জিৎ মিলে একটা স্ট্রাকচার বা কাঠামো বানিয়ে দিয়েছিল, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি আমি, প্রত্যেকটা সংলাপ আমারই হৃদয়রসে জারিত ও লেখনী নিঃসৃত। ছবির বিষয় বৃদ্ধাশ্রম। মর্মস্পর্শী এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অসামান্য অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। শেষ পর্ব
কলকাতা দূরদর্শনে আমার প্রত্যক্ষ ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে ছিল এক পরোক্ষ যোগাযোগ। কেমন সে সংযোগ ?
বছরটা ১৯৮৬। মে-জুন মাস হবে। তখনও আমরা পুরনো বাড়ি, মানে রাধা স্টুডিওতে। বিজ্ঞাপনদাতা আয়োজিত অনুষ্ঠান অর্থাৎ স্পনসরড প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে কিছুদিন আগে থেকেই। কলকাতা শহরে তখন অনেক সংস্থা, সোনেক্স, ইনফোকম, ভিডিওপ্যান, ইত্যাদি। ইনফোকম থেকে রবিন ঘোষ রাজাকে ডেকে পাঠালেন। বিভিন্ন লেখকদের ছোটগল্প নিয়ে যে সিরিজটি তখন টেলিকাস্ট হচ্ছিল তারই একটি পর্ব পরিচালনা করতে বললেন। বাণী বসুর ‘মিসেস গুপ্তরা’ গল্প নির্বাচন করলাম আমরা, ঠিক হল তার স্ক্রিপ্ট লিখব আমি। সেই প্রথম আমার ফিকশনের স্ক্রিপ্ট লেখা। এতদিন বহু নন-ফিকশন ও ডকুমেন্টরির ন্যারেশন (ভাষ্য) এবং স্ক্রিপ্ট লিখেছি কিন্তু গল্পের নাট্যরূপ দেওয়া এবং সংলাপ লেখার সেই শুরু।
কাজটা বাইরের, দূরদর্শনের নিজস্ব নয় অথচ দূরদর্শনের জন্যই। একেই বলছিলাম পরোক্ষ যোগাযোগ। আমাদের সরকারি চাকরিতে নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল, যে ভিডিও কোম্পানিগুলোর কথা বললাম, সেখানে দেখা যেত আমাদের ক্যামেরাম্যান, এডিটররাই কাজ করছে অন্য নামে। আমিও চিত্রনাট্য লেখা শুরু করলাম ‘কেয়া সেন’ নামে, কেয়া আমার ডাকনাম আর আদতে আমি সেন। এই নামটি অবশ্য গোড়ার দিকে তরুণদের জন্যে অনুষ্ঠান সঞ্চালনার সময়ে ব্যবহার হত, পঙ্কজদা বলতেন চৈতালির চেয়ে ‘কেয়া’ নামটি বেশি ক্যাচি।
চিত্রনাট্য লেখার কাজে মজা পেয়ে গেলাম, যেন আরেক সৃষ্টির পথ! কেবল তাই নয়, শুটিংয়ে কস্টিউম এবং শিল্পনির্দেশনার কিছুটা দায়িত্বও নিয়ে নিলাম। ১৯৮৬-র ১ জুলাই আমার কাছে এক স্মরণীয় দিন– সেকথা বিস্তারিতভাবে আগেই বলেছি, যেদিন আমাদের দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। বিশেষ সম্প্রচারের প্রথম ঘোষণায় আমি ছিলাম। তার একদিন পরেই শুরু হল ‘মিসেস গুপ্তরা’র শুটিং। অফিস সামলে শুটিংয়ে যাই, যতটা সময় পারি থাকি। কাস্টিং করার সময়ও রাজা আমার মতামত নিয়েছিল, সেই ভাবেই মূল চরিত্রে আসে বন্ধু গোপা ঘোষ। ওর কথা আগে বলেছি, ১৯৭৫-এ টেলিভিশনে ঢুকে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল গোপা তাদের একজন, পর্দায় এটাই ওর প্রথম কাজ।
প্রাইভেট চ্যানেলগুলো আসার আগে যতদিন দূরদর্শনই একমাত্র চ্যানেল ছিল ততদিন রাজা যত কাজ করেছে তাদের জন্য তার প্রতিটাতেই আমার কিছু না কিছু ভূমিকা ছিল, তবে অবশ্যই সেটা ক্যামেরার পিছনে। ক্যামেরার সামনে কাজ করার কোনও অনুমতি আমাদের ছিল না। এসব প্রসারভারতী হওয়ার অনেক আগের কথা।
পরোক্ষ সংযোগের আরও গল্প বলি। ‘রাগ অনুরাগ’ নামে একটা সিরিজে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘হাওয়াবন্দুক’ গল্পের চিত্ররূপ দিয়েছিল রাজা, অভিনয় করেছিল মমতা শঙ্কর ও অঞ্জন দত্ত। তারও চিত্রনাট্য লিখেছিলাম আমি। মনে পড়ে, নিউ আলিপুরে এক বাড়িতে শুটিংয়ের সময় আমি এক নিরালা ঘরে বসে দর্শকের দরবারের চিঠি বেছেছি, মম মাঝে মাঝে এসে জিজ্ঞেস করেছে সাহায্য করবে কি না চিঠি পড়ায়। একই সঙ্গে দুটো কাজ করেছি প্রাণের আনন্দে। ট্রান্সমিশনের সময় হয়ে যেতে আমি বেড়িয়ে পড়তাম শুটিং থেকে। অফিসে ঢুকে সোজা মেকআপ রুম। সাজগোজ করে বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে এসে বসতাম স্টুডিওতে, অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘দর্শকের দরবারে’র জন্য।
কলকাতা দূরদর্শনে যখন সেকেন্ড চ্যানেল চালু হল তখন এল আরেক ধরনের ধারাবাহিক, স্পনসরড প্রোগ্রাম নয়, এগুলো দূরদর্শনের নিজস্ব কমিশনড প্রোগ্রাম । দিব্যেন্দু পালিতের চারটে ছোটগল্প নিয়ে রাজা তৈরি করল ‘মানুষের মুখ’ নামে এক সিরিজ। এর মধ্যে ‘শোকসভা’ গল্পের স্ক্রিপ্ট জিৎ সরকারের লেখা, বাকি তিনটে ‘স্কুলে যাবার রাস্তা’, ‘ফিরে আসা’, ‘গাঢ় নিরুদ্দেশে’র স্ক্রিপ্ট আমার লেখা।
সারাদিন অফিস ক‘রে, শ্রাবস্তী ও সংসারের কঠিন দায়িত্ব সামলে, দুই পুত্র ঘুমিয়ে পড়লে রাত জেগে লিখতাম। লেখার নেশাটা তখন পেয়ে বসেছে আমায়।
কমিশনড প্রোগ্রাম: ‘A Day in the Life of a Celebrity’ নামে সিরিজ করল রাজা, সর্বতোভাবে সাহায্য করলাম সে কাজে। অপর্ণা সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, মমতা শঙ্কর– এই চারজনকে নিয়ে চারটে এপিসোড।
সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’-এ আমার তেমন সহযোগ না থাকলেও আব্দুল জব্বারের ‘বাংলার চালচিত্র’ অবলম্বনে ‘সোঁদা মাটি নোনা জল’ ধারাবাহিকে আমার সহযোগ এমন ছিল যে অফিস ও বাড়ি সামাল দিয়ে আমি ক্যানিংয়ের ট্রেন ধরতাম শুটিং স্পটে পৌঁছতে।
ন্যাশনাল নেটওয়ার্কের জন্য রাজা করল টেলিফিল্ম ‘অসত্যকাম’। গল্পটা একবার পূজাবার্ষিকীতে পড়েই আমি রাজাকে বলেছিলাম ‘আমি স্ক্রিপ্ট করতে চাই, এ আমার তোমার গল্প’। লিখলাম, আবারও সেই গভীর রাতে।
সেই চিত্রনাট্যের হিন্দি রূপান্তর করল সুশীল গুপ্তা। সুশীলের কথা আগে বলা হয়নি, দূরদর্শনের প্রথম যুগ থেকে ও আমার সহকর্মী ও বন্ধু, বয়সে যদিও অনেকটাই বড় । কী জানি, দিল্লির আর্কাইভে অনসূয়া মজুমদার ও অঞ্জন দত্ত অভিনীত এ ছবি আজও আছে কি না !
লীলা মজুমদারের ‘গুপীর গুপ্ত খাতা’, ‘পদিপিসির বর্মীবাক্স’ ইত্যাদি ধারাবাহিকের কথা আর বলছি না।
শেষ করব একটি টেলিফিল্ম দিয়ে যেটি কলকাতা দূরদর্শনের এক মূল্য সম্পদ বলেই আমার মনে হয়। ছবির নাম, ‘মুখগুলি’, দিব্যেন্দু পালিতের গল্প অবলম্বনে তৈরি। রাজা ও জিৎ মিলে একটা স্ট্রাকচার বা কাঠামো বানিয়ে দিয়েছিল, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি আমি, প্রত্যেকটা সংলাপ আমারই হৃদয়রসে জারিত ও লেখনী নিঃসৃত। ছবির বিষয় বৃদ্ধাশ্রম। মর্মস্পর্শী এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অসামান্য অভিনেত্রী কেতকী দত্ত।
মনে পড়ল কেতকীদির সঙ্গে শেষ দেখা দূরদর্শনের ডিউটি রুমরুমে, সালটা ২০০৩। অসুস্থ কিন্তু তার কোন ছাপ আচরণে নেই, ওখানে বসেই গান শোনালেন। সে বছরই জুলাই মাসে চলে গেলেন।
কলকাতা দূরদর্শনের জন্য রাজার টেলিফিল্ম ‘মুখগুলি’তে কেতকীদির গাওয়া গান যেটা বহুকাল আগে ‘রীতিমত নাটক’-এ মঞ্চে গাইতেন কেতকীদির মা প্রভা দেবী, সেই গান দিয়েই এ লেখা শেষ করি–
‘‘যদি না দেখা মেলে এজীবনে
তবুও মনে রেখো, রেখো মনে…..’’
গানের এই পংক্তি আমার জীবনেও যেন সত্য হয়।
শেষ হল কেয়ার অফ দূরদর্শন
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ২৩: দূরদর্শনে হাসুদি দেখিয়েছিলেন প্রতিমা দেবীর থেকে শেখা নৃত্যশৈলী
পর্ব ২২: নিছক অবিচুয়ারি নয়, দূরদর্শনে লতা মঙ্গেশকর-স্মরণ ছিল তাঁর গান ও জীবনের উদযাপন
পর্ব ২১: ক্যামেরার সামনে আড্ডা মেরেছি , আবার তাঁর অবিচুয়ারি প্রোগ্রামও করতে হয়েছে
পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশো বছর উদযাপন করেছিলাম দূরদর্শন কেন্দ্রে
পর্ব ১৮: হুইল চেয়ারে করে দূরদর্শনে শেষ অভিনয় করতে এসেছিলেন তৃপ্তি মিত্র
পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে