মাটি, জল, আগুন সবার সঙ্গেই আমাদের পরিচয় থাকে প্রয়োজনের সীমায় বাঁধা। তেমনই ভাবেই যে মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনের সম্পর্ক, তার ‘মানবত্ব’ও আমাদের কাছে ছোট হয়ে যায়। প্রয়োজনসাধনের উপকরণ বা যন্ত্রের মতোই আমরা তাকে দেখি। সেনাবাহিনীর সৈন্য, কারখানার শ্রমিক, অন্ন যোগানো কৃষকরা শুধু নন, অনেক সময় প্রিয়জনেরাও এইভাবে যন্ত্র হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে তাঁদের মনের খবর আমাদের আর পাওয়া হয়ে ওঠে না।
৫.
শান্তিনিকেতন আশ্রমে সকালের প্রার্থনার মন্ত্র যেমন ‘ওঁ পিতা নোহসি’। সন্ধ্যার উপাসনার জন্য রবীন্দ্রনাথ আর একটি মন্ত্র বেছে নিয়েছিলেন,
‘যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্সু যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ
য ওষধিষু যো বনস্পতিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ।’
যে দেবতা অগ্নিতে, যিনি জলে, যিনি বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন, যিনি ওষধিতে, যিনি বনস্পতিতে, সেই দেবতাকে বারবার নমস্কার করি।
তিনি যেমন আগুনেও আছেন, তেমনি জলেও আছেন। তাঁর মধ্যে আগুন আর জলের কোনও বিরোধ নেই। এক ঋতুর আয়ু যে ওষধিদের, সেই ধান-গমের মধ্যেও সেই নিত্য সত্য আছেন, যেমন আছেন সুদীর্ঘায়ু বনস্পতিদের মধ্যে। আছেন সেটা জানা এবং তাঁকে নমস্কার জানানো, সর্বত্র সর্বক্ষণ নমস্কার জানানোর সাধনার প্রকাশ এই মন্ত্রে।
রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার উপাসনায় এই মন্ত্রের কথা বলেছেন। এই মন্ত্রটি কেন তাঁর কাছে ‘বিশেষ’, তা বোঝার চেষ্টা করছি।
ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, এই কথাটা আমাদের কাছে অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তখন সেই কথার মধ্যে আর কোনও প্রাণ থাকে না। কথাটি বলার সময় আমাদের মধ্যে কোনও বোধ জেগে ওঠে না। শিখিয়ে দেওয়া অনেক কথা বা ধারণার মতো সহজে আমরা তা বলে ফেলতে থাকি। কিন্তু সর্বত্র সেই দেবতাকে নমস্কার জানাতে পারি না। আমাদের নিজেদের বোধের মধ্যে, অভিজ্ঞতার মধ্যে এই মন্ত্র সত্য হয়ে ওঠে না।
আমরা যেসব জিনিসকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করি, সবসময় ব্যবহার করলেও তার পরিচয় আমাদের প্রয়োজনটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ থেকে যায়। সম্পূর্ণ সত্য পরিচয় পাওয়া হয় না। মাটি, জল, আগুন সবার সঙ্গেই আমাদের পরিচয় থাকে প্রয়োজনের সীমায় বাঁধা। তেমনই ভাবেই যে মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনের সম্পর্ক, তার ‘মানবত্ব’ও আমাদের কাছে ছোট হয়ে যায়। প্রয়োজনসাধনের উপকরণ বা যন্ত্রের মতোই আমরা তাকে দেখি। সেনাবাহিনীর সৈন্য, কারখানার শ্রমিক, অন্ন যোগানো কৃষকরা শুধু নন, অনেক সময় প্রিয়জনেরাও এইভাবে যন্ত্র হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে তাঁদের মনের খবর আমাদের আর পাওয়া হয়ে ওঠে না। কারণ, ‘স্বার্থ জিনিসটা যে কেবল নিজে ক্ষুদ্র তা নয়, যার প্রতি সে হস্তক্ষেপ করে তাকেও ক্ষুদ্র করে তোলে।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঈশ্বর বিশ্বভুবনে আছেন, একথা সহজে অনায়াসে বলে ফেলা যায়, আমাদের উপলব্ধিকে অত্যন্ত সত্য করে তোলার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যিনি তার পরেও বলেন, ঈশ্বর এই ওষধিতে এই বনস্পতিতে আছেন, তিনি মন্ত্রটিকে ‘কেবল মননের দ্বারা পাননি, দর্শনের দ্বারা পেয়েছেন। তিনি তাঁর তপোবনের তরুলতার মধ্যে কেমন পরিপূর্ণ চেতনভাবে ছিলেন, তিনি যে নদীর জলে স্নান করতেন সে স্নান কী পবিত্র স্নান, কী সত্য স্নান, তিনি যে-ফল ভক্ষণ করেছিলেন তার স্বাদের মধ্যে কী অমৃতের স্বাদ ছিল, তাঁর চক্ষে প্রভাতের সূর্যোদয়, কী গভীর গম্ভীর কী অপরূপ প্রাণময় চৈতন্যময় সূর্যোদয়– সে কথা মনে করলে হৃদয় পুলকিত হয়।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়োজনের সীমায় সমগ্র জগতকে আমরা নিছক ব্যবহারের সামগ্রী করে তুলি। জল-স্থল-বাতাসকে অবজ্ঞার ভৃত্য বা যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে করে নিজেকেই বঞ্চিত করি। আমাদের পেট ভরে কিন্তু মন ভরে না। যাঁরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, তাঁরা জল-স্থল-বাতাসকে অবজ্ঞার ব্যবহারে জীর্ণ সংকীর্ণ করে দেখেননি। ‘নিত্য নবীন দৃষ্টি ও উজ্জ্বল জাগ্রত চৈতন্যের দ্বারা বিশ্বকে অন্তরের মধ্যে সমাদৃত অতিথির মতো গ্রহণ করেছিলেন।’ আমাদের বোধশক্তিকে অলস করে না রেখে চেতনাকে জাগিয়ে তোলার সাধনা করতে হবে। বিনামূল্যে পেয়ে যাকে অবজ্ঞা করে চলেছি, সচেতন সাধনার মূল্যে তাকে যথার্থ লাভ করতে হবে।
মন্ত্রটিতে, তিনি বিশ্বভুবনেই আছেন একথা বলা হয়ে গেছে আগে। মনে হতে পারে সবই তো বলা হয়ে গেল। তবু তার পরে ওষধি বনস্পতির কথা কেন উল্লেখ করা হল, সেকথা বুঝতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ঈশ্বর বিশ্বভুবনে আছেন, একথা সহজে অনায়াসে বলে ফেলা যায়, আমাদের উপলব্ধিকে অত্যন্ত সত্য করে তোলার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যিনি তার পরেও বলেন, ঈশ্বর এই ওষধিতে এই বনস্পতিতে আছেন, তিনি মন্ত্রটিকে ‘কেবল মননের দ্বারা পাননি, দর্শনের দ্বারা পেয়েছেন। তিনি তাঁর তপোবনের তরুলতার মধ্যে কেমন পরিপূর্ণ চেতনভাবে ছিলেন, তিনি যে নদীর জলে স্নান করতেন সে স্নান কী পবিত্র স্নান, কী সত্য স্নান, তিনি যে-ফল ভক্ষণ করেছিলেন তার স্বাদের মধ্যে কী অমৃতের স্বাদ ছিল, তাঁর চক্ষে প্রভাতের সূর্যোদয়, কী গভীর গম্ভীর কী অপরূপ প্রাণময় চৈতন্যময় সূর্যোদয়– সে কথা মনে করলে হৃদয় পুলকিত হয়।’
তিনি বিশ্বভুবনে আছে বলে দিয়ে তাঁকে সহজে বিদায় করে দিলে চলবে না। ‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান, আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ’ দিনে দিনে সেই মহাদানের যোগ্য হয়ে ওঠার সাধনা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রতিক্ষণের সচেতন সাধনা হয়ে উঠুক।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব