সেই সময়ের বাঙালি এক কিশোর ‘আপনজন’ দেখে ঠিক যতটা উদ্বেল হয়েছে, ততটাই ম্রিয়মাণ হয়েছে ‘মেরে আপনে’ দেখে। যদিও ‘মেরে আপনে’ যখন মুক্তি পাচ্ছে, তখন সময় আরও অগ্নিগর্ভ। কিন্তু সেই আগুনে দিনগুলোর শুরুতেই ‘আপনজন’ চিনিয়ে দিয়েছিল যৌবনের জমা রাগ, এবং বেদনার স্বরলিপি। বল লুফতে লুফতে ‘আলো আমার আলো’ গাইতে গাইতে, মাঝে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিষণ্ণতায় সরকারি চাকরির পরীক্ষার কথাও তোলে যে প্রজন্ম, এই ছবি শেষাবধি বুঝিয়েছিল, কোন অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তারা।
৭.
তপন সিনহার ‘আপনজন’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৮ সালে। সবে তখন বাংলার তারুণ্য একটু একটু করে সেঁকছে সময়ের আঁচে। এই ছবির পরতে পরতে গনগনিয়ে উঠেছিল বেকারত্ব, সামাজিক টালমাটালে থাকা প্রজন্মের হতাশা, অপরাধপ্রবণতা, তথাকথিত সমাজবিরোধিতার অসুখ। ১৯৭১ সালে গুলজারের ‘মেরে আপনে’ আসছে, বিনোদ খান্না নায়ক। দু’টি ছবিই ইন্দ্র মিত্রর একই কাহিনি নিয়ে। আবার ওই ’৭১-এই তপন সিনহার ‘এখনই’ মুক্তি পাচ্ছে। রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস থেকে নির্মিত সে-ছবি সেসময়ের মূলধারা ও কিঞ্চিৎ সমান্তরাল বাংলা ছবির প্রেক্ষিতে একেবারে অন্যরকম। কলেজের বন্ধুত্বের সঙ্গে রাজনীতি, সময়ের অস্থিরতার সঙ্গে নারী-পুরুষ সম্পর্কের টানাপোড়েন যেভাবে জুড়ে গিয়েছিল এই ছবিতে, তা যেমন বিরল, তেমনই যৌবনের ওইরকম সরল, অথচ উদ্দাম ভাষ্য চট করে তার আগে বাংলা ছবিতে দেখা যায়নি। এর বেশ কিছু বছর পর, ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘স্বাতী’, যেখানেও কলেজের বন্ধুত্ব আর প্রেম ছিল ভরপুর।
সেই সময়ের বাঙালি এক কিশোর ‘আপনজন’ দেখে ঠিক যতটা উদ্বেল হয়েছে, ততটাই ম্রিয়মাণ হয়েছে ‘মেরে আপনে’ দেখে। যদিও ‘মেরে আপনে’ যখন মুক্তি পাচ্ছে, তখন সময় আরও অগ্নিগর্ভ। কিন্তু সেই আগুনে দিনগুলোর শুরুতেই ‘আপনজন’ চিনিয়ে দিয়েছিল যৌবনের জমা রাগ, এবং বেদনার স্বরলিপি। বল লুফতে লুফতে ‘আলো আমার আলো’ গাইতে গাইতে, মাঝে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিষণ্ণতায় সরকারি চাকরির পরীক্ষার কথাও তোলে যে প্রজন্ম, এই ছবি শেষাবধি বুঝিয়েছিল, কোন অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তারা। কিন্তু ‘মেরে আপনে’-র বিনোদ খান্না বা শত্রুঘ্ন সিনহাকে কী করে চিনবে ‘রাধা’-য় এই ছবি দেখতে যাওয়া সেই সদ্য-যুবক, যে স্বরূপ দত্ত বা শত্রুঘ্ন সিনহাকে সরাসরি পাড়ার সেইসব রবিদা বা ছেনোদা-দের সঙ্গে মেলাতে পেরেছিল, যারা চাইলেই পড়াশোনায় ভালো হতে পারত, যারা চাইলেই চাকরি ইত্যাদির চেনা খোপে নিজেদের আঁটিয়ে ফেলতে পারত, অথবা সঠিকভাবে নিজেদের রাগের রাজনীতিকরণ ঘটাতে পারত, কিন্তু নেহাতই পাড়ার গুন্ডা হয়ে, কখনও বাম-নকশাল, কখনও বা ‘কংশাল’-দের স্রোতে মিশে কাটিয়ে ফেলল যৌবন। সেই কিশোর নিজের মধ্যে তো পার্থ মুখোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রকে খুঁজে পেয়েওছিল। ছায়া দেবী-র আনন্দময়ী যতটা দ্রব করতে পেরেছে দর্শকের মন, বা যতটা চিনিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্তর ভন্ডামি ও অসততা এবং তার বিপ্রতীপে থাকা, সংস্কারের বাইরে চলে যাওয়া তরুণদের আঁকাড়া খাঁটিত্বকে, মীনা কুমারী-র আনন্দী দেবী তা পারল না, এবং বিনোদ খান্নার লিপে কিশোর কুমারের কণ্ঠে ‘কোই হোতা জিসকো আপনা’ কথায়-সুরে হয়ে রইল এই শহরের বহিরাগত আওয়াজ।
