বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। শৈশব কাটে নোয়াখালীতে। কৈশোর ও প্রথম যৌবন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ সম্পন্ন করেন ঢাকায়। কুমিল্লা ও নোয়াখালীর কোথায় তাঁরা ছিলেন, কোন বাড়িতে জন্ম, কোন পাড়ায় বেড়ে ওঠা, সেই সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে গেছে। শুধুমাত্র ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টন, ঢাকার বাড়ির এই নম্বরটা এখনও আছে। বাড়ির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আকার আকৃতি বদলে গেছে।
৭.
বাংলাদেশের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর নাড়ির সংযোগ। ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯২৫ সালের (১০-১১ এপ্রিল) মুন্সিগঞ্জ সদরে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’-এ যোগদান করেন বুদ্ধদেব বসু। এই সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভাপতিত্ব করেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাস শাখার সভাপতিত্ব করেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। এই প্রথম সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর। বুদ্ধদেব বসু তখন সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। সাহিত্য সম্মেলনে তিনি একটি কবিতা পাঠ করেন এবং সমাগত লেখক, অতিথিদের উপহার দেন সদ্য-প্রকাশিত কবিতার বই ‘মর্ম্মবাণী’। ঢাকার বাংলা বাজার থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কবিতার বই ‘মর্ম্মবাণী’।
কবি সুনির্মল বসু ও বুদ্ধদেব বসু মালখানগরের খ্যাতনামা বসু বাড়ির সন্তান। মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে ‘মালখানগর’-এর দূরত্ব বর্তমান সময়ে সড়কপথে আধ ঘণ্টা। বুদ্ধদেব বসুর সময়ে মালখানগর থেকে ঢাকার দূরত্ব নদীপথে অর্ধেক দিনের। আদি বিক্রমপুর বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নে বুদ্ধদেব বসুর পৈতৃক বাড়ি। আর মায়ের বাড়ি কিছুটা দূরত্বে ‘বহর’ গ্রামে। বুদ্ধদেব বসুর শৈশবে উৎসবের দিনগুলো কেটেছে মালখানগর ও বহর গ্রামে। দাদুর বাড়ি বহর গ্রাম আজ পদ্মা গর্ভে বিলীন। কিন্তু মালখানগরের পৈতৃক বসু বাড়ি আজও টিকে আছে।
মালখানগর গ্রামে প্রবেশপথের যে-কোনও মুখে যে-কাউকে জিজ্ঞেস করলে বসু বাড়ির পথ দেখিয়ে দেন। বসু পরিবারের চেষ্টায় ১৮৫৬ সালে মালখানগরে প্রথম বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে, ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মালখানগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। নয়া বাড়ি, ছোট বাড়ি, বড় বাড়ি, মধ্যের বাড়ি এভাবে পরিচিত বসুদের বাড়িঘর। মালখানগর গ্রামের প্রবেশমুখে ‘ষোলোআনী’ খেলার মাঠ। ষোলোআনী খেলার মাঠ পার হয়ে বুদ্ধদেব বসুর পিতা ভূদেবচন্দ্র বসুর অংশের নয়া বাড়ির লাল রঙের একতলা অট্টালিকা চোখে পরে। বর্তমানে বসু বাড়িতে বসবাস করছেন সাধন চক্রবর্তী। যারা বংশ পরম্পরা এই বসু বাড়ির পুরোহিত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
বাংলার প্রায় সকল শহর গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে। গত দুই শতকের প্রতি বর্ষায় নদী ভাঙন শহরকে গিলে খেয়ে শহরের ভূগোল বদলে দিয়েছে। কুমিল্লা-নোয়াখালী-ঢাকা তিনটি শহরও নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। শৈশব কাটে নোয়াখালীতে। কৈশোর ও প্রথম যৌবন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ সম্পন্ন করেন ঢাকায়। কুমিল্লা ও নোয়াখালীর কোথায় তাঁরা ছিলেন, কোন বাড়িতে জন্ম, কোন পাড়ায় বেড়ে ওঠা, সেই সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে গেছে। শুধুমাত্র ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টন, ঢাকার বাড়ির এই নম্বরটা এখনও আছে। বাড়ির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আকার আকৃতি বদলে গেছে।
বুদ্ধদেব বসুর নানা (মাতামহ) চিন্তাহরণ সিংহ পুরানা পল্টনের জমিটি কেনেন। বুদ্ধদেব বসু যখন পল্টনে বাস করা শুরু করেন তখন তাদের বাড়ি বাদে পুরো পল্টন জুড়ে ছিল মাত্র তিন-চারটি বাড়ি। সেই সময়ে মূল ঢাকার বহির্ভাগ ছিল পল্টন। পুরানা পল্টনের প্রথম বাড়ির নাম ‘পরম ভবন’। এই বাড়ির ছেলে পরিমলের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
বুদ্ধদেব বসু ঢাকা থেকে কলকাতা চলে যাওয়ার পরপর বাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন হয়। বাড়িটি কিনে নেন কবি ও বিভাব পত্রিকার কর্ণধার সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের পিতা বগলাপ্রসন্ন সেনগুপ্ত। দেশভাগের পর আবার একবার এই ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের বাড়ির মালিকানা বদল হয়। কলকাতার ৬ নম্বর পার্ক-সার্কাসের বাসিন্দা ছিলেন হাবিবুর রহমান। দেশভাগের পর ‘অপশন’ নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। বিনিময় দলিলের মাধ্যমে বাড়ি বদল করেন। পার্ক সার্কাসের ৬ কাঠা বাড়ির পরিবর্তে পেয়ে যান পুরানা পল্টনের দুই বিঘার এই প্লটটি। বর্তমানে পল্টনের এই বাড়ির এক অংশে একটি দশতলা বাণিজ্যিক ভবন ও ন’তলা আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে; আরেক অংশে একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে, যা অচিরেই ভেঙে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট হবে।
বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তর সম্পাদনায় ‘প্রগতি’ পত্রিকা পল্টনের এই বাড়ি থেকে প্রথমে হাতে লেখা পরবর্তীতে মুদ্রণযন্ত্রে প্রকাশিত হয়। নগরের স্বভাবই ভাঙা গড়া, একতলা-দোতলা ভেঙে আকাশ ছোঁয়া বাড়ি গড়ে তোলা। আকাশ যেমন ছড়িয়ে থাকে মাথার ওপরে তেমনই ঢাকা শহর, এই পুরানা পল্টন ছড়িয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর অনেক গল্প-উপন্যাসে। তাঁর অনেক সৃষ্টিই আত্মজৈবনিক রচনা। ঢাকা ও পল্টনের পটভূমিতে লিখেছেন প্রেমের গল্প ‘আমরা তিনজন’। ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শো সাতাশ। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল!…
লেখা ও ছবি : কামরুল হাসান মিথুন
… দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন
পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন
পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন
পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’
পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে
পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।