Robbar

সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 27, 2024 9:05 pm
  • Updated:April 2, 2024 5:03 pm  

‘ভালো’ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। তাই যা ‘ভালো’, তার প্রার্থনা আসলে ত্যাগের প্রার্থনা, দুঃখের প্রার্থনা। মানুষের পক্ষে ‘ভালো’ সহজ নয় কেন? কেননা, মানুষ একইসঙ্গে পশু আর মানুষ দুই-ই। একই সঙ্গে দুটি ক্ষেত্রে মানুষকে বিচরণ করতে হয়। ক্ষেত্র-দুটি এতটাই বিপরীতমুখী, তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটানো সহজ নয়। একার জীবনে, সারাটা জীবনই মানুষকে এই সামঞ্জস্যের সাধনা করতে হয়।

অভীক ঘোষ

৩.

আগেই বলেছি, ‘ওঁ পিতানোহসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্তু’ যজুর্বেদের এই মন্ত্রটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই তাঁর উপদেশ-ভাষণে বা ব্যাখ্যানে আলোচনা করেছেন। মন্ত্রটিকে আশ্রমের প্রতিদিনের প্রার্থনার মন্ত্র রূপে বেছে নিয়েছিলেন বলেই হয়তো বারবার এর অর্থটিকে সকলের কাছে স্পষ্ট করে তোলা প্রয়োজন মনে করতেন। ‘দ্বিধা’ শিরোনামের একটি ভাষণে স্পষ্টই বলেছেন, ‘যদভদ্রং তন্ন আসুব– যা ভালো তাই আমাদের দাও। মানুষের পক্ষে এ প্রার্থনা অত্যন্ত কঠিন প্রার্থনা।’

কেন এই প্রার্থনা অত্যন্ত কঠিন? কারণটি খুব সহজ, আর সহজ বলেই কঠিন। কারণটি হল, ‘ভালো’ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। তাই যা ‘ভালো’, তার প্রার্থনা আসলে ত্যাগের প্রার্থনা, দুঃখের প্রার্থনা। মানুষের পক্ষে ‘ভালো’ সহজ নয় কেন? কেননা, মানুষ একইসঙ্গে পশু আর মানুষ দুই-ই। একই সঙ্গে দু’টি ক্ষেত্রে মানুষকে বিচরণ করতে হয়। ক্ষেত্র-দু’টি এতটাই বিপরীতমুখী, তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটানো সহজ নয়। একার জীবনে, সারাটা জীবনই মানুষকে এই সামঞ্জস্যের সাধনা করতে হয়। সমবেত জীবনেও যত কিছু অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সবকিছুই এই চিরকালীন দ্বন্দ্বের সমন্বয়ের চেষ্টা। এই দ্বন্দ্বই মানুষের দুঃখের কারণ, আর দুঃখ মানুষের উন্নতির প্রেরণা।

পশুর জগতে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল দু’টি বিচ্ছেদ, যা উদ্ভিদের জগতে নেই। প্রথম বিচ্ছেদ, পাকস্থলীর সঙ্গে আহার্যের বিচ্ছেদ। দ্বিতীয় বিচ্ছেদ, স্ত্রী-পুরুষের বিচ্ছেদ। প্রথম বিচ্ছেদটি ঘোচানোর দুঃখের তাগিদে পশুর বুদ্ধি শক্তি জেগে থাকে আর দ্বিতীয় বিচ্ছেদটি সৃষ্টি করে চলে বিচিত্র বীরত্ব আর সৌন্দর্যের লীলা। পশুর জগতের এই দুই দ্বন্দ্বের সঙ্গে মানুষের আরও একটি দ্বন্দ্ব তার মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি আর আত্মার দ্বন্দ্ব। স্বার্থের দিক আর পরমার্থের দিক, বন্ধনের দিক আর মুক্তির দিকের বিচ্ছেদ ঘোচানোর দুর্গম পথে যে নিদারুণ দুঃখ মানুষকে স্বীকার করতে হয়, পশুরা তা কল্পনা করতে পারে না। পশুদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের দুঃখ নেই, তারা কেবলমাত্র পশু। কেবলমাত্র শরীর ধারণ আর বংশবৃদ্ধিতেই পশুজন্মের সার্থকতা। মানুষ একদিকে শুধুমাত্র নিজের, অন্যদিকে সে বিশ্বের। একদিকে তার সুখ, আর-এক দিকে তার মঙ্গল। সুখভোগের মধ্যে মানুষের সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া যায় না। গর্ভের মধ্যে ভ্রূণের মতো। গর্ভের মধ্যে ভ্রূণ আরামে থাকে, কিন্তু, তার আপাত-অনর্থক ইন্দ্রিয় আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপস্থিতি থেকে সহজে অনুমান করা যায়, আরামের অন্ধকারবাস নয়, আলোকের মধ্যে মুক্তিতেই তার পরিণাম। মানুষের সমস্ত স্বার্থবিরোধী প্রবৃত্তি তেমনি বুঝিয়ে দেয়, সুখভোগের বন্ধ-আরামশয্যায় নয়, উন্মুক্ত মঙ্গলালোকেই মানুষের পরিণাম।

Encounters with Tagore - The Statesman

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আকাশে প্রান্তরে সর্বত্র রঙিন সৌন্দর্যের অবিরাম প্রবাহ, নক্ষত্রলোকের আলোকসজ্জায় সাজানো রাতের আকাশ, ফলে শস্যের বৈচিত্রে রসনাতৃপ্তির আয়োজন, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালনায়, কাজে, চিন্তায়, আত্মপ্রকাশে, আনন্দের যেন অন্ত নেই। অন্যদিকে, সুখের আয়োজনের মধ্যে যখন আমরা নিঃশেষে প্রবেশ করতে চাই, তখনই যেন পিতার নির্দেশ আসে, ‘তোমাকে বদ্ধ হতে দেব না। এই-সমস্ত সুখের সামগ্রীর মধ্যে ত্যাগী হয়ে, মুক্ত হয়ে তোমাকে থাকতে হবে, তবেই এই আয়োজন সার্থক হবে।’

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

গর্ভের শিশু মাতার গর্ভের আবরণ থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই নিজেকে জানে, তখনই তার মাকেও জানে, তার আগে নয়। আমরাও স্বার্থের আবরণ থেকে বেরোতে পারলে তবেই পরিপূর্ণভাবে স্বার্থকে লাভ করতে পারি। নিজেকে সত্য করে পেয়ে তখনই অন্য সমস্তকে পেতে পারি। যতক্ষণ স্বার্থের নাড়ি কেটে মঙ্গলালোকের মধ্যে জন্মাতে না পারি, ততক্ষণ আমাদের বেদনার শেষ নেই। লোভনীয় মনে করে যা কিছু কামনা করি, তাতেই নিজেকে আবদ্ধ করি। ক্ষণস্থায়িত্বের আবরণের মধ্যে চিরদিন স্থিতির চেষ্টা করি। তখন অসম্পূর্ণতার বেদনার আঘাত নেমে আসে। তখন পিতার কাছে কামনা করি ‘মা মা হিংসীঃ, আমাকে আঘাত কোরো না’, বুঝতে পারি না এ আঘাত পিতারই হাতের আঘাত, এ মঙ্গললোকের আকর্ষণেরই বেদনা। সেইজন্যই ‘যদভদ্রং তন্ন আসুব– যা ভালো তাই আমাদের দাও।’ এ প্রার্থনা অত্যন্ত কঠিন প্রার্থনা। এ আমাদের ত্যাগের প্রার্থনা, দুঃখের প্রার্থনা, নাড়িছেদনের প্রার্থনা। এই কঠোর প্রার্থনা মানুষ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সংসারে পিতা ও মাতার ভেদ আছে কিন্তু বেদের মন্ত্রে যাকে পিতা বলে নমস্কার করছে, তার মধ্যে পিতা ও মাতা দুইই এক হয়ে আছে। তাই তাঁকে কেবল পিতা বলেছে।’ একথাও বলছেন, সন্তানের প্রতি স্নেহে, তার সুখের আয়োজনে, মাতা যেন ‘একটি বৃহত্তর গর্ভবাস’ তৈরি করতে চান। অন্যদিকে, পিতার যেন প্রধান কর্তব্য থাকে ‘কঠোর শিক্ষার ভিতর দিয়ে পুত্রকে মানুষ করে তোলা’। বড় হয়ে ওঠার জন্য যে দুঃখ, সন্তানকে তার পরিচয় পেতে হয় প্রধানত পিতার কাছে। ‘ঈশ্বরের মধ্যে এই মাতা পিতা এক হয়ে আছে।’ একদিকে আমাদের সুখের আয়োজনে জগৎ পূর্ণ। আকাশে প্রান্তরে সর্বত্র রঙিন সৌন্দর্যের অবিরাম প্রবাহ, নক্ষত্রলোকের আলোকসজ্জায় সাজানো রাতের আকাশ, ফলে শস্যের বৈচিত্রে রসনাতৃপ্তির আয়োজন, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালনায়, কাজে, চিন্তায়, আত্মপ্রকাশে, আনন্দের যেন অন্ত নেই। অন্যদিকে, সুখের আয়োজনের মধ্যে যখন আমরা নিঃশেষে প্রবেশ করতে চাই, তখনই যেন পিতার নির্দেশ আসে, ‘তোমাকে বদ্ধ হতে দেব না। এই-সমস্ত সুখের সামগ্রীর মধ্যে ত্যাগী হয়ে, মুক্ত হয়ে তোমাকে থাকতে হবে, তবেই এই আয়োজন সার্থক হবে।’

সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল। এই মঙ্গলবোধই মানুষকে সুখের মধ্যে স্থির থাকতে দেয় না। সমস্ত খাওয়া-পরার কান্না ছাড়িয়ে আনন্দে নত হওয়ার জন্য কান্না ওঠে। সে কান্না একান্তই মানুষেরই কান্না। নিজের দিকে সবকিছু টানার প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে তোমার দিকেই যেন নত হতে পারি, সমগ্রের মধ্যে যেন নিজেকে সমর্পণ করতে পারি।

মানুষের সাধনা তাই নমস্কারের সাধনা। নমস্তেহস্তু। নমস্কারটি কেমন নমস্কার? ‘নমঃ সন্তবায় চ ময়োভবায় চ– সুখকরকেও নমস্কার, কল্যাণকরকেও নমস্কার। মাতারূপেও তোমাকে নমস্কার, পিতারূপেও তোমাকে নমস্কার। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ– সুখের আকর যিনি তাঁকেও নমস্কার, মঙ্গলের আকর যিনি তাঁকেও নমস্কার।’ সীমার মধ্যে ধারণ করে পালন করছেন যিনি তাঁকেও নমস্কার, বন্ধন ছিন্ন করে অসীমের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন যিনি তাঁকেও নমস্কার। অবশেষে সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয় যখন সুখ আর মঙ্গলে ভেদ থাকে না, বিরোধ থাকে না। শিব আর শিবতর তখন এক। পিতা-মাতা এক হয়ে সমস্তই শিব, সমস্তই শুভ, সমস্তই মঙ্গল। তখনই সত্য হয়ে ওঠে মানবজীবনের চরম নমস্কার।

…………………………………………………………………………………………………………………………………….

উপাসনাগৃহ। প্রথম পর্ব। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই

উপাসনাগৃহ। দ্বিতীয় পর্ব। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব