যুদ্ধক্ষেত্রে যে যাচ্ছে, যে বাড়ি ছেড়ে আসছে, সে যে নিতান্ত এক সাধারণ মানুষ। তার কি মৃত্যুভয় নেই? সে কি ভয় পাচ্ছে না বাড়ি ছাড়তে? সৈনিকের পোশাক পরতে? উইলফ্রেড আওয়েনের সেই ‘ফিউটিলিটি’ কবিতাটার কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে সৈনিকের মনটা ধরা পড়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে কি আদতে তা-ই অনুভব করে কোনও কোনও সৈনিক? কোনও বীরকে নিয়ে নয়, বরং যুদ্ধে ভয় পাওয়া মানুষটাকে নিয়েই ডন ম্যাকলিনের এই গান।
৪.
দ্য গ্রেভ, ডন ম্যাকলিন, ১৯৭১
যুদ্ধবিরোধী গান কী? যা শুধুই যুদ্ধের বিরোধিতা করে? সাধারণ মানুষের ছিঁড়েখুড়ে যাওয়ার কথাও কি বলে না সে গান? কী করে একটা যুদ্ধের ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, সেটা জানানোও কি যুদ্ধবিরোধী গানেরই কাজ নয়? যুদ্ধ যে ধনী মানুষদের আরও ধনী হওয়ার উপায়, গরিব মানুষের আরও দারিদ্রে তলিয়ে যাওয়ার নিয়তি, তাও কি যুদ্ধবিরোধী গীতিকারের বিষয় নয়?
একুশ শতকে যুদ্ধ বলতে আরও একটা ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সেটা হল পারমাণবিক বোমার ভয়। কী হবে কোনও শক্তিশালী রাষ্ট্র যদি ক্ষমতা প্রদর্শনে বোমা নিক্ষেপ করে? কিন্তু আজ যে গানটা নিয়ে কথা বলব, সেই গানটার দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে আলাদা। গানটির লেখক ও সুরকার ডন ম্যাকলিন, গানটির নাম ‘দ্য গ্রেভ’। ডন ম্যাকলিন যে প্রচুর প্রতিবাদী গান লিখেছেন, তা নয়। কিন্তু তাঁর বহু গানেই প্রতিবাদের, প্রতিভাষের আভাস আমরা পেয়ে থাকি। উনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনে কখনও সরাসরি যোগদান করেননি, কিন্তু তিনি চোখ ঘুরিয়েও বেঁচে থাকেননি, খুব সূক্ষ্মভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, হানাহানির বিপক্ষে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন। পিট সিগার তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে, একসঙ্গে গানবাজনা করতে, প্রতিবাদী স্বরকে আরও জোরদার করতে। কিন্তু তিনি একা, স্বতন্ত্রভাবেই গান করতে চেয়েছেন। আসলে তিনি যেসময়ে বড় হচ্ছেন, সেসময় বিটলস-জমানার শীর্ষ যুগ। এসে গেছে রোলিং স্টোন, জেথরো টাল, পিঙ্ক ফ্লয়েড। আর ব্রডওয়ে মিউজিকও নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছে, জনপ্রিয়তাও বজায় রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের গান গাইছেন বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ। সেখানে ডন ম্যাকলিন একা গান, একটা গিটার কাঁধে। এক আশ্চর্য মানবিকতার বার্তা দিয়ে চলেছেন। মানবিক সভ্যতা, মানবিক সভ্যতার ব্যর্থতার কথা তিনি বলে চলেছেন, বলে চলেছেন। তিনি গাইছেন ‘ভিনসেন্ট’, যিনি বেঁচে থাকতে ভালোবাসেননি, আবার মরে যেতেও চাননি। এমন গীতিকারের যুদ্ধবিরোধী গান তো অন্য এক সুর, অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি, মাত্রাই নিয়ে আসবে।
যখনই কোথাও কোনও যুদ্ধ হয়, তা সে নিজের দেশে হোক বা অন্য দেশে, জাতীয়তাবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সৈন্যদের চাগিয়ে দেওয়ার জন্য, তাদের মনোবল দৃঢ় করার জন্য বারবার সৈন্যদের জাতীয়তাবাদের বোধের আগুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আলাদাভাবে তাদের কদর করা, আলাদাভাবে তাদের সম্মান জানানো হয়। যদি শহিদ হন, তাহলে দেশের সর্বোচ্চ পদক দেওয়া, যুদ্ধে জয়ী হয়ে এলে তিনি দেশনায়ক। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে যে যাচ্ছে, যে বাড়ি ছেড়ে আসছে, সে যে নিতান্ত এক সাধারণ মানুষ, তা আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগের মানুষটাই হারিয়ে যায়। তার কি মৃত্যুভয় নেই? সে কি ভয় পাচ্ছে না বাড়ি ছাড়তে? সৈনিকের পোশাক পরতে? উইলফ্রেড আওয়েনের সেই ‘ফিউটিলিটি’ কবিতাটার কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে সৈনিকের মনটা ধরা পড়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে কি আদতে তা-ই অনুভব করে কোনও কোনও সৈনিক? কোনও বীরকে নিয়ে নয়, বরং যুদ্ধে ভয় পাওয়া মানুষটাকে নিয়েই ডন ম্যাকলিনের এই গান।
গানটা শুরু হয় একজন সৈন্যর মৃত্যু দিয়ে। তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে সদ্য। এবং এই মৃত্যুটা যেন উৎসবের মতো। শুরুর কথাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে–
The grave that they dug him had flowers
Gathered from the hillsides in bright summer colors
গ্রীষ্মের উজ্জ্বল ফুল দিয়ে তাঁর কফিন এর চারপাশ সাজানো হচ্ছে।
And the brown earth bleached white
At the edge of his gravestone
এই মৃত্যুশোকে মাটিও শুকিয়ে গেছে। মাটিও কাঁদতে কাঁদতে জলশূন্য। মাটির এখন শুষ্ক, মাটি এখন ফসল-অসম্ভবী। ব্লিচিং পাউডার দিলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন সাদা রং ধারণ করেছে মাটি।
He’s gone
লোকটা ছিল, লোকটা চলে গেল।
গানটা এবার অতীতচারণ করবে। মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যাবে গানটা। কবরের ওপর রঙিন ফুল ছড়ানো হয়েছে। এই রঙিন ফুলগুলোকে ডন ম্যাকলিন মৃত্যুর পরিহাস হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারপর কীভাবে মৃত্যুকে ছাপিয়ে যাবে জীবন। সেদিকে তাকানো যাক।
When the wars of our nation did beckon
The man, barely twenty, did answer the calling
Proud of the trust
That he placed in our nation
এই সৈনিক কিন্তু খুব গর্বিত ছিল, বাড়ি ছাড়ার আগে, যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে। সে ভেবেছিল, দেশ তার পাশে রয়েছে, তার পাশে রয়েছে দেশজোড়া মানুষ, সকলে তাকে বীর বলছে, সকলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে কিন্তু খুব খুশি ছিল। কিন্তু দেশ কখনও কারও পাশে থাকে না, দেশ কখনও কাঁদে না, দেশ কখনও অসহায় হয় না। দেশের মানুষ কাঁদে, দেশের মানুষ অসহায় হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পাশের মানুষটা হয়তো বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু দেশ এমন কোনও সাহায্যের হাত বাড়ায় না। দেশ মৃত্যুকে ঠেকায় না।
He’s gone
But eternity knows him
And it knows what we’ve done
গানের কথা এবার যেন ফ্ল্যাশব্যাক এর মতো সেই ভয়ঙ্কর রাতের ছবি আঁকে।
And the rain fell like pearls
On the leaves of the flowers
Leaving brown, muddy clay
Where the earth had been dry
And deep in the trench
He waited for hours
As he held to his rifle
And prayed not to die
ওই রাতেও মুক্তোর দানার মতো চকচকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। সে ঝোপেও লুকিয়েছিল, তার পাশের জলের ফোঁটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
মাটি সেদিন ভিজে গিয়েছিল। মাটিও যেন কাঁদছিল। তার পাশের রাইফেলটাও শক্ত করে ধরে বসেছিল সে। মনে মনে নিজের মৃত্যু কল্পনা করে সে বেঁচে থাকার ইচ্ছেয় পরিপূর্ণ হচ্ছিল। সে আজ মরবে না, সে আজ মরতেই পারে না।
But the silence of night
Was shattered by fire
As the guns and grenades
Blasted sharp through the air
One after another
His comrades were slaughtered
In the morgue of marines
Alone, standing there
কিন্তু চারিদিকে গুলির আওয়াজ, এদিক-সেদিক গ্রেনেড এসে পড়ছে। কখনও কখনও গ্রেনেডের আগুনে আলো হয়ে যাচ্ছে চারিদিক। তার বন্ধুদের মৃত্যু সে আন্দাজ করতে পারছে। সে বুঝতে পারছে সে একা হয়ে পড়েছে, মৃত্যুর মাঝে সে একা জীবিত।
He crouched ever lower
Ever lower, with fear
They can’t let me die
They can’t let me die here!
I’ll cover myself
With the mud and the earth
I’ll cover myself
I know I’m not brave!
The earth, the earth
The earth is my grave
সে যেন নিজেই নিজের কবরে প্রবেশ করছে। সে নিজেকে মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলছে, যাতে তাকে কেউ স্পর্শ করতে না পারে। সে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে চায়, সে যুদ্ধ থেকে পালাতে চায়, সে মাটিতে ফিরে যেতে চায়। পৃথিবী তাকে গ্রহণ করো, পৃথিবী তাকে আপন করো।
কারণ আমি জানি আমি ততটাও সাহসী নই, আমি বাঁচতে চাই।
The grave that they dug him had flowers
Gathered from the hillsides in bright summer colors
And the brown earth bleached white
At the edge of his gravestone
He’s gone
কিন্তু বাঁচল না সে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধের কথা বলে এই গান, যুদ্ধের ভেতর প্রবেশ করে। যুদ্ধ থেকে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসে গানটা। আমরা নিজে থেকেই যুদ্ধবিরোধী হয়ে উঠি। আমরা যুদ্ধের ভয়াবহতা, মাটির কান্না, অকালবর্ষণ দেখেছি। আমরা মৃত্যুর সংকেত পেয়েছি। তাই আমাদের আর যুদ্ধ নিয়ে নিস্পৃহ থাকা মানায় না।
ডন ম্যাকলিন কোনও প্রবল শব্দ ব্যবহার করেননি। তাঁর কাব্যিক বিষাদ বজায় রয়েছে গোটা গানে। শহর থেকে দূরে এক সৈনিককে কবর দেওয়া হচ্ছে– এই দৃশ্যকল্প যুদ্ধের শূন্যতার সঙ্গে সঙ্গে কবির মৃত্যুকল্পনাও প্রকট করে। পাহাড় থেকে ফুল এনে তার কবরে দেওয়া হচ্ছে– এ দৃশ্য কবির বিষাদকণা।
গানটির আয়োজনের একটি বৈশিষ্ট হল এর ‘মিনিমালিস্টিক অ্যাপ্রোচ’, একটা গিটার বাজিয়ে গান করাটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ডন এক-একটা জায়গায় একদম খালি গলায় যেভাবে একটা তীব্র বিষাদ মাখা প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য যে একজন সৈনিকও আমাদের মতো মানুষ, তাকে আমরা যতই অতিমানবের আসনে বসাই না কেন।
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন