‘শোলে’-র আরেকখানি উল্লেখযোগ্য রিভার্সাল হল গ্রাম ও নগরের সম্পর্কের। ওয়েস্টার্নে নাগরিকরা কখনওই নায়ক নয়। হয় তারা ওয়েস্টের দামাল জীবনযাপনে অপটু ভাঁড়, নয়তো তারা গ্রামের সরল জীবনকে নষ্ট করতে আসা আধুনিক জটিল ভিলেন। কিন্তু নায়কচরিত্রে বেশিরভাগ সময়েই থাকে গ্রামের মানুষ। ‘শোলে’ এই জায়গাটাতেই বড় তফাত আনে। ১৯৭৫ সালেরই ‘দিওয়ার’ অমিতাভ বচ্চনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের ল্যান্ডমার্ক ছবি হিসেবে নায়কচরিত্র ও নাগরিক ক্রিমিনালিটির নতুন মাত্রা আনে গ্যাংস্টার জঁরের সাপেক্ষে। তাই জয় আর বীরু নাগরিক ক্রিমিনাল হওয়ায় সেই সমসাময়িকতার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। এরপর তাদের যৌথ ক্যারেক্টার-আর্কই হল তাদের গ্রামজীবনে স্থিত হওয়া, রামগড়ের কৌমজীবনে অন্বয়ের মাধ্যমে রিডেম্পশনের। কিন্তু এখানে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হল– জয়-বীরুর হোমোইরোটিক বন্ধনের।
৮.
গত সপ্তাহের কিস্তির শেষে বলেছিলাম স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন নিয়ে কথা বলব। পাঠকরা হয়তো ভাবছেন এই কলামখানি কি জঁর নিয়ে, না ওয়েস্টার্ন নিয়ে? মাপ করবেন, এই জঁরটি আমার বড্ড প্রিয়; তাই ওয়েস্টার্নই সিংহভাগ দখল করে নিল।
এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে ওয়েস্টার্ন একেবারে আমেরিকার ঘরের বিষয়, তার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু ওয়েস্টার্ন গল্পের মধ্যে কিছু একটা মিথিক, ইউনিভার্সাল মাত্রা আছে, যে জন্য অন্যান্য দেশেও তার জনপ্রিয়তা তুমুল হয়েছিল চার থেকে সাতের দশকে। আর যারা সিনেফিল? চলচ্চিত্রপ্রেমের তো কোনও দেশকালের সীমানা-বেড়াজাল নেই।
এইরকম সিনেফিলিয়ার একটি বিচিত্র প্রকাশ ঘটল ছয়ের দশকের ইতালিতে। বিশ্বযুদ্ধের সময় ও আগের বেশ কিছু বছর, নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট শাসনের জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালিতে আমেরিকান ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। এই তিনটি দেশই (এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন) ইউরোপের সিনেমার অগ্রগণ্য দেশ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ইতালির ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রির ভগ্নদশা। বাকি দেশগুলির মতোই ইতালির বাজারও তখন প্লাবিত হল হলিউডের ছবিতে; শুধু সমসাময়িক ছবি দিয়েই নয়, গত দেড় দশক ধরে যেসব মার্কিন ছবি মুক্তি পায়নি, সেই ছবি দিয