রুশিদের রসিকতার চরম নিদর্শন বোধহয় প্রকাশ পায় ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ বা ‘নাকের বদলে নরুণ পেলেম’-এর মতো রসিকতার মধ্য দিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের এই সুলক্ষণটি রুশিদের মধ্যে প্রভূত পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকী, রুশ দেশেও ইহুদিদের নামে যত চুটকি প্রচলিত সেগুলির অধিকাংশই নাকি সে দেশের ইহুদিদের মস্তিষ্কপ্রসূত। রুশ দেশে, বিশেষত সোভিয়েত আমলে, এমনকী সোভিয়েত আমলের বিশেষ পর্বে যখন সেন্সর ব্যবস্থার বেজায় কড়াকড়ি ছিল, তখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর যে সমস্ত চুটকি লোকের মুখে মুখে চলত সেগুলির কোনও তুলনা হয় না। এ যেন লোকসাহিত্যের এক অফুরান ভাণ্ডার।
৬০.
তবু রঙ্গে ভরা
সম্প্রতি সমাজতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন রুশি, ইতালীয় আর ফরাসিরা নাকি বিশেষ একটা হাসে না। তাদের মধ্যে কারও কারও কাছে হাসি-হাসি মুখ নাকি প্রতারণা বা ছলনার একটা মুখোশ হলেও হতে পারে। কেউ কথায় কথায় হাসলে রুশিরা বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলতে পারে: ‘লোকটা বোকা নাকি!’
রাশিয়া, জাপান বা ইরানের মতো দেশে বেশি হাসলে স্বল্পবুদ্ধির লক্ষণ বলে ধরা হয়। আর্জেন্টিনা, জিম্বাবোয়ে, ইরান ও রাশিয়ার মতো দেশে বেশি হাসিকে সততার অভাব বলেও সন্দেহ করা হয়। ইদানীং সমাজতত্ত্ববিদরা হাসি নিয়ে এই ধরনের নানা রকম প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সেই সব তত্ত্বকথা মেনে নিলেও এমন কথা বলতে হয়তো বাধা নেই যে, গোমড়ামুখ যে সবসময় রসিকতাবোধের অন্তরায় নয়, রুশিরা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
কোনও জাতির রসিকতাবোধের মধ্যে সম্ভবত তার মানসিকতার পরিচয় নিহিত থাকে। রসিকতা বা চুটকিকে কুৎসা, গোঁড়ামি বর্ণবিদ্বেষ বা বিদ্বেষপ্রসূত কোনও রটনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, রুশিদের নিয়ে দুনিয়ায় যত রসিকতাবোধ প্রচলিত তার অধিকাংশ কিন্তু রুশিদের নিজেদেরই সৃষ্টি। নিজেকে নিয়ে নিজেই রসিকতা করার ক্ষমতা এবং অন্যের মুখ থেকে সেরকম রসিকতা শোনার মতো সহিষ্ণুতা মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির একটা বড় নিদর্শন।
…………………………………
একজন রুশি, একজন ফরাসি আর একজন মার্কিন একজায়গায় এসে জুটেছে। এমন সময় সেখানে ঈশ্বরের আবির্ভাব। ঈশ্বর তাদের তিনজনের প্রত্যেককেই তাদের যার যার পছন্দমতো একটি করে বরদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে শর্ত দিলেন– যে যা বর চাইবে তার প্রতিবেশী কিন্তু ঠিক তার দ্বিগুণ পাবে। ফরাসি লোকটি রিভিয়েরা অঞ্চলে একটি দামি ভিলা চাইল। ঈশ্বর বললেন, তথাস্তু। লোকটার প্রতিবেশী দুটো ভিলার অধিকারী হল। মার্কিন লোকটি চাইল সবচেয়ে দামি রোলস্ রয়েস গাড়ি। ঈশ্বরের বরে সে তাই পেল, তবে তার প্রতিবেশী দুটো রোলস্ রয়েস পেয়ে গেল। এবারে রুশির পালা। ঈশ্বরকে সে বলল, ‘আমার একটা চোখ গেলে দাও।’
…………………………………
রুশিদের রসিকতার চরম নিদর্শন বোধহয় প্রকাশ পায় ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ বা ‘নাকের বদলে নরুণ পেলেম’-এর মতো রসিকতার মধ্য দিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের এই সুলক্ষণটি রুশিদের মধ্যে প্রভূত পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকী, রুশ দেশেও ইহুদিদের নামে যত চুটকি প্রচলিত সেগুলির অধিকাংশই নাকি সে দেশের ইহুদিদের মস্তিষ্কপ্রসূত। রুশ দেশে, বিশেষত সোভিয়েত আমলে, এমনকী সোভিয়েত আমলের বিশেষ পর্বে যখন সেন্সর ব্যবস্থার বেজায় কড়াকড়ি ছিল, তখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর যে সমস্ত চুটকি লোকের মুখে মুখে চলত সেগুলির কোনও তুলনা হয় না। এ যেন লোকসাহিত্যের এক অফুরান ভাণ্ডার।
কী নেই সেখানে? রুশিদের পরশ্রীকাতরতার কিস্সা শুনতে চান? একজন রুশি, একজন ফরাসি আর একজন মার্কিন একজায়গায় এসে জুটেছে। এমন সময় সেখানে ঈশ্বরের আবির্ভাব। ঈশ্বর তাদের তিনজনের প্রত্যেককেই তাদের যার যার পছন্দমতো একটি করে বরদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে শর্ত দিলেন– যে যা বর চাইবে তার প্রতিবেশী কিন্তু ঠিক তার দ্বিগুণ পাবে। ফরাসি লোকটি রিভিয়েরা অঞ্চলে একটি দামি ভিলা চাইল। ঈশ্বর বললেন, তথাস্তু। লোকটার প্রতিবেশী দুটো ভিলার অধিকারী হল। মার্কিন লোকটি চাইল সবচেয়ে দামি রোলস্ রয়েস গাড়ি। ঈশ্বরের বরে সে তাই পেল, তবে তার প্রতিবেশী দুটো রোলস্ রয়েস পেয়ে গেল। এবারে রুশির পালা। ঈশ্বরকে সে বলল, ‘আমার একটা চোখ গেলে দাও।’
সোভিয়েত সংবিধানে নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য এত ভালো ভালো সমস্ত ধারা ছিল যে, বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও দেশের সংবিধানে তা ছিল না। কিন্তু সেই সংবিধান সম্পর্কে রসিকমহলের কী অভিমত? একজন ভোজনরসিক রসনা পরিতৃপ্তির জন্য রেস্তরাঁয় ঢুকেছে। মেনুকার্ড দেখে সে বাছা বাছা খাবারের অর্ডার দিতে লাগল, কিন্তু যে-খাবারেরই নাম করে ওয়েটার সবিনয়ে জানায় ঠিক সেটাই আজ নেই। শেষকালে রেগে-মেগে মেনুকার্ড ছুড়ে দিয়ে ভদ্রলোক মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল: ‘আমি জানতে চাই এটা কী? মেনুকার্ড, না সোভিয়েত সংবিধান?’
তৎকালীন সোভিয়েত অর্থনীতি বা মানুষের চাহিদা ও জোগান ব্যবস্থা এবং সেই বিষয়ে সরকারি মনোভাব সম্পর্কেও মজার মজার গল্প আছে। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কিছু পাওয়াই দুষ্কর। শহরে যাও-বা পাওয়া যায়, গ্রামাঞ্চলে তা একেবারেই অকল্পনীয়। সুদূর উত্তরাঞ্চলের চুকোত্কা থেকে একজন লোক রাজধানী মস্কোতে কাজে যাচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা এটা-ওটা নানা দুষ্প্রাপ্য জিনিসের একটা লিস্ট করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘মস্কোতে Principle নামে একটা দোকান আছে সেখানে সব পেয়ে যাবি।’ লোকটা যথারীতি কাজকর্ম সেরে দেশে ফিরে এল, কিন্তু খালি হাতে। ‘সে কী রে? কিছুই আনতে পারলি না?’ না, ওরকম কোনও দোকান মস্কোয় নেই, তাছাড়া এগুলোর কোনওটাই মস্কোর কোনও দোকানে পাওয়া গেল না।’ তার মানে? তাহলে যে রেডিওতে বারবার অত করে বলে ‘In Principle everything is available’।
গর্বাচ্যোভ্ উদ্ভাবিত পেরেস্ত্রৈকার আগে থেকে ইয়েল্ৎসিনের আমল পর্যন্ত দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল, তা বোঝার জন্যও রুশিদের মুখে মুখে প্রচলিত চুটকির আশ্রয় গ্রহণ করা যেতে পারে।
সমাজতন্ত্রের ট্রেন চলতে চলতে থেমে গেছে– সামনে লাইন নেই। ট্রেন-যাত্রীদের ব্যাকুল প্রশ্ন: ‘কমরেড লেনিন, রেল লাইন নেই যে সামনে। এখন উপায়?’ লেনিন: কুছ পরোয়া নেই। আসুন, সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ি, হাত লাগাই। শ্রমদান করতে হবে, সামনে লাইন পাততে হবে।’
স্তালিন আমল। যাত্রী-সাধারণের আর্তনাদ: ‘কমরেড স্তালিন, সামনে লাইন নেই।’ স্তালিনের কড়া দাওয়াই; অপরাধী খুঁজে বের করুন।’
ক্রুশচ্যোভ আমল; কমরেড ক্রুশচ্যোভ, সামনে পথ নেই। ক্রুশচ্যোভের সহজ সমাধান; তাতে কী হয়েছে? পেছনের লাইন তুলে সামনে পেতে দিন। সমাজতন্ত্রের গাড়ি গড়গড়িয়ে চলে যাবে।
আর ব্রেজনেভের আমলে: সামনে রাস্তা নেই তো কী হয়েছে? কামরার জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে যে যার জায়গায় বসে বসে অল্প অল্প দুলতে থাকুন। সবারই মনে হবে ট্রেন চলছে।
সামনে রেললাইন নেই বলে গর্বাচ্যোভ্ নিদান দিয়েছিলেন, খোলা হাওয়া বইছে (‘গ্লাসনস্ত’, অর্থাৎ খোলাখুলি প্রকাশ করা তখন সরকারি নীতি) তাতেই দিব্যি উড়তে উড়তে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে সমাজতন্ত্রের রেলগাড়ি।
ইয়েল্ৎসিন বললেন: গোল্লায় যাক সমাজতন্ত্রের রেলগাড়ি। বেঁচে থাক আমার ঘোড়া।
স্তালিন আমল বা কেজিবিকে নিয়ে লোকের যে এত ভয়, তা নিয়ে কি কম মজার গল্প চালু ছিল? জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছে, সেই সময় একজন মাতাল ও খ্যাপাটে ধরনের লোক রাস্তায় চেঁচামেচি করে মহা হাঙ্গামা বাধিয়ে তুলেছে। গলা ফাটিয়ে বারবার বলে চলেছে এসব ওই ইয়া নাকওয়ালা গুঁফোটার কীর্তি। কেজিবির লোক এসে খপ করে তাকে ধরে কমরেড স্তালিনের কাছে হাজির করল। কমরেড স্তালিন লোকটাকে ধমক দিয়ে বললেন এসব ওই ইয়া নাকওয়ালা গুঁফোটার কীর্তি– এ কথা তুমি বলেছ? হ্যাঁ তা বলেছি বইকি! কার কথা ভেবে বলেছ? কেন, কার আবার, হিটলারের কথা ভেবেই বলেছি। কমরেড স্তালিন কেজিবির লোকটার দিকে ফিরে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনি কার কথা ভেবেছিলেন কমরেড?
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎ, এমনকী সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কেও লোকের মনোভাবের পরিচয় এসব লোককথার মধ্য থেকে উঠে আসছে। সেগুলির মধ্যে আমাদের বহু পরিচিত সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্বও আছে। জনৈক পার্টিনেতা তাঁর একটি পোর্ট্রেট আঁকার বরাত দিয়েছিলেন কোনও এক শিল্পীকে। সেই পার্টিনেতার একটা চোখ কানা ছিল। শিল্পীর আঁকা পোর্ট্রেটে যথারীতি নেতার সেই কানা চোখটাও প্রকাশ পেল। কিন্তু নেতা প্রকৃতিবাদী ধারার ছবি বলে সেই ছবি বাতিল করে দিলেন। অতঃপর অন্য এক শিল্পী যে ছবি আঁকলেন, সেখানে দেখা গেল কানা চোখের জায়গায় ভালো চোখ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নেতা এটাকেও বাতিল করে দিলেন এই বলে যে, এ ছবি ভাববাদী চিন্তাধারার বাহক। তৃতীয় শিল্পী আঁকলেন নেতার চক্ষুষ্মান চোখের পার্শ্বচিত্র। নেতার কাছে এই ছবিটাই গ্রহণযোগ্য হল, যেহেতু এটাই ছিল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নিদর্শন।
তখনও পর্যন্ত ‘গ্লাসনস্ত’ বা ‘পেরেস্ত্রৈকা’ শব্দটি সেদেশের রাজনৈতিক অভিধানে স্থান পায়নি, কিন্তু সেই সময়ও রুশিদের অন্তরঙ্গ মহলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নেতাদের কীর্তিকাণ্ড নিয়ে এক ধরনের চুটকি লোকের মুখে-মুখে চলত। শোনা যায় স্তালিন আমলে ওরকম চুটকি অস্থানে ছড়াতে গিয়ে অনেককে নাকি সরকারি নিগ্রহও ভোগ করতে হয়েছে। বেশি দূরে যেতে হবে না, স্তালিন সম্পর্কে ওরকম একটা স্বরচিত মজার কবিতা ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে শোনাতে গিয়ে নাকি সেই সময়কার বিখ্যাত কবি মান্ডেলস্টাম বন্দি শ্রমশিবিরে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চুটকির প্রবাহ তাতে কমেনি।
ব্রেজ্নেভের আমলে অন্তত দেখেছি– এক বোতল ভোদ্কা আর সেই সঙ্গে কিছু চাট– ব্যস্ জমে গেল চুটকির আসর। দোকানে খাদ্যবস্তুর অভাব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কীর্তিকলাপ নিয়ে একের পর এক মজার মজার গল্প। কোথায় কাগজ দেখে ভাষণ পড়তে গিয়ে কাগজ ওলটপালট হয়ে যেতে থ্যাচারের সঙ্গে তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে গুলিয়ে ফেলেছেন, কোথাও লিখিত ভাষণ পাঠের শেষ দিকে তাকে অনবরত ‘এক্স-ও’, ‘এক্স-ও’ পড়ে যেতে দেখে পাশ থেকে এক পারিষদ উঁকি মেরে কাগজ দেখে তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল: ‘আরে ওগুলো কাগজের খালি জায়গায় আমাদের কাটাকুটি খেলার ঢ্যাঁড়া আর শূন্য চিহ্ন কমরেড।’
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।