১৯৭০ সালে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং পরের বছর ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’-এ রাখঢাকহীন, সপাট হয়ে উঠেছে ক্ষয়ে যেতে যেতে রুখে দাঁড়ানো যৌবন। হিন্দি ছবিতে সেই যৌবন কি আদৌ জ্বলে উঠেছিল তখন? এইখানে একটু প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যেতেই পারে। আবিদ সুরতি-র ‘বাহাদুর’ ইন্দ্রজাল কমিকসের পাতায় এসেছিল ১৯৭৬ সালে। বাহাদুর গ্রামভারতের নায়ক। পুলিশের হাতে নিহত ডাকাত ভৈরব সিংয়ের ছেলে বাহাদুর, যে উর্দু জাসুসি কাহিনির খলনায়ক হতেই পারত চাইলে, কিন্তু সে বড় হল বাবার ঘাতক পুলিশ অফিসারের কাছে। সে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে তাই হয়ে উঠল সমান্তরাল আইনরক্ষক, সেই ডাকাতদের একহাত নিতেই। বিনোদ খান্না, যে কিনা রাগী যৌবনের প্রতিনিধি হয়ে ‘মেরে আপনে’-তে দেখেছে দর্শক, তাকে তো আদতে তারা চিনেছে ‘সাচ্চা ঝুটা’ বা ‘মস্তানা’ বা ‘জানে আনজানে’-র পুলিশ হিসেবে, সে ডাকাত হয়ে উঠল ‘মেরা গাঁও মেরা দেশ’-এ এসে। তার মাঝেই অসামাজিক যুবক শ্যাম হয়ে দেখা দিয়েছিলেন বিনোদ খান্না, ‘মেরে আপনে’-তে। ডাকাত থেকে পুলিশ, কোথাওই সেই সময়ের বাঙালির নায়ক আদতে লুকিয়ে ছিল না। কিন্তু ভারত জুড়ে তখন যদিও এই দুই মেরুর মধ্যে খোঁজ চলছে ইয়ুং কথিত সমষ্টিগত অচেতনের সেই নায়কের, যা আশিস নন্দীরা খুঁজে পাবেন বলিউডের মূলধারার নায়ক নির্মাণেই। কিন্তু সে-প্রসঙ্গ আপাতত মুলতবি থাক।
মোদ্দায়, প্রতিনায়ক হয়ে ওঠারও কোনও লক্ষণ বিনোদ খান্না ধারণ করতে পারেননি। তাই শ্যামের সঙ্গে কখনওই মিলবে না বাঙালি যৌবনের দেখা, যা মিলে যাবে ‘আপনজন’-এর রবি হয়ে আসা স্বরূপ দত্তর সঙ্গে, যে হতাশায়, ক্লান্তিতে একসময় বলবে, ‘মারামারি করতে আর ভালো লাগে না রে ছেনো, আর ভালো লাগে না।’ কলেজ বন্ধ, বেঞ্চ উল্টোনো ঝামেলার মধ্যে গিটার বাজিয়ে চলা, প্রায় হিপি কালচারের প্রতিনিধি উচ্ছুঙ্গ তরুণ, নাক সিঁটকে ‘রাসকেল’ বলা পাড়ার জেঠু বা দরজা বন্ধ করে রাখা উদাসীন, উন্নাসিক মধ্যবিত্তর মাঝে সেই রবিরা পেয়েছিল একজন আনন্দময়ী, একজন ছায়াদেবীকে। যার স্বামী (চিন্ময় রায়) বউকে বাসররাতে ফাঁপা হুমকি দিয়ে পরের সকালে বেরতে পারে প্রভাতফেরিতে, যে স্বদেশির কাছে দীক্ষা চায় বন্দুক ধরার। সেই বৃদ্ধাই গুলি হজম করে নিজের শরীরে, যে গুলি এই তরুণদের ঝাঁজরা করবে শিগগিরই, তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো অমন সত্যিকারের ‘হাজার চুরাশির মা’ সেদিন আর থাকবে না।
বাংলার রবিদা-ছেনোদারা ছড়িয়ে থাকত পাড়ায়। তাদের হাতে থাকত পাড়ার রাশ। একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এমনই এক পাড়ায় মেয়েরা সিনেমা দেখতে যেতে ভয় পেত নেহাতই সেই পাড়ার রবিদার ভয়ে। কারণ একে তো সিনেমা দেখা গর্হিত কাজ, তার ওপর হিন্দি সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল রীতিমতো ব্লাসফেমির শামিল। তাই বাড়িতে মিথ্যে বলেই চলত সিনেমা-সফর। সে-পাড়ার রবিদা পাড়ার দায়িত্বশীল দাদা হিসেবে আবার সে-খবর তুলে দিয়ে আসত পাড়ার মা-কাকিমার কানে। এহেন রবিদাকে একদিন হঠাৎই বরানগরের ‘সোনালি’ সিনেমা হলে দেখে ফেলল স্কুল-কলেজের সেইসব সন্ত্রস্ত, গেরিলা পদ্ধতিতে সিনেমা দেখতে যাওয়া মেয়েরা। ‘কাটি পতঙ্গ’-এর রাজেশ খান্না-আশা পারেখকে দেখে চলেছে একমনে, একাই, চোখে কালো চশমা। সিনেমা হল থেকে বেরনোর সময় হল এনকাউন্টারটা। কালো চশমার আড়ালে ছলছল চোখটা বোঝা যাচ্ছে না। রবিদা কেবল ধরা গলায় বলল, ‘আমিও স্পিকটি নট থাকব, তোরাও। পাড়ায় যেন এই খবর না রটে।’ তারপর আচমকা ভ্যানিশ সন্ধের ভিড়ের মধ্যে।
এরপর ‘দিওয়ার’ দেখে আরেকবার কাঁদতে দেখা গিয়েছিল রবিদাকে, শশী কাপুরের হাতে অমিতাভ বচ্চনকে মরতে দেখে। সাব ইনস্পেক্টরের হাতে মরে যাওয়া বিজয় আদতে অপরাধীদের শায়েস্তা করারই পণ নিয়েছিল, রাতের অন্ধকারে। রবিদা হয়তো বিজয় হতেই চেয়েছিল।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল