ছবি আঁকার জন্যে তাঁর একটা কাঠের টেবিল ছিল। ডেস্কের মতো তার সামনেটা ঢালু হয়ে এসেছে। টেবিলের অন্যপ্রান্তে, পিছনের দিকে খোপ-কাটা সেলফে রং তুলি রাখার ব্যবস্থা। তবে তিনি যে খুব গুছিয়ে বসে ছবি আঁকতেন, তা নয়। ভেতরে ভেতরে আর্টিস্টের ছটফটানি সর্বদা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তাড়াহুড়োয় পেনসিল ভেঙে যাওয়া, কলমের খোঁচায় কাগজ ফুটো হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
৭.
একটা প্রশ্ন প্রায়ই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের ছবি আঁকার জায়গাটা কেমন ছিল? কবিতা লিখতে কাগজ আর কলম হলেই চলে। সে একখানা খাতা বা বন্ধু, তথা অনুরাগিণীর উপহার দেওয়া ডায়ারিই যথেষ্ট। কিন্তু ছবির বেলায় তো অনেক সরঞ্জাম লাগে। কাগজ-রং-তুলি, কাগজ-বোর্ড, জলের পাত্র, হাতমোছার কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি মিলিয়ে– সে হরেক কিসিমের আয়োজন। সেসব তিনি কেমনভাবে সামলাতেন? তিনি কি ঘরের কোণে জানলার পাশে তাঁর ছবি আঁকার স্টুডিও গড়ে নিয়েছিলেন? আরেকটা প্রশ্নও উঠে আসে। প্রায় আড়াই হাজার ছবির সবই কি কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আঁকা? নাকি উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণের সব বাড়িগুলোই তাঁর ছবি আঁকার পরিসর হয়ে উঠেছিল? উদয়ন বা শ্যামলীতে বসে ছবি এঁকেছেন, সে আমরা জানি। উদয়ন বাড়িতে আঁকা ছবির সংখ্যা সম্ভবত বেশি। বছর পাঁচেক বাদে ১৯৩৫ নাগাদ ‘শ্যামলী’ তৈরি হলে সেখানেও ছবি আঁকা হয়েছে, বাদ যায়নি ‘কোণার্ক’, ‘পুনশ্চ’, ‘উদীচী’। কয়েকটা ছবির পিছনে বাড়ির নামও লিখে রেখেছেন। ছবি আঁকার জন্যে তাঁর একটা কাঠের টেবিল ছিল। ডেস্কের মতো তার সামনেটা ঢালু হয়ে এসেছে। টেবিলের অন্যপ্রান্তে, পিছনের দিকে খোপ-কাটা সেলফে রং তুলি রাখার ব্যবস্থা। তবে তিনি যে খুব গুছিয়ে বসে ছবি আঁকতেন, তা নয়। ভেতরে ভেতরে আর্টিস্টের ছটফটানি সর্বদা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তাড়াহুড়োয় পেনসিল ভেঙে যাওয়া, কলমের খোঁচায় কাগজ ফুটো হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। নিজেই বলেছেন সে কথা। বলেছেন, আঁকার সময় এমন জোরে চাপ দেন যে পেনসিলের শিস পট্পট্ করে ভেঙে যায়। কারণ মনটা দৌড়তে থাকে।
মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে আছে ছবিঠাকুরের আঁকা নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং গল্প। সে বেশ মজার। সেবারে কবি রয়েছেন মংপুতে। সেই সময় মৈত্রেয়ীর মাসি সুব্রতা তাঁর তেলরঙের সরঞ্জাম নিয়ে এসে হাজির। কবিকে দিয়ে একখানা ছবি আঁকিয়ে নিতে চান। রবি ঠাকুর আবার তেলরং দিয়ে ছবি আঁকতে একেবারেই ভালোবাসেন না। সে বড় সময়সাপেক্ষ, একবার রং লাগিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়– শুকোনোর জন্যে। সে ধৈর্য তাঁর একেবারে নেই। তাও অনেক অনুনয়-বিনয়ে তিনি নিমরাজি হলেন। বাকিটা মৈত্রেয়ীর জবানিতে শুনি– “অনেক করে বুঝিয়ে বলে, কাগজ কেটে, বোর্ড দিয়ে রঙ সাজিয়ে দেওয়া হল, ফস করে একটা মুখের outline টেনে তারপর ভাবতে লাগলেন। যেন বিষম বিপদে পড়ে গেছেন। –‘মাসী! একি সঙ্কটে ফেললে’। আমরা খাবার ঘরে আড্ডা দিচ্ছি, আলুবাবু (সচ্চিদানন্দ রায়) ছুটে এলেন ‘শিগগির চলুন, ছবি নিয়ে হইচই করছেন’, –ঘরে ঢুকে দেখি হাতে জামায় রঙ মেখে ছবিখানা নিয়ে বসে আছেন।” এই হচ্ছে রবি ঠাকুরের ছবি আঁকা। অবনীন্দ্রনাথ বুঝি এই ভেতরের urge-কেই বলেছেন ‘ভলক্যানিক ইরাপশন’। অন্যদিকে অবনঠাকুর ছবি আঁকতেন স্থির শান্ত সমাহিত ভাবে। ‘রবিকা’র মতো রং-তুলি নিয়ে কোনওরকম ধ্বস্তাধস্তি ছিল না তাঁর। নন্দলালের আঁকা ‘গুরু’ শিরোনামের সেই বিখ্যাত ছবিতে দেখি, শিল্পীর একপাশে জলের পাত্রে রাখা প্রস্ফুটিত পদ্মের গুচ্ছ, সেখানে ধ্যানস্থ ঋষির মতো আত্মমগ্ন চিত্রী অবনীন্দ্রনাথ।
এ তো গেল ছবি আঁকা নিয়ে রবি ঠাকুরের ছটফটানির গপ্পো। কিন্তু ছবি আঁকার পছন্দের স্টুডিও কেমন হবে– সে কথা তিনি জানিয়েছেন তাঁর আদরের বউমা প্রতিমাকে। বলছেন যখন তার কিছু আগেই প্যারিসে, জার্মানিতে তাঁর ছবির এগজিবিশন হয়েছে। ‘কবি’ আর ‘প্রোফেট’-এর লেবেল সরিয়ে সবাই তাঁকে চিনছে পাকা আর্টিস্ট হিসেবে। প্রদর্শনীর ডাক এসেছে স্পেন থেকে, ভিয়েনা ও অন্যান্য দেশ থেকে। এমনই একটা মুহূর্তে বার্লিনে বসে তাঁর মনে পড়ছে সেই স্বপ্নের স্টুডিওর কথা– যা নিয়ে একদা প্রতিমার সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। ছবিঠাকুরের স্টুডিও কেমন হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন চিঠিতে, তার কিছু অংশ তুলে দিই– ‘থেকে থেকে মনে আসচে তোমার সেই স্টুডিয়োর কথাটা। ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে, শালবনের ছায়ায় খোলা জানলার কাছে। বাইরে একটা তালগাছ– খাড়া দাঁড়িয়ে, তারি পাতাগুলোর কম্পমান ছায়া সঙ্গে নিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েচে আমার দেয়ালের উপর, –জামের দালে বসে ঘুঘু ডাকতে সমস্ত দুপুর বেলা; নদীর ধার দিয়ে একটা ছায়া-বীথি চলে গেছে– কুড়চি ফুলে ছেয়ে গেছে গাছ, বাতাবি নেবুর ফুলের গন্ধে বাতাস ঘন হয়ে উঠেচে, জারুল-পলাশ-মাদারে চলেচে প্রতিযোগিতা, সজনে ফুলের ঝুরি দুলচে হাওয়ায়; অশথ গাছের পাতাগুল ঝিলমিল ঝিলমিল করচে– আমার জানলার কাছ পর্যন্ত উঠেচে চামেলি লতা। নদীতে নেবেচে একটি ছোট ঘাট, লাল পাথরে বাঁধানো, তারি এক পাশে একটি চাঁপার গাছ। একটির বেশি ঘর নেই। শোবার দেয়ালের গহ্বরের মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায়। ঘরে একটিমাত্র আরাম কেদারা– মেঝেতে ঘন লাল রঙের জাজিম পাতা, দেয়াল বাসন্তী রঙের, তাতে ঘোর কালো রেখার পাড় আঁকা। ঘরের পূবদিকে একটুখানি বারান্দা, সূর্যোদয়ের আগেই সেইখানে চুপ করে গিয়ে বসব, আর খাবার সময় হলে নীলমণি সেইখানে খাবার এনে দেবে’। এমন রূপকথার স্টুডিও আর কোনও চিত্রকর ভেবেছেন কি না, জানি না। শহর থেকে দূরে নির্জন প্রকৃতির মাঝে এমন বাহুল্যবর্জিত স্বপ্নমাখা চিত্রপরিসর বুঝি ছবিঠাকুরের ভাবনাতেই মানায়। সে কেবল প্রকৃতির অবগাহনে দৃষ্টির মাধুরীতে নয়, আবহসংগীতও চাই। চাই মিষ্টি গলায় ভেসে আসা গান। – ‘একজন কেউ থাকবে যার গলা খুব মিষ্টি, যে আপন মনে গান গাইতে ভালবাসে। পাশের কুটিরে তার বাসা– যখন খুশি সে গান করবে, আমার ঘরের থেকে শুনতে পাব’। শুধুই কি তাই? গায়িকার স্বামীকে দিয়ে তিনি সেক্রেটারির কাজটুকুও আদায় করে নেবেন। ‘তার স্বামী হবে ভালমানুষ এবং বুদ্ধিমান, আমার চিঠিপত্র লিখে দেয়, অবকাশ কালে সাহিত্য আলোচনা করে, এবং ঠাট্টা করলে ঠাট্টা বুঝতে পারে এবং যথোচিত হাসে’। তাঁর স্টুডিওর বিবরণ এখানেই শেষ নয়– ‘নদীর উপরে দুটি সাঁকো থাকবে- নাম দিতে পারব জোড়াসাঁকো– সেই সাঁকোর দুই প্রান্ত বেয়ে, জুই-বেল-রজনীগন্ধা-রক্তকরবী। নদীর মাঝে মাঝে গভীর জল, সেইখানে ভাসচে রাজহাঁস আর ঢালু নদীতটে চরে বেড়াচ্চে আমার পাটল রঙের গাই গোরু, তার বাছুর নিয়ে।’ সেই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে স্বল্পরকমের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। তবে সে হবে নিরামিষ, ‘ঘরে তোলা মাখন-দই-ছানা-ক্ষীর, কুকারে যা রাঁধা যেতে পারে তাই যথেষ্ট– রান্নাঘর নেই’। এই হল ছবিঠাকুরের স্টুডিও– সহজ, সংক্ষিপ্ত, সুন্দর। শেষ পর্যন্ত কি এমন একখানা স্টুডিয়ো তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন? সে বুঝি কেবল কল্পনায় রয়ে গেল। ময়ূরাক্ষীর ধারে বা পদ্মার তীরে, কোথাও তাকে গড়ে তোলা গেল না!
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি