কবি মায়াকোভস্কি বলেছিলেন, ‘লেনিন ছিলেন, লেনিন আছেন, লেনিন থাকবেন।’ মানুষের স্মৃতিতে, কত সংখ্যক মানুষের স্মৃতিতে আরও কতদিন থাকবে বলা যায় না, কিন্তু স্মৃতিসৌধতে বোধহয় আর বেশিদিন থাকছে না। শুনলে বিস্মিত হতে হয় যে, সোভিয়েত আমলে লেনিন তাঁর স্মৃতিসৌধের ঠিকানায় অসংখ্য চিঠিপত্র পেতেন। তিনি মৃত কি মৃত নন বড় কথা নয়– বহু সোভিয়েত নাগরিকের ধারণা ছিল তাদের দুঃখ-দুর্দশার একটা সদুত্তর লেনিনই দিতে পারেন। অধিকাংশ চিঠিই আসত ট্রান্সককেশাস ও মধ্য এশিয়া থেকে। আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চিঠি আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
৬৩.
লেনিন থেকেই গেলেন
মস্কো, ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৩
১৯৯১ সালে বর্তমান গণতন্ত্রীদের দিক থেকে দাবি উঠেছিল রেড স্কোয়ারের লেনিন স্মৃতিসৌধ থেকে ‘বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের নেতা’ লেনিনের মরদেহ তুলে অন্য কোথাও সমাধিস্থ করা হোক। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছিয়ে যেতে হয় গণতন্ত্রী সরকারকে। এবারে সে-প্রতিরোধ আর নেই।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যেদিন ট্যাঙ্কের সাহায্যে পার্লামেন্টের বিদ্রোহ অবদমন করলেন, তার একদিন পরেই ৬ অক্টোবর ক্রেমলিনের কমান্ডান্টের বিশেষ হুকুমে– বলাই বাহুল্য সরকারি যোগসাজশে বিকেল চারটে থেকে তুলে নেওয়া হল স্মৃতিসৌধের সামনের সামরিক পোস্ট, যা ১ নম্বর পোস্ট নামে এদেশের সামরিক বাহিনীতে পরিচিত।
১৯২৪ সালের ৭ জানুয়ারি, মৃত্যুর ছয় দিন পরে যখন সোভিয়েত রাষ্ট্রের জনকের মরদেহ রেড স্কোয়ারের স্মৃতিসৌধে শায়িত হয়, তখন থেকে তার দ্বারদেশে দু’জন করে সশস্ত্র রক্ষী প্রহরা দিয়ে এসেছে দিন-রাত। প্রতি একঘণ্টা অন্তর অন্তর প্রহরা বদল হত। কমিউনিস্ট আদর্শবিরোধী ব্যবস্থা হলেও লেনিনের মরদেহ এবং প্রহরাবদলের দৃশ্য– এই দু’টিই ছিল রাজধানীর অতিথিদের কাছে এক পরম আকর্ষণীয় বস্তু।
রক্ষী তুলে নেওয়ার অর্থ কি তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তর থেকে নিকট ভবিষ্যতে লেনিনের সংরক্ষিত মৃতদেহ তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে?
কিন্তু তুলে নিলে কোথায় সমাধি দেওয়া হবে তাঁর শবদেহের। কথা উঠেছিল সাংকৃত পেতের্বুর্গের ভল কোম্স্কি সমাধিক্ষেত্রে– তাঁর মা-র সমাধির পাশে। কিন্তু সেখানে একজন নাস্তিকের মৃতদেহ সমাধিস্থ করার অনুষ্ঠান কী হতে পারে, সেই নিয়ে রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ ভাবিত। অনেকের আবার পেতুর্বুর্গের মতো একটা বড় শহরে লেনিনের প্রত্যাবর্তনে আপত্তি আছে। লেনিনের সমাধি সেখানে কমিউনিস্টদের কাছে নতুন এক তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। তাই অনেকের পরিকল্পনা ভোল্গা তীরের সিম্বির্স্ক শহরে তাঁর জন্মস্থানে, পিতার সমাধির পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা। শহরটি ছোট, অনেক দূরের। ওখানে পাঠাতে পারলে আর ঝামেলা থাকে না। অবশ্য দু’টি শহরই লেনিনের স্মৃতি বিজড়িত। বিপ্লবের ক্রীড়াভূমি সাংগে পেতের্বুর্গ– তৎকালীন পেত্রোগ্রাদের নামই পরবর্তীকালে হয়েছিল লেনিনগ্রাদ, লেনিনের পদবি উলিয়ান্ড থেকে সিম্বির্স্ক-এর নাম হয়েছিল উলিয়ানভ্স্ক। এখন দু’টি শহরই ফিরে পেয়েছে তাদের আদিনাম। একসময় দু’টি শহরের কর্তৃপক্ষের কাছেই লেনিন ছিলেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি– আজও।
কবি মায়াকোভস্কি বলেছিলেন, ‘লেনিন ছিলেন, লেনিন আছেন, লেনিন থাকবেন।’ মানুষের স্মৃতিতে, কত সংখ্যক মানুষের স্মৃতিতে আরও কতদিন থাকবে বলা যায় না, কিন্তু স্মৃতিসৌধতে বোধহয় আর বেশিদিন থাকছে না। শুনলে বিস্মিত হতে হয় যে, সোভিয়েত আমলে লেনিন তাঁর স্মৃতিসৌধের ঠিকানায় অসংখ্য চিঠিপত্র পেতেন। তিনি মৃত কি মৃত নন বড় কথা নয়– বহু সোভিয়েত নাগরিকের ধারণা ছিল তাদের দুঃখ-দুর্দশার একটা সদুত্তর লেনিনই দিতে পারেন। অধিকাংশ চিঠিই আসত ট্রান্সককেশাস ও মধ্য এশিয়া থেকে। আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চিঠি আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
হাসপাতালের সাদা পোশাক পরা একদল মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। সার্জিকাল দস্তানায় ঢাকা তাদের হাতের আঙুলগুলিও উত্তেজনায় কাঁপছে। রোগীকে একটা চাকাওয়ালা শয্যায় শুইয়ে ধীরে ধীরে ঠেলে নিয়ে আসা হল তাদের কাছে। এটা তাঁর পাঁচ বছর অন্তর একবার নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার দিন। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। পরীক্ষকদের কাছে প্রবল উৎকণ্ঠার মুহূর্ত, কেননা এই রোগী একজন অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকমণ্ডলীর ঘোষণা: রোগীর অবস্থা ভালো।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাঁরা জানালেন রোগীকে আবার তাঁর কাচের আধারের মধ্যে রেখে ডালা সিল করে দেওয়া যেতে পারে। কাচের আধার? সিল করে রাখা? এ কেমন রোগী? না, অবশ্যই সাধারণ রোগী নন, আবার জীবিত রোগীও নন– ইনি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, যিনি ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে মৃত। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা এখন মস্কোয় রেড স্কোয়ারে অবস্থিত স্মৃতিসৌধের একটি প্রকোষ্ঠ।
মস্কোর রেড স্কোয়ারে আর্জেন্টিনার কালো লাব্রাদোর পাথর, বল্টিক সাগর সন্নিহিত কারেলিয়া অঞ্চলের লাল স্ফটিক পাথর, উক্রাইনার লাব্রাদোর পাথর, গ্র্যানিট, রক্তিমাভ মর্মর পাথর এবং অন্যান্য পাথরে আধুনিক স্থাপত্যের অনবদ্য নিদর্শন এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত। স্মৃতিসৌধের মাথায় ৬০ টন ওজনের যে-পাথরের ব্লকের ওপর ‘লেনিন’ নামটি খোদাই করা হয়েছে, সেটা আনা হয়েছিল সুদূর ভলিন্স্ক থেকে।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ লক্ষ দর্শনার্থী তাঁকে দেখতে আসতেন। প্রতিদিন সাত থেকে ন’-হাজার মানুষের সমাগম হত। তাও খোলা থাকত দিনে মাত্র তিন ঘণ্টা। রবিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেত। সবই অতীতের কথা। আজকাল তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় দর্শকের সংখ্যা দিনে হাজার দশকের বেশি হয় না– অধিকাংশ আবার ভক্তও নয়, যত না ভক্তিবশত আসে, তার চেয়ে বেশি আসে তাদের অসুস্থ কৌতূহল চরিতার্থ করতে।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এক বিশেষ কমিশন তাঁর দেহ পরীক্ষা করে দেখে, প্রতি তিন বছর অন্তর তাঁর দেহের মাইক্রোস্ট্রাকচার পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিশেষ স্টেরিওস্কোপিক পদ্ধতিতে তার ছবি তোলা হয়। আরও ৩০ জন লোক দৈনন্দিন তাঁর দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত। এছাড়া আছে বিশেষ নির্যাসে দেহ নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত একদল বিশেষজ্ঞ, যাঁরা প্রতি দেড় বছর অন্তর অন্তর একটি বিশেষ সংরক্ষণকর দ্রব্যে ৬০ দিন ধরে দেহ নিষিক্ত করে তারপর তুলে আবার ধুয়ে-মুছে যথাযথ জামাকাপড় পরিয়ে পূর্বাবস্থায় কাচের বাক্সে তুলে রাখেন। প্রতি সোমবার ও শুক্রবার বিশেষ প্রতিষেধক ব্যবস্থার জন্য স্মৃতিসৌধের প্রকোষ্ঠের দ্বার রুদ্ধ থাকে। সর্বোপরি পুরো ব্যবস্থাটির তত্ত্বাবধানে আছে মস্কোর জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।
প্রসঙ্গত, পোশাক বলতে লেনিনের পরনে আছে কালো রঙের স্যুট, সাদা সার্ট, নীলের ওপর সাদা বর্ডার দেওয়া টাই। পায়ে মোজা ও জুতো। এসব তৈরির জন্যও বিশেষ কারিগর আছেন। যাঁদের পরিচয় গোপনীয়। দেহের নিম্নাংশ অবশ্য কালো চাদরে ঢাকা। আছে তাঁর সেই সুপরিচিত দাড়ি। দাড়ির চারিধারে কয়েক দিনের না-কামানো খোঁচা খোঁচা অংশ। মাথার দু’-পাশে সামান্য সাদাটে চুলের গোছা– তাঁর সহধর্মিণী মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নিজের হাতে যেভাবে ছেঁটে দিয়েছিলেন অবিকল সেইভাবেই আছে। তবে শোনা যায় মৃত্যুর পরে বেশ কিছুকাল পর্যন্ত ত্বকের টিস্যুগুলি সজীব থাকায় দাড়ি-গোঁফ ও চুল গজাত। ফলে মাঝে মাঝে একটু-আধটু ছেঁটে দিতে হত। শায়িত লেনিনের ডান হাতের আঙুলগুলো সামান্য মুঠো করা, বাঁ-হাতটা শিথিল হয়ে পড়ে আছে চাদরের ওপর। এত রকমের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও দাবি করা হচ্ছে, দেহ মৃত্যুর সময় যে অবস্থায় শায়িত ছিল, ঠিক সেইভাবেই রাখা আছে। তবে এমন কথাও শোনা গেছে যে, পোশাকের রূপ অন্তত একবার বদল হয়েছে। ছয়ের দশকের আগে নাকি লেনিনকে পুরোপুরি নাগরিক পোশাকের বদলে আধাসামরিক পোশাকে শায়িত থাকতে দেখা গেছে।
১৯২৪ সালে লেনিনের যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর দেহ সৎকারের ব্যবস্থা নিয়ে পার্টির মধ্যে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। কেউ কেউ দাহ করার পক্ষে ছিলেন, কেউ বা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করার। দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসা অত্যন্ত জরুরি ছিল। যেহেতু সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে যে ধরনের প্রচলিত রাসায়নিক দ্রবের সাহায্যে দেহ সংরক্ষণ করা হয়, তাতে দিন ছয়েকের বেশি সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তার চেয়েও বেশি নির্ভরযোগ্য উপায় অবশ্য ছিল শূন্য থেকে ২ ডিগ্রি তাপমাত্রাযুক্ত একটি সিল করা বায়ুশূন্য কাচের বাক্সে দেহটি রাখা। সময়টা জানুয়ারি, বাইরের তাপমাত্রাও যথেষ্ট অনুকূল। এই বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেকটা সময় লেগে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত দেহটি বরফের চাঙরের ওপর শুইয়ে একটি ফ্রিজারে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে তাঁর সহধর্মিণী নাদেজ্দা ক্রুপস্কায়া প্রাভ্দায় একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন: ‘ইলিচের মৃত্যুর জন্য আপনাদের যে শোক, তা যেন ব্যক্তিমানুষ তাঁর প্রতি ভক্তির উচ্ছ্বাসে পরিণত না হয়। তাঁর কোনও স্মৃতিমন্দির বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে যাবেন না। তাঁর স্মৃতিতে আড়ম্বরপূর্ণ কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন না।’
ক্রুপ্স্কায়ার এই ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে সোভিয়েত সরকারের ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে দাঁড়াল। জানুয়ারিতে তাপমাত্রা শূন্যাঙ্কের ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত নীচে নেমে যাওয়ার দরুণ সমাধি খননের কাজ দুরূহ হয়ে উঠেছিল; বরফ ভেঙে কোদাল চালানো যাচ্ছিল না– তাই সমাধি দেওয়ার কাজ দু’দিন পিছিয়ে দিতে হল।
ইতিমধ্যে বলশয় থিয়েটার সংলগ্ন কলাম হলে যেখানে লেনিনের মৃতদেহ সংরক্ষিত ছিল, সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় সমানেই বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তখনও তাদের প্রিয় নেতাকে শেষ দেখা দেখার জন্য লোকজনের আসার কামাই নেই। প্রবল শৈত্যের মধ্যে তাঁকে দেখার জন্য জনসাধারণকে চার-পাঁচ ঘণ্টা রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। স্তালিন এবং নতুন সরকারের প্রথম গোপন পুলিশ অধিকর্তা, তথা কেন্দ্রীয় জরুরি কমিশনের সভাপতি, ফেলিক্স দ্জের্জিন্স্কি সমেত বলশেভিক নেতারা প্রত্যেকেই লেনিনের প্রতি জনসাধারণের এই ভালোবাসার উচ্ছ্বাস দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন– তাঁরা লেনিনের মৃতদেহ শব-রক্ষণী নির্যাসের প্রলেপ দিয়ে সংরক্ষণ করে আরও কিছুদিন দর্শনার্থীদের জন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এখানেই মৃতদেহ পুজোর ঐতিহ্যের জন্ম।
লেনিনের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ২১-২২ তারিখের রাত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির উদ্যোগে লেনিনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের একটি কমিশন (পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী স্মৃতিরক্ষা কমিশনে পরিণত হয়) গঠিত হয়। কমিশনের সভায় সমাধিস্থ করার দিন ২১ তারিখ ধার্য হয়েছিল। তার আগে অবিকৃত অবস্থায় মৃতদেহ রাখার তোড়জোড় সেই রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু প্রায় একই সময়ে এর পাশাপাশি আরও একটি পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা চলতে থাকে, যার জন্ম নাকি মস্কো এবং অন্যান্য শহরের শ্রমিক মহলে। যেমন রস্তোভ্ থেকে একদল শ্রমিক এমন চিঠিও লিখেছিলেন যে ‘মাটির গর্ভে দেহ সমাধিস্থ করা– এর মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু নেই। কিন্তু সুদীর্ঘকালব্যাপী সংরক্ষণ এমনই একটা কাজ, যা একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষেই করা সম্ভব।’ শেষ পর্যন্ত তা-ই করা হয়েছিল।
স্থায়ীভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রশ্ন ওঠার আগে মাটির নীচে গর্ভস্থিত করে সেখানে দেহ সমাধিস্থ করা এবং স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিমূর্তি নির্মাণের প্রশ্নও উঠেছিল। নীতির প্রশ্নে পার্টির অনেকেই সেদিন আপত্তি তুলেছিলেন। ১৯২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি কমিশনের যে-সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ভরশিল্ভ বলেছিলেন: ‘আমার মনে হয় ব্যক্তিমাহাত্ম্য প্রচারের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত হবে না। আমাদের শত্রুরা চতুর্দিক থেকে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে পারে। কৃষকরা ব্যাপারটাকে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারে, বলতে পারে, দেখেছ, আমাদের দেব-দেবী ধ্বংস করেছে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মীদের সেই পরাক্রম ভাঙার কাজে লাগিয়েছিল, এখন সে-জায়গায় গড়ে তুলছে নিজেদের পরাক্রম। এতে রাজনৈতিক ক্ষতি বই লাভ হবে না।’
সদস্যদের কেউ কেউ, বিশেষ করে দজের্জিন্স্কি এই যুক্তিকে খারিজ করে দিয়ে বলেন: ‘পরাক্রম অলৌকিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল, কিন্তু আমাদের কাছে অলৌকিকতা বলে কিছু নেই; সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পরাক্রমের কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। আর ব্যক্তিপূজার কথা যদি কেউ বলে তো বলব এটা ব্যক্তিপূজা নয়, কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভ্লাদিমির ইলিচ ভক্তি বললেও বলা যেতে পারে। এখানে কেউ কেউ বলেছেন লেনিন থাকলে এর বিরোধিতা করতেন। ঠিক কথা। লেনিনের মতো মানুষদের বৈশিষ্ট্যই এই যে, তাঁরা অত্যন্ত বিনয়ী। কিন্তু দ্বিতীয় কোনও লেনিন তো আমাদের নেই। ব্যক্তিগতভাবে উনি এখানে কিছু বলতে পারেন না, যেহেতু তিনি নিজে তাঁর নিজের বিচারক হতে পারেন না; কিন্তু তাঁর মতো দ্বিতীয় আর কেউ নেইও যাঁর ক্ষেত্রে এটা প্রযুক্ত হতে পারত। বিজ্ঞানের যদি তাঁর দেহ সংরক্ষণের ক্ষমতা থাকে, তাহলে সেটা না করারই-বা কী কারণ থাকতে পারে? আগের দিনে রাজারাজড়ার দেহ নানারকম প্রলেপ দিয়ে দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করে রাখা হত স্রেফ তারা রাজারাজড়া বলে। কিন্তু আমরা এটা করব এই কারণে যে, এই মানুষটি ছিলেন এক মহান ব্যক্তি, যার তুল্য আর কেউ নেই। আমার কাছে যেটা মূল প্রশ্ন তা এই যে বাস্তবিকই দেহ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা যায় কি না।’ আরও কিছুকাল পরে এই প্রশ্নটাই ‘সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ পরিণত হয়েছিল।
স্থায়ীভাবে না হলেও দীর্ঘকাল সংরক্ষণের একটা উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যেতে লেনিনের মরদেহ বলশয় থিয়েটার থেকে সরিয়ে এনে রেড স্কোয়ারে তাড়াহুড়ো করে তৈরি একটি কাষ্ঠনির্মিত স্মৃতিসৌধ তুলে আনা হল ১৯২৪ সালের ২ জানুয়ারি। তাকে যে-কফিনে রাখা হয়েছিল, সেটার দু’পাশে দুটো জানলা আর ওপরে কাচের ডালা ছিল– সেখান থেকেই দর্শনার্থীরা তাঁকে দেখতে পেত।
তখনও শীতকাল। কিন্তু বসন্তকাল আসার আগেই সরকার সিদ্ধান্ত নিল অতিশীঘ্র সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনও পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা প্রয়োজন। তা নইলে উষ্ণ আবহাওয়ায় মৃতদেহ দ্রুত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। ১২ মার্চ পর্যন্ত কাচের আধারে শায়িত মৃতদেহ দর্শকদের জন্য ওই কাঠের প্রকোষ্ঠেই রাখা হয়েছিল। মার্চের শেষে বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগে সংরক্ষণের জন্য মৃতদেহ সামায়িকভাবে খারক্ভে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯২৪ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কোনও স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত উন্নততর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে দেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হলেও মরদেহ রেড স্কোয়ারে কাঠের প্রকোষ্ঠেই স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু ছত্রাক সংক্রমণের আশঙ্কায় শেষদিকে বেশিসংখ্যক দর্শককে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। প্রকোষ্ঠটিতে ছত্রাক ধরতেও শুরু করেছিল। ১৯২৫ সাল থেকেই স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা চলতে থাকে। ১৯২৯ সালে নতুন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য জাতীয় স্তরে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। ১৯৩০ সালের ১২ অক্টোবর এই তৃতীয় স্মৃতিসৌধটির দ্বার জনসাধারণের সামনে উন্মুক্ত হয়। এটাই তখন থেকে হয় লেনিনের স্থায়ী ঠিকানা। অবশ্য মাঝখানে একবার ১৯৪১ সালের জুন মাসে নাৎসিবাহিনী যখন মস্কোর দোরগোড়ায় হানা দিয়েছিল সেই সময় থেকে বেশ কয়েক বছরের জন্য তাঁর ঠিকানা বদল হয়েছিল। লেনিনের সংরক্ষিত দেহ তুলে নিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছিল সুদূর তিউমেনের (সাইবেরিয়া অঞ্চলে) একটি কৃষিবিদ্যা কলেজে। কিন্তু সেটা ছিল গোপন ঠিকানা। সেই ঠিকানায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উপায় কারও ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সেখানেই রাখা হয়েছিল। ১৯৪৫-এ মস্কোয় ফিরিয়ে আনা হয়।