হিন্দি সিনেমা তখন যাবতীয় সাংস্কৃতিক বাধা টপকে কিশোর মনকে একটু একটু করে ধুনকি দিচ্ছে নেশার। ১৯৭৮-এর ওই ‘ডন’, যে লাল ডায়েরি নিয়ে লোফালুফির ক্লাইম্যাক্সে শেষ হয়েছিল, এই ‘ডন’ তো তা নয়। এক দাদা বলল, ক্লাইম্যাক্সে চমক আছে। সেই চমক দেখতে গিয়েই কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! ‘আজ কি রাত, হোনা হ্যায় কেয়া’-র সুরে রুপোলি পোশাকে ঝকমকে গোলকের ওপর বসে নেমে আসছেন যখন প্রিয়াঙ্কা, অস্থির হয়ে উঠছি একটু একটু করে। বড়ও হচ্ছি।
৩৮.
‘গ্লোব’ আর ‘নিউ এম্পায়ার’-এ শতাব্দীর শুরুতেই মুক্তি পাচ্ছে ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোজফার্স/সরসরার্স স্টোন’। বাংলা সংবাদপত্রে হইহই রব উঠেছিল। ছোটদের কল্পনাশক্তির কী সর্বনাশ হতে চলেছে, তা নিয়ে তখন ভয়ংকর দুশ্চিন্তা! এর কয়েক বছর আগে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘নবীগঞ্জের দৈত্য’, ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’ হয়ে এল পর্দায়, খোদ তপন সিংহ-র হাত ধরে, আর হ্যারি পটারের কয়েক বছরের মাথায় বাংলায় এল ‘পাতালঘর’। বাংলা ছবিতে অমন বিস্ময় আর আসেনি! তখন ট্রেলার তো আর ইউটিউব বা ফেসবুকে দেখা যেত না। ফলে টিভিতে যা হত, তা ছিল এককথায়, ছবির বিজ্ঞাপন। মনে আছে, ক্লাস থ্রি-র আমি সেই বিজ্ঞাপনেই মোহিত হয়ে মিত্রা-য় গেলাম সে-ছবি দেখতে। মোটামুটি হাউসফুল সেই হল যে খুব উচ্ছ্বসিত হল, তা নয়, কিন্তু আমরা যারা ‘পাতালঘর’-এর পুনরাবিষ্কার করলাম, তারা তো জানি, কোথাও হ্যারি পটারের থেকে অন্তত আত্মায় পিছিয়ে নেই এই ছবি। কিন্তু হ্যারি পটার আমাদের ওপর প্রবল জাদুটোনা করল। তার সঙ্গে জুড়ল টোবি ম্যাগুয়ার অভিনীত সোনি-র ‘স্পাইডারম্যান’ ফ্র্যাঞ্চাইজি, ২০০২ সালে। কির্স্টেন ডানস্ট যখন দেওয়াল থেকে উল্টো হয়ে ঝুলে পড়া স্পাইডারম্যানকে চুমু খায়, আমরা একটু লজ্জা পেয়ে যাই। মুক্তি পাচ্ছে ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’-ও। ব্যাটম্যানের অ্যানিমেটেড সিরিজ তো ছিলই, সঙ্গে ‘ব্যাটম্যান’, ‘ব্যাটম্যান ফরএভার’, ‘ব্যাটম্যান অ্যান্ড রবিন’, ‘ব্যাটম্যান রিটার্নস’-রাও এসে পৌঁছচ্ছে শৈশবের দোরগোড়ায়। তখনও নোলান ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’ বানাননি। ‘ফ্যান্টাসটিক ফোর’ ছিল, ছিল বইমেলায় টিনটিন, অ্যাসটেরিক্সরা। টিনটিনের অ্যানিমেশন তখন বাংলায় ডাবিং হয়ে দেখানো হয় টেলিভিশনে। শিশু-কিশোর পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তখন কাকাবাবু-অর্জুন-মিতিনমাসিদের পাশেই জায়গা করে নিচ্ছে আকিদা, দীপকাকুরা। হায়রোগ্লিফিক্সে লেখা ডায়েরির সংকেতের পাশাপাশি পেসমেকারে বসানো গোপন রেকর্ডার, চোরাশিকার চক্রের পাশে সিনাগগের রহস্য, কমিকসে আঁকা গোখরো দ্বীপের রহস্যর পাশেই শঙ্কু, ফেলুদারা ছিলই, কখনও বা ছিল সব্যসাচী সরকারের কলমে দুর্ধর্ষ স্পোর্টস থ্রিলার, ‘জিকো ও রাহুল দ্রাবিড় টেন’, আবার সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকাজোখা ও লেখায় কোয়ার্কি থ্রিলার কমেডি রাপ্পা রায়ও চলে আসবে কিছুদিন পরেই। অনীশ দেবের ‘তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট’ চলছে পরের পর পূজাবার্ষিকীতে, আবার কিশোর প্রেমের উপন্যাসও ঠাঁই করে নিচ্ছে, কানজোড়া একটু লাল করে দিয়ে। মতি নন্দীর কলাবতী, বা সন্তু, ঝিনুক, টুপুররা তখন কেবলই শিশুপাঠ্যে আর আটকে থাকছে না, স্যাটেলাইট ছাড়াও, তারা তো কিশোরও বটে!
এমন নানা রংয়ের মাঝে, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-র সূত্রে পর্দায় ফেলুদা আসছে। সেই ছবি নিয়ে উত্তেজনাও থাকছে চরমে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভিলেনকে ফেলুদা না-হয় পরাস্ত করছে, কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ড কিন্তু আদৌ অত সহজভাবে আসছে না হিন্দি ছবিতে। কিন্তু ফ্যান্টাসির এক অন্য স্রোত তো বয়ে যাচ্ছিলই সমান্তরালে, নব্বইয়ের সব পেলবতা সঙ্গে নিয়ে। স্টার গোল্ডে যখন ‘কাল হো না হো’ দেখছি আমরা, তখন ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ অনুরাগ কাশ্যপের প্রথম ছবি ‘পাঁচ’। হিংসা ও যৌনতা, দুইই সেখানে খাপখোলা। লাশ কেটে বম্বের চিলের খাবার জোগানো, রাগের মাথায় কন্ডাক্টরকে বাস থেকে নামিয়ে রড দিয়ে পেটানো যে বেপরোয়া তরুণদের অনুরাগ দেখাচ্ছেন, তারা তখন কিন্তু এনআরআই শাহরুখ খানের দুঃখে কাতর! মার্কিন মুলুকের ঝলমলে চেহারায় তখন মিশে যাচ্ছে শঙ্কর মহাদেবন, এহসান নুরানি ও লয় মেন্দোনসার সুরে, সোনু নিগমের আশ্চর্য ওই কণ্ঠে, ‘হর পল ইয়াঁহা/ জি ভর জিও/ জো হ্যায় সামা/ কাল হো না হো’… বান্ধবীর থেকে শোনা, তাদের শহরতলির বাড়ির ভিআরএস-এর ক্যাসেটে বাজত ‘কাল হো না হো’। অঙ্ক করতে করতে ডায়লগ, গানসমেত মুখস্থ হয়ে যেত সেই ছবি। অঞ্জন দত্তর গানে শোনা ‘টিভি দেখো না’-র আবেদন হুকুম হয়ে তো সব বাড়িতেই ছিল, তাই শোনাই সই। স্কুলের পর কোচিং, মাঝে হেদুয়ায় সাঁতার কাটা, খেলাধুলোর বিকেল ফুরিয়ে আসা ক্রমশ, স্কুল ফুরিয়ে কলেজে উঠে যাওয়া, কেরিয়ারের জন্য ছেড়ে দেওয়া গিটার বা হ্যান্ডিক্যাম তখন চুবে থাকে বিষাদ অপেরায়। আবার ‘ইটস দ্য টাইম টু ডিস্কো’, ‘প্রিটি ওম্যান’-ও বেজে উঠছে ছন্দে ছন্দে। পেপসির বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাচ্ছে মুখ। ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টিম তখন বিজ্ঞাপনের সূত্রে সবসময় ছোটপর্দায়। সৌরভ-শচিন-দ্রাবিড়ের পাশে শেহবাগ-যুবরাজদের নাম আর স্টিকারে তখন ছেয়ে যাচ্ছে পাড়ার দেওয়াল, পেনসিল বক্স; বেঞ্চের ওপর কম্পাসের জলদাগ। প্রীতি জিন্টা বা শাহরুখ খান বা সইফ আলি খান বা করিনা কাপুরদের চেয়ে বিনোদনের চেয়ে মাত্রায় কোথাও খাটো ছিল না ক্রিকেটারদের গ্ল্যামার! বিজ্ঞাপন, সিনেমা, খেলা মিশে যাচ্ছে।
তবে, সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘দেবদাস’-এর পর উত্তর কলকাতার পাড়ায় যে চমকপ্রদ দৃশ্য দেখা গেল, তাতে গ্ল্যামারের সংজ্ঞা অবশ্য ঘেঁটে যেতে বাধ্য। ‘শাহরুখ খান ফ্যানস ক্লাব’-এর মিছিলে দেখা গেল, একদিকে, শাহরুখ খানের তাসা, অন্যদিকে শরৎচন্দ্রর! সর্বকালের সফলতম প্যান ইন্ডিয়ান বাংলা উপন্যাসটির লেখক, কথাসাহিত্যিক হিসেবে ‘পপুলার’ বর্গেই যাঁকে ফেলা হয়েছে আজীবন, নব্য ভারতীয় সুপারস্টারের পাশে তাঁর গ্ল্যামার একচুলও কমেনি, বরং গ্রেগ চ্যাপেল-রবি শাস্ত্রীদের ওপর খাপ্পা, কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার বাঙালির ছাতিই ফুলিয়েছিল তা। শরৎচন্দ্রর কাহিনি যখন সঞ্জয় লীলার গ্র্যাঞ্জারে ও সুরে কেঁপে উঠল বড়পর্দায়, মাধুরী-ঐশ্বর্য হয়ে উঠলেন জীবন্ত সোনার দোকানের বিজ্ঞাপন, শুধু ‘দোলা রে দোলা রে’-র দৃশ্যায়ন বা দেবদাসের মৃত্যুদৃশ্যে পারোর দৌড়ে আসার ক্লাইম্যাক্সেই যখন পয়সা উসুল হল, তখন কোন অকৃতজ্ঞ শরৎচন্দ্রকে ক্রেডিট না দিয়ে পারে?
ওদিকে কলেজে কলেজে চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, ফসিলস-এর পাশাপাশি ‘ক্যাহ দো না, ক্যাহ দো না, ইউ আর মাই সোনিয়া’ বেজে উঠছে ফেস্টে ফেস্টে, হৃত্বিক-করিনার পুহ আর রোহন (‘কভি খুশি কভি গম’) জুটির নকলনবিশি যেমন চলছে, তেমন ‘ম্যায় হুঁ না’-র শাহরুখ, মেজর রাম তার দেশাত্মবোধ ছাপিয়ে উঠে হয়ে যাচ্ছে আদর্শ কলেজছাত্র। এর মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর বা চেন্নাই বা মুম্বই রওনা দেওয়ার ধুম লেগেছে, চাকরি বড় বালাই। ভেঙে যাচ্ছে কত ব্যান্ড, শখের নাট্যদল। মফসসলের এককোণে ধুলো খাচ্ছে সাইকেলের সারি। কলকাতায় এসে অকুলপাথার হাতড়াতে হাতড়াতে কেউ পেয়ে যাচ্ছে মেনকা বা মিত্রায় কালীপুজোর সময় ‘বীর জারা’ দেখার সঙ্গী। আবার কেউ কেউ ‘ইয়াদেঁ’ বা ‘কভি খুশি’ দেখে হৃত্বিকের জোরালো ফ্যান হয়েছে! কমনরুমে নতুন মুখ আসে, নতুন তর্ক দানা বাঁধে, হৃত্বিক না শাহরুখ? ‘তেরে নাম’, যার সংলাপ লিখলেন কি না অনুরাগ কাশ্যপ, অনেক হিসেবই ঘেঁটে দিয়েছিল। ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ দেখার স্মৃতি নিয়ে আমির-সলমনের মধ্যে আমিরকেই পছন্দ করেছিল এক কলেজছাত্রী, তাই তার সদ্য প্রেমিক যেদিন নিউ মার্কেট থেকে তেরে নাম-এর সলমন স্টাইলে চুল কেটে এল, সেদিনই ওই প্রেমের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল- স্কুলপড়ুয়া আমরা তখন চারপাশে কানাঘুষোয় এসব কথা শুনি।
তার মাঝেই কিঞ্চিৎ ছোটদের জন্য এল ‘ইটি’-র নকল, জাদু, রাকেশ রোশনের হাত ধরে। ‘কোই মিল গয়া’ হলে দেখতে যাওয়ার বায়না করেও বিশেষ লাভ হয়নি। তাই অগত্যা টিভিতেই দেখা, স্টার গোল্ডে। ‘গডজিলা’-র হিন্দি ডাবিং দেখার চেয়ে সেই উত্তেজনা একটু আকাঁড়াই ছিল, নিঃসন্দেহে। তা চল্লিশগুণ বাড়ল, যখন ভারতীয় সুপারহিরো একেবারে হলিউডি কায়দায় এল। ‘কৃশ’-এ বিদেশ বলতে সিঙ্গাপুর। কিন্তু ‘মিন্নাল মুরালি’-র বহু আগে, স্থানীয় সুপারহিরোর অমন ঝকঝকে জেল্লা, কিছুটা জোরোর মতো চেহারা, আবার কিছুটা সুপারম্যানীয় নানা সূত্র মেনে আম বাচ্চাদের ভালই ভড়কি দেওয়া গিয়েছিল। এসব ছবি মূলত, লিঙ্গছক মেনে, বয়েজ স্কুলের ছেলেরাই দেখত বেশি। কারণ সুপারহিরো নিয়ে উত্তর কলকাতার গার্লস স্কুলে অতটাও হুড়ুমদাড়ুম ছিল না। বরং, মেয়েরা একটু পরিণতই ছিল!
ছেলেরা যখন ‘কৃশ’-এর প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে চলেছে, তখন সহপাঠিনীরা দিব্য বাবা-মায়ের অনুমতিসাপেক্ষে, দাদা-দিদি সমভিব্যহারে দেখে এসেছে ‘ধুম টু’। প্রথম থেকেই ‘ধুম’ ফ্র্যাঞ্চাইজি একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে যে, একথা বোঝা যেত লরির হর্ন শুনলেই। কিন্তু ‘ধুম’-এর জন আব্রাহাম, স্টাইলে ও কায়দায় যে চমক দিয়েছিলেন, ‘ধুম টু’-তে তা সম্পূর্ণ হয়ে উঠল হৃত্বিক-ঐশ্বর্যর ওই অদম্য যৌথ যৌন আবেদনে। ‘কৃশ’-এর প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে আমাদেরও খানিক উত্তেজনা বাড়ল, যখন ‘ডন’ রিলিজ করল। করিনা কাপুরের নাচে ‘ইয়ে মেরা দিল’ আমাদের টলাল খানিক, কিন্তু প্রিয়াঙ্কা তখন পর্দায় যতবার আসছেন, খোলা তলোয়ারে যেন রোদ ঝলসাচ্ছে। তখন কোথায় শাহরুখ-প্রিয়াঙ্কা প্রেমের গুঞ্জন! শ্যামবাজারের ফুটপাথ থেকে কেনা সত্তর টাকার ডিভিডি-তে তখন ‘ডন’, ‘ধুম টু’-সহ ছটা হিন্দি ছবি। বাবা-মা হয়তো ‘গানস অফ নোভারন’, ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’-এর সিডি কিনে দিচ্ছে, বা ভাবছে ছটফট করব পিটার জ্যাকসনের ‘কিং কং’ দেখব বলে। কিন্তু সেখানেও অ্যাড্রিয়ান ব্রডি আর নাওমি ওয়াটস, ওই কিং কং ও ডাইনোসর গ্যাংয়ের ক্যালাকেলি ছাপিয়ে, বিঘৎ সাইজের মাকড়সা-মৌমাছিদের পাশ কাটিয়ে রঙিন হয়ে উঠছে। কিন্তু হিন্দি সিনেমা তখন যাবতীয় সাংস্কৃতিক বাধা টপকে কিশোর মনকে একটু একটু করে ধুনকি দিচ্ছে নেশার। ১৯৭৮-এর ওই ‘ডন’, যে লাল ডায়েরি নিয়ে লোফালুফির ক্লাইম্যাক্সে শেষ হয়েছিল, এই ‘ডন’ তো তা নয়। এক দাদা বলল, ক্লাইম্যাক্সে চমক আছে। সেই চমক দেখতে গিয়েই কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! ‘আজ কি রাত, হোনা হ্যায় কেয়া’-র সুরে রুপোলি পোশাকে ঝকমকে গোলকের ওপর বসে নেমে আসছেন যখন প্রিয়াঙ্কা, অস্থির হয়ে উঠছি একটু একটু করে। বড়ও হচ্ছি।
এই বড় হওয়া আটকাতেই যদিও ‘টাইটানিক’ দেখতে দেওয়া হত না আমাদের। কোন দৃশ্য নিয়ে বড়দের আদত আপত্তি, বুঝতে সময় লেগেছে। নাহলে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও-কেট উইন্সলেটের অমন অপূর্ব চুম্বনদৃশ্যটাকেও অশ্লীল ভেবে বসতুম।
‘ফিল্মফেয়ার’-এর ‘৯৮ সালের একটি সংখ্যায় ‘সেক্স সিম্বল’ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে রামগোপাল ভার্মা বলেছিলেন উর্মিলা মার্তণ্ডকরের কথা। ‘দাউদ’-এর উর্মিলা-সঞ্জয় দত্ত জুটিতে উর্মিলা কিন্তু ছিলেন কিঞ্চিৎ বেশি পুরুষালিই। প্রথম পরিচয়ে সঞ্জয় দত্তকে তার চরিত্র বলে, তার নাম দয়াশঙ্কর, সঞ্জয় দত্তর চরিত্র উত্তর করে, তার নামও উমা পার্বতী। এহেন উর্মিলা কিন্তু বিশ্বায়িত বলিউডের ছক ভাঙছেন। ‘ফিল্মফেয়ার’-এর ‘লাভিং ডেঞ্জারাসলি ২০০০’-এ তিনি সোচ্চারে তাই বলতে পারেন, ‘মোস্ট মেন আর ইজি টু আন্ডারস্ট্যান্ড, লাইক শোভা দে, আই কুড রাইট আ বুক কলড সারভাইভিং মেন উইদাউট ডিফিকাল্টি।’ নারীবাদী বলে তকমা দেওয়া না গেলেও, গ্লোবাল ভিলেজের গেঞ্জি-জাঙিয়া থেকে শুরু করে পারফিউমের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত ‘মাচো’ পুরুষের যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তার বিপ্রতীপে অমন সাহসী উপস্থিতি যে সে ঘটনা ছিল না। অন্যদিকে ছিল মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্সের ছকে ফেলা সুন্দরীর ধারণা। কিন্তু সুস্মিতা সেন আর ঐশ্বর্য রাই বলতেই অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় যতই হোক, তাঁরাও এই ধারণাকে নিজেদের শর্তেই নির্মাণ করছেন, নতুন করে। বদলের সূত্র দানা বাঁধছে। যদিও শান্তনু চক্রবর্তী দেখাচ্ছেন, ‘বিশ্বাত্মা’, ‘ইজ্জত কি রোটি’-র সানি দেওল ধীরে ধীরে আধুনিক নারীকে সবক শেখানোর গ্রাম্য পুরুষসিংহর চরিত্রে কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। কিন্তু এসবের মধ্যেই ভাঙছে বিষমকামী প্রেম নিয়ে ট্যাবুও। দুই মহিলা নির্দেশকের দু’টি ছবি সেই নয়ের দশকের শেষেই ভেঙেছিল অচলায়তনের অন্তত কিছুটা প্রাচীর। মীরা নায়ারের ‘কামসূত্র’ ও দীপা মেহতার ‘ফায়ার’। বিতর্ক উসকে দেওয়া ওই দু’টি ছবিই যৌনতা নিয়ে পিপুফিশু ট্যাবু ভাঙল। সমকামিতাকে সরাসরি ঠাঁই দিয়ে ‘ফায়ার’ সততই আগুন জ্বালাল। হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি হজম করতে হল শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশকেও। এর ঠিক তিন বছরের মাথায় অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’-এ শাশুড়ি-বউমার সমপ্রেমের ইঙ্গিত নিয়ে তুমুল তর্ক উঠল। প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের গোড়ার দিকেই অনিল খান্না তাঁর একটি নিবন্ধে দেখিয়েছিলেন, শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কে আনুগত্যের নিগড় ভাঙার গল্প একটু একটু করে উঠে আসছে বলিউডে। এরও পাঁচ বছর পর ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ বানালেন অনির। যদিও ঋতুপর্ণ ঘোষদের হাত ধরে সমপ্রেমী ছবির রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে তখনও ঢের বাকি।
যৌনতার রাজনীতির সেই বদল যদিও আমরা অত বুঝিনি তখন। আমাদের শৈশব থেকে আমাদের সদ্য বয়ঃসন্ধি গোধূলির মতোই রাঙা হয়ে উঠেছে বারবার।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৭। টুইন টাওয়ার ভাঙছে, ভাঙছে পরম্পরা, প্রতিষ্ঠা, অনুশাসনও…
পর্ব ৩৬। একদিকে মনকেমন, অন্যদিকে খুনখারাপি! বলিউডের আলো-অন্ধকারে ফুরল শতাব্দী
পর্ব ৩৫। অ্যাংরি ইয়ংম্যান থেকে বিলেতফেরত মাচো নায়ক, বদলাচ্ছিল নব্বইয়ের হিরোরা
পর্ব ৩৪। বিস্ফোরণ আর বিভেদের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন মহব্বত ম্যান
পর্ব ৩৩। অমর চিত্রকথা, চাচা চৌধুরী ও ইরোটিকার পৃথিবীতে এসে পড়ল তরুণ বেপরোয়া নায়কদের দিন
পর্ব ৩২। নব্বইয়ের শুরু থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড ঢাকা পড়ল বলিউডের তাজমহলে
পর্ব ৩১। ফুলন দেবীর বন্দুক ও ‘মির্চ মসালা’-র প্রতিরোধ
পর্ব ৩০। স্কুল থেকে শ্মশান, সর্বত্র শোনা গেছে ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’
পর্ব ২৯। ‘ক্যায়ামত’ না আসুক, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ঠিক বুঝেছে এসটিডি বুথ, একা অ্যান্টেনা
পর্ব ২৮। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দিন জনশূন্য কলকাতায় পকেটমারি
পর্ব ২৭। মাস্টারমশাইরা কি আজও কিচ্ছু না দেখেই থাকবে?
পর্ব ২৬। ‘হাওয়া হাওয়াই’য়ের আপত্তি জোটেনি কিন্তু ‘উরি উরি বাবা’ নাকি অপসংস্কৃতি
পর্ব ২৫। চুল কাটলেই মাথার পিছনে জ্যোতির মতো বাজবে ‘শান’-এর গান!
পর্ব ২৪। মরণোত্তর উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন সিরিয়াল কিলার
পর্ব ২৩। স্কুল পালানো ছেলেটা শহিদ হলে টিকিট কাউন্টার, ব্ল্যাকাররা তা টের পেত
পর্ব ২২। ক্যাবলা অমল পালেকরের চোস্ত প্রেমিক হয়ে ওঠাও দর্শকেরই জয়
পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল
পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল