মেজবউঠান, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নতুন সূর্য উঠছে। সেই সূর্য উঠলে আমাদের কাউকেই আর দেখা যাবে না। সেই সূর্যের চাঁদ হবে কাদম্বরী। সূর্যের আলোই হবে তার আলো। এইটুকু বুঝেছি। আর বুঝেছি, সূর্য তার আলোর অধিকার শুধুমাত্র তার চাঁদকেই দেবে।
২৭.
জ্যোতির বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। কাদম্বরী নেহাত বালিকা থেকে কিশোরী হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে নানা নতুন চোরাস্রোত দেখা দিয়েছে। এবং পারিবারিক জটিলতা ক্রমশই বাড়ছে। হঠাৎ জ্যোতির মাথায় নব্য ভূতের আগমন হয়েছে। সে তার কিশোরী বউকে ঘোড়ায় চড়া শেখাতে গঙ্গার ধারের নির্জনতায় বাড়ি ভাড়া করেছে। এবং সেই বাগানবাড়িতে কাদম্বরীকে নিয়মিত ঘোড়ার পিঠে দৌড়তে হচ্ছে। জ্যোতি তার দিনলিপিতে এই বার্তাটি একদিন লিখেও রাখল:
অবশেষে স্ত্রী স্বাধীনতার আমি এত বেশি
পক্ষপাতী হইয়া পড়িলাম যে গঙ্গার ধারে
কোনো বাগান বাড়িতে স্ত্রীকে নিজেই অশ্বারোহণ পর্যন্ত শিখাইতেছি।
বাগানবাড়িতেই জ্যোতির ঘাড় থেকে এই ভূত বিসর্জিত হল না। স্ত্রী কাদম্বরীকে নিয়ে জ্যোতির এই রোম্যান্টিকতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও ডানা মেলল। এবং সেই পর্বটি ধরা পড়ল জ্যোতির লেখায়:
তাহার পর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া, দুইটি আরব ঘোড়ায় দুইজনে পাশাপাশি চড়িয়া, বাড়ি হইতে গড়ের মাঠ পর্যন্ত প্রত্যহ বেড়াইতে যাইতাম। ময়দানে পৌঁছিয়া দুইজনে সবেগে ঘোড়া ছুটাইতাম, প্রতিবাসীরা স্তম্ভিত হইয়া গালে হাত দিত। অথচ কিছুদিন পূর্বে আমি কিন্তু পুরাতনপন্থী ছিলাম।
তাই আমার ‘জলযোগ’ প্রহসনে মেয়েদের স্বাধীনতা লইয়া একটু হাস্যরসের অবতারণা করিয়া ছিলাম। এই সময়ে আমার মনোভাব এমনই ছিল যে বাড়ির মেয়েদের বাহিরের কেউ দেখিয়া ফেলিলে আমার মাথা লজ্জায় কাটা যাইত। সেই মনোভাব বদলাইতে বদলাইতে কোথায় আসিয়া দাঁড়াইল!
তবু কাদম্বরী ও ঘোড়ার শখ জ্যোতিরিন্দ্রর জীবনে এল আর গেল।
–স্ত্রীকে নিয়ে এই ক’দিনের মাতামাতিতে কার কী লাভ হল ঠাকুরপো, জ্যোতিকে সন্ধ্যার ছাদে একা ফিরে পেতেই জানতে চাইল জ্ঞানদা।
–কাদম্বরী আর আমি দু’জনেই একটি জিনিস বুঝতে পেরেছি। সুতরাং এই মাতামাতি বৃথা যায়নি বউঠান, বলল জ্যোতি।
–কী সেই একটি জিনিস যা বউকে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বুঝতে হল? জ্ঞানদার কণ্ঠে বিদ্রুপ।
–বুঝতে পারলুম, আমাদের ঘোড়া একসঙ্গে ছুটলেও মন ছুটছে দু’পথে। কাদম্বরী আমার মন বোঝে না। আমিও বুঝি না ওর মন। এ ফারাক ঘুচবে না বউঠান।
–স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মনই তো সব নয়। একটা শরীরের দিকও আছে নতুন, বলে জ্ঞানদা।
–স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যেখানে মনের মিল নেই, সেখানে অন্তত আমার পক্ষে শরীরের মিলন অসহনীয় যন্ত্রণার।
–কিন্তু মেয়েরা তো সন্তান চায়। মা হওয়ার মধ্যে নারী-জীবনের সার্থকতা যুগে যুগে সর্ব দেশে, সমাজে স্বীকৃত। ঠাকুরপো, তুমি চাও না কাদম্বরী তোমার সন্তানের মা হোক?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সেদিন দুপুরে আমার ‘সরোজিনী’ নাটকের একটি দৃশ্য লিখছি। সে-দৃশ্যে জহরব্রত উদ্যাপন করে বিধবা রাজপুত মেয়েরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিচ্ছে। আমি তাদের মুখে বসিয়েছি গদ্যসংলাপ। রবি হঠাৎ পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, গদ্য নয় নতুনদা, এই দৃশ্যে একটা গান চাই। আমি বললুম, গান তো চাই। কিন্তু যুৎসই গান লিখতে পারছি না যে রবি। আর আমার কথা শুনে চোদ্দো বছরের রবি বলল আমি মুখে মুখে গান রচনা করছি, লিখে নাও!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছাদের অন্ধকারে জ্যোতির ছায়াময় মূর্তি জ্ঞানদার খুব কাছে সরে আসে। তার কাঁধে হাত রাখে। বুকের মধ্যে জ্যোতি টেনে নেয় মেজবউঠানকে। কিন্তু কোনও কথা বলে না।
–ঠাকুরপো, আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা। প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারেও যেন মৃত সন্তানের জন্ম দিতে না হয় আমাকে। তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। জ্যোতির বুকের মধ্যে জ্ঞানদার শরীর কান্নায় কাঁপতে থাকে।
–এই ভাল হল মেজবউঠান, খুব আলতো কণ্ঠে বলল জ্যোতি।
–কী ভাল হল? কান্না ভেজা প্রশ্ন জ্ঞানদার।
–তোমার কাছে ফিরে এলাম!
–সত্যিই চলে গিয়েছিলে?
–ঘাড়ে ভূত চেপে ছিল।
–ভূত নেমে গেল কেন?
–বুঝলুম কাদম্বরী রবির মেজবউঠান! আর কারও নয়।
অন্ধকারের মধ্যে মুখ তুলে জ্যোতির ছায়াময় মুখের দিকে তাকায় জ্ঞানদা।
–কী বলছ তুমি?
–ঠিকই বলছি। এবং যা স্বাভাবিক, তাই বলছি। দুজনেই কিশোর-কিশোরী। একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে আমাদের চোখের আড়ালে। কাদম্বরীর সঙ্গে ক’দিন কাটিয়ে এইটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি, সে রবিময়। আমার জন্য কোনও জায়গা নেই তার মনে।
–শুধু এই কারণে ফিরে এলে নতুন?
–না। পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়লাম, কাদম্বরীকে নিয়ে শহর কাঁপিয়ে স্ত্রী স্বাধীনতার ধ্বজা ওড়ালাম, তারপর দেখলাম, আমি নিজেই তো স্বাধীন নই।
–মানে? এই একটিমাত্র শব্দের উচ্চারণে কেঁপে ওঠে জ্ঞানদার কণ্ঠ।
অনেকক্ষণ কোনও কথা নেই জ্যোতির মুখে। তারপর বলে, আমিও কাদম্বরীর দিকে আমার মনের দরজা-জানলাগুলো খুলতে পারলুম না। কিছুতেই না। বুঝলুম, সেই স্বাধীনতা আমার নেই।
–নেই কেন?
–বউঠান, তুমিই মধ্যবর্তিনী। পেরিয়ে যেতে পারিনি।
সেটা করলে তিনজনকেই ঠকানো হত। তুমি, কাদম্বরী, আমি– এই তিনজনেই কি মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়তাম না?
–পারিবারিক ধর্ম তো সেটাই চায় নতুন।
তুমি যে সত্যের পথ বেছে নিলে সেই সত্যের নিষ্ঠুর খেলা কোথায় শেষ হবে, কে জানে? সহ্য করতে পারব তো?
–যতদূর চোখ যায় চোখের জল ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তার মধ্যে মিথ্যার দহন নেই।
–নতুন, আবছা স্বরে ডাকে জ্ঞানদা।
–বলো, আরও গভীরভাবে বুকের মধ্যে টেনে নেয় জ্যোতি।
–তোমাকে খুব ভালবাসি ঠাকুরপো– প্রতিশ্রুতি দাও, ছেড়ে যাবে না।
–তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই মেজবউঠান।
–বিশ্বাস করি না নতুন। তোমার পৃথিবী কত বড়। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছ তুমি। তাছাড়া নাটকপাড়ার সুন্দরীদের সঙ্গে সময় কাটাও তুমি– আমি কোথায়?
–তুমি কোথায় মানে? মেজবউঠান, তুমি আমার সমস্ত চর্চার প্রেরণা। তুমি আছ আমার অর্কেস্ট্রা রচনায় আমার সুরে, আমার গানের বাণীতে, আমার সেতারে, আমার বেহালার বেদনায়।
–নতুন, তুমি জন্মেছ এক আশ্চর্য প্রতিভা নিয়ে। তোমার রূপ, তোমার প্রতিভা, আমাকে খুন করেছে সেই কোন ছেলেবেলায়। পালাবার পথ নেই আমার। তুমি ঠাকুরবাড়ির মধ্যমণি। এবং তুমিই কলকাতার আলো। আমাকে তোমার পাশে রেখো নতুন। ছেড়ে যেও না।
–কতদিন আমি মধ্যমণি থাকবো, জানি নে।
–হঠাৎ একথা বলছ কেন?
–সম্প্রতি রবি অপ্রত্যাশিতভাবে তার উদয়ের পূর্বাভাস দিয়েছে!
–বুঝলুম না। কী করেছে রবি?
–শোনো তাহলে। সেদিন দুপুরে আমার ‘সরোজিনী’ নাটকের একটি দৃশ্য লিখছি। সে-দৃশ্যে জহরব্রত উদ্যাপন করে বিধবা রাজপুত মেয়েরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিচ্ছে। আমি তাদের মুখে বসিয়েছি গদ্যসংলাপ। রবি হঠাৎ পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, গদ্য নয় নতুনদা, এই দৃশ্যে একটা গান চাই। আমি বললুম, গান তো চাই। কিন্তু যুৎসই গান লিখতে পারছি না যে রবি। আর আমার কথা শুনে চোদ্দো বছরের রবি বলল আমি মুখে মুখে গান রচনা করছি, লিখে নাও!
–তারপর? উদ্গ্রীব জ্ঞানদা।
–তারপর রবি বলতে শুরু করল সেই অপূর্ব গান, চোদ্দো বছরের রবি:
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ–
পরান সঁপিবে বিধবাবালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন,
জুড়াবে এখুনি প্রাণের জ্বালা।।
একটু থামে জ্যোতি। তারপর বলে, মেজবউঠান, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নতুন সূর্য উঠছে। সেই সূর্য উঠলে আমাদের কাউকেই আর দেখা যাবে না। সেই সূর্যের চাঁদ হবে কাদম্বরী। সূর্যের আলোই হবে তার আলো। এইটুকু বুঝেছি। আর বুঝেছি, সূর্য তার আলোর অধিকার শুধুমাত্র তার চাঁদকেই দেবে।
(চলবে)
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ২৬: আমারও খুব ইচ্ছে বউঠান, পাঁচালির দলে ভর্তি হয়ে গ্রামে গ্রামে মনের আনন্দে গেয়ে বেড়াই
মেজবউঠাকরুণ ২৫: জ্ঞানদা প্রথম মা হল একটি মৃত সন্তান প্রসব করে!
মেজবউঠাকরুণ ২৪: কাদম্বরীকে ‘নতুন বউঠান’ বলে উঠল সাত বছরের রবি
মেজবউঠাকরুণ ২৩: ঠাকুরপো, তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি ছাদে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে!
মেজবউঠাকরুণ ২২: কাল থেকে আমিও রবির মতো একা হয়ে যাব না তো ঠাকুরপো?
মেজবউঠাকরুণ ২১: জ্ঞানদার মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা!
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর