আজকাল একটা কথা প্রায়শই শুনি– ‘সাজঘর ভাগ করে নেওয়া’। এই যে সাজঘর ভাগ করে নেওয়া– এর একটা মাহাত্ম রয়েছে। একটি বিখ্যাত নাটক ‘সওদাগরের নৌকো’-তে একটি সংলাপ আছে– আমাদের পোশাকগুলো যখন সাজঘরে ছাড়ি, কিংবা যখন অভিনয়ের পর সেগুলো খুলে খুলে রাখি, অনেক সময় ঘর্মাক্ত, তখন ওই একটি পোশাকের পর আরেকটি পোশাক, সিরাজৌদল্লার ওপর ঘাসেটি বেগম, তার ওপর হয়তো মির কাশেম– এদের মধ্যে যে সম্পর্ক, প্রেম বা অপ্রেম, সব ঘুচে গিয়ে কীরকম এক দড়ির ওপর জড়িয়েমড়িয়ে থাকে।– এটাকেই বোধহয় ভাগ করে নেওয়া বলে।
৭.
থিয়েটারের আর একটা জায়গাকে মোহময়, আকর্ষণীয়, অনতিক্রম্য ও রহস্যজনক লাগে। এই যে শব্দগুলো লিখলাম, সেটা যে খুব ভেবে লিখলাম, তা নয়। এই পর্বের বিষয়টাই এমন, যে তা নিয়ে ভাবতে গেলে সব ধোঁয়াশা হয়ে যায়। তাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, তাকে বুঝতে চেয়ে বিফল হয়েছি।
আজ কথা বলব সাজঘর নিয়ে।
একটা প্রকৃত মঞ্চের সবসময় একটা সাজঘর থাকে। খোলা মঞ্চের সাজঘর অন্যরকম। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন প্রসেনিয়ামের মঞ্চের একটি সাজঘর থাকবেই। সাজঘরে আমরা একরকমের মানুষ, মঞ্চের ওপর আলাদা। এই সাজঘরের মানুষটি আর মঞ্চের মানুষ এক হবে না কখনও। সাজঘরের মানুষ মঞ্চে গিয়ে পাল্টে যায়, না, মঞ্চের মানুষ সাজঘরে এসে বদলে যায়– এ এক বিরাট ধাঁধা। প্রথম যেদিন মঞ্চের কাছে এলাম থিয়েটার করার বাসনা নিয়ে, সেদিন প্রথম আমার সাজঘরে প্রবেশ। এই সাজঘরের আবহাওয়া, ব্যকরণ প্রথমদিকে ঠাওর হয় না। তবু প্রথম যেবার ঢুকলাম, মনে হল কোথাও কোনও একটা বদল ঘটে গেছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একবার আমি কলেজ থেকে ওই মিনিবাসে উঠে দেখি রুদ্রপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা মানুষ, মাথাটা একটু নীচু করা, নয়তো ছাদে মাথা লেগে যাবে। তখন জানতাম না, পরে জানলাম ৪৭, শ্যামবাজার স্ট্রিটে যাচ্ছেন। নান্দীকারের দপ্তরে। ওঁকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই রোমাঞ্চ হল আমার। মনে হল, আমরা যেন মিনিবাস ভাগ করে নিলাম। পরে আবিষ্কার করলাম স্বাতীলেখাও ছিলেন, বসার জায়গা পেয়েছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজকাল একটা কথা প্রায়শই শুনি, আগে আমাদের সময় এই শব্দগুলো ছিল না, সেটা হল ‘সাজঘর ভাগ করে নেওয়া’। কোনও তরুণতর অভিনেতা-অভিনেত্রী সাজার আগে বা সাজার পরে বলেন, ‘আমার কী পরম সৌভাগ্য আপনার সঙ্গে আজ সাজঘর এবং মঞ্চ ভাগ করে নেব।’ এই যে সাজঘর ভাগ করে নেওয়া– এর একটা মাহাত্ম্য রয়েছে। একটি বিখ্যাত নাটক ‘সওদাগরের নৌকো’-তে একটি সংলাপ আছে– আমাদের পোশাকগুলো যখন সাজঘরে ছাড়ি, কিংবা যখন অভিনয়ের পর সেগুলো খুলে খুলে রাখি, অনেক সময় ঘর্মাক্ত, তখন ওই একটি পোশাকের পর আরেকটি পোশাক, সিরাজৌদল্লার ওপর ঘাসেটি বেগম, তার ওপর হয়তো মির কাশেম– এদের মধ্যে যে সম্পর্ক, প্রেম বা অপ্রেম, সব ঘুচে গিয়ে কীরকম এক দড়ির ওপর জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকে– এটাকেই বোধহয় ‘ভাগ করে নেওয়া’ বলে।
আমার নাটকের হাতেখড়ি ‘নান্দীকার’ দলের সঙ্গে। সেখানে আমার শিক্ষক ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তাঁর সঙ্গে মহড়ায় ভাব আদানপ্রদান হয়েছে, দেওয়া-নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কখনও সাজঘর ভাগ করে নিইনি। প্রথম যেদিন সাজঘরে ঢুকলাম, দেখলাম উনি একটি আয়নার সামনে বসে আছেন। আমি অনেকটা দূরে। সেদিনের ওই দৃশ্য আমাকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অনেক কাল আগের একটি ঘটনায়।
আমি স্কটিশে পড়তাম, সেখান থেকে বাসে করে ফিরতি পথ। একটা বিশেষ মিনিবাসেই উঠতাম, কারণ সেই বাসটা একদম আমার বাড়ির কাছে নামিয়ে দিত। মনে হত, এটা আমার পাড়ার বাস, এই বাসের ওপর অধিকার রয়েছে। তাই অন্য কোনও বাসে উঠতাম না, ওই বিশেষ বাসটি ছাড়া। আরও যখন ছোট, তখনও একটি বিশেষ দোতলা বাসের সঙ্গে আমার এমন সখ্য তৈরি হয়েছিল। পুজোর সময় মামা-পিসিদের কাছ থেকে যে পয়সা পেতাম, তা জমিয়ে আমি ও আমার এক বন্ধু ওই দোতলা বাসে চড়ে রবীন্দ্র সদন যেতাম। তখন কত হবে, ক্লাস এইট আমরা। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে পৌঁছে সবচেয়ে কম দামের টিকিটটা কেটে আমরা নাটক দেখতাম। সেসময় ‘শারদীয়া নান্দীকার’ বলে চারদিনের একটা নাট্য আয়োজন করত ওরা। ওই সময় বাড়িতে ছাড় থাকত রাত করে ফেরা নিয়ে। সেই প্রথম আমার অন্য ধারার থিয়েটার দেখা, যাত্রার বাইরে। প্রথম যে নাটকটি দেখেছিলাম, সেটার নাম ছিল ‘ফুটবল’। ‘নান্দীকার’-এর এই নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়। সেই নাটকে প্রথম রুদ্রপ্রকাশ সেনগুপ্তকে, স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে দেখা। তখনও কি জানতাম ওই নাটকটিতেই একদিন আমি অভিনয় করব, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসেই। নান্দীকারের সঙ্গে ’৮৬ সালে আমার গাঁটছড়া বাঁধা। সেবারই প্রথম আমার রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়া।
একবার আমি কলেজ থেকে ওই মিনিবাসে উঠে দেখি রুদ্রপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা মানুষ, মাথাটা একটু নীচু করা, নয়তো ছাদে মাথা লেগে যাবে। তখন জানতাম না, পরে জানলাম ৪৭, শ্যামবাজার স্ট্রিটে যাচ্ছেন। নান্দীকারের দপ্তরে। ওঁকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই রোমাঞ্চ হল আমার। মনে হল, আমরা যেন মিনিবাস ভাগ করে নিলাম। পরে আবিষ্কার করলাম স্বাতীলেখাও ছিলেন, বসার জায়গা পেয়েছিলেন। তো আমি পাশ কাটিয়ে, প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে রুদ্রপ্রসাদকে পেরিয়ে পিছনে চলে গেলাম। সারাক্ষণ যদিও ওঁকেই নজর রাখছিলাম। আমার সামনে বসা মানুষটি যখন উঠে গেলেন, মুখচোরা আমি, কোন সাহসে গিয়ে ওঁকে বললাম, ‘স্যর, আপনি এখানে বসতে পারেন।’ উনি ফিরে তাকালেন আমার দিকে, বললেন, ‘ওখানে তো তুমি দাঁড়িয়েছিলে, তুমি বসো।’ আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘না না, আপনি বসুন না।’ উনি বললেন, ‘না, আমি তো দাঁড়াতে পারি, আমি সুন্দর দাঁড়িয়ে আছি, তুমি বসো।’ ওঁর এই বলাটার মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল, আদেশও ছিল। এর পর আর কিছু বলা যায় না, আমি গিয়ে বসে পড়লাম। ওঁরা ফরিয়াপুকুরে নেমে গেলেন। এবার হেঁটে হেঁটে যাবেন শ্যামবাজার।
অনেক দিন পরে যখন সাজঘরে ওঁকে দেখতে পেলাম, মনে হল সাজঘরটা মুহূর্তে মিনিবাস হয়ে গেল।
কত মানুষের সঙ্গে অভিনয় করি, কত মানুষের সঙ্গে আমরা যাই, এই মিনিবাসের মতোই। কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়, দু’-চার কথাও হয়। তারপর যে-যার স্টপেজে নেমে যায়। কিন্তু যতক্ষণ বাসের ভেতরে থাকি, মনে হয় যেন পরিবহণটি ভাগ করে নিয়েছি। সাজঘরে সবাই ঢুকতে পারি আমরা। সাজঘরে অবধারিত এক বা একাধিক আয়না থাকবে। কোথাও পুরো চেহারা দেখা যায়, কোথায় শুধু মুখটুকু। বাড়িতেও আয়নায় মুখ দেখেছি বটে, কিন্তু সাজঘরের আয়নায় মুখ দেখা এক অদ্ভুত ব্যাপার। নিজের চেনা-পরিচিত মুখটা একেবারে বদলে যায়। যেন নতুন কারও সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আরও অনেক কিছু সে মুখে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। একবার সে আয়নায় নিজেকে দেখলে আর মুখ ফেরানো যায় না। মনে হয় তাকিয়ে দেখি নিজের মুখের মানচিত্রটা। একটু লক্ষ করি। এ তো আগে কখনও দেখিনি।
‘আমি তাকে হাসতে বলেছিলাম, সে তার ক্লান্ত বিষণ্ণ পাখির মতো ডানা দিয়ে সুদীর্ঘ ঠোঁটের কোণ মুছে আমাকে দেখল। আমি একটা ঘর চেয়েছিলাম। তিন দেওয়ালঅলা ঘর। একটা সাজঘর। তার চতুর্থ দেওয়াল আমি নিজে হব। সেখানে ক্রেপ, স্পিরিট গাম, জিঙ্কের মদির গন্ধে আমি সাজব। আহ্লাদিত পোশাক পরে, চোখে সুরমা টেনে কনসার্টের জন্য অপেক্ষা করব অনেকক্ষণ। তারপর রাত একটু বাড়তেই চারিদিকে হ্যাজাকের আলোয় লুব্ধ অথচ নির্মোহ পতঙ্গেরা যখন ডানা পুড়িয়ে পুড়িয়ে মহৎ মৃত্যুতে শহিদ হতে থাকবে, গান শুনে শুনে বৃত্তের মতো চোখ যখন আমাকে চাইবে, তখন আমি সম্রাজ্ঞীর মতো সামনে আসব আমার সব কথা নিয়ে।’
এই যে আমি চতুর্থ দেওয়াল নিজে হব– এই শব্দটা মারাত্মক। আমরা সাজঘর থেকে মঞ্চে যাই, সেখানে কিন্তু একটা দেওয়াল কমে যায়। সাজঘরের চারটে দেওয়াল, মঞ্চের তিনটে। সেটাকে অদৃশ্য দেওয়াল বলি আমরা, যেখানে দর্শক বসে আছে। তখন অভিনেতাই দেওয়াল হয়ে ওঠে। অভিনেতা দেখে, তাকে ফুঁড়ে দর্শক চলে যাচ্ছে। তাকে ফুঁড়ে, তার আত্মীয়-স্বজনকে ফুঁড়ে, তার সহ-অভিনেতাদের মধ্য দিয়ে।
সাজঘর থেকে মঞ্চে যাওয়ার পথে আরও একটা অঞ্চল আছে, আমি সেটাকে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ বলি। যেখানে অন্ধকার। শুধু স্টেজের আলো এসে পড়ে কখনও সখনও। আমরা অভিনেতারা দেশহীন, কালহীন সময়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি। সাজঘর একরকমভাবে আমাকে গড়ে তোলে, ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ আরেকরকমভাবে আমাকে ভাবায়, তারপর মঞ্চে গিয়ে আমি সাজঘর আর ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এর কথা ভুলেই যাই। একটা চতুর্থ দেওয়াল হওয়ার বাসনায় নিজের ভেতর দেওয়াল তৈরি করছি। আসলে একটা আড়াল তৈরি করছি, আর বলছি এই দেওয়াল ভেদ করে এসে আমাকে দেখে ফেলো, চিনে ফেলো। এই ঘটনাটা শুরু হয় সাজঘর থেকে।
মঞ্চের ওপর আমাদের ভুল করার সুযোগ নেই। সুযোগ থাকে না ভালো করলেও পিঠ চাপড়ানোর। এইসব সুযোগ দেওয়ার জন্য কিন্তু দু’হাত মেলে বসে আছে সাজঘর। দর্শকের হাততালির আবেশটুকু মাখার জন্য কিন্তু আমাকে সাজঘরে ফিরে আসতে হয়। আবার মঞ্চে যখন বিভ্রান্তি তৈরি হয়, কোনও শব্দে হোঁচট খাই, বিস্মৃত হই, তখন সাজঘরে ফিরে এসেই ভুলটাকে নিয়ে গবেষণা করতে বসি। সাজঘর সবসময় ক্ষমা করে দেয়। সাজঘর আমায় সাজায়, তারপর সব ফেরত নিয়ে নেয়। সমুদ্রের মতো। যা কিছু আমি সেজে উঠলাম কাপড়ে-চোপড়ে, তিলকে, উষ্ণীষে– সব ফেরত নিয়ে আমাকে পুরনো মুখটা দেখিয়ে তবে সে আমাকে ছাড়বে। সাজঘর আমার সেই পরমপ্রিয় মানুষটির মতো, যে আমার আনন্দে খুশি, আমার দুঃখে ব্যথিত। যে আমাকে গ্রহণ করেছে, আমাকে কখনও বর্জন করেনি। সাজঘরের আলো মাখলে এখনও তৃপ্তি পাই। মনে হয়, আজ সাজি না সাজি, আজ কিন্তু বসন্ত।
(চলবে)
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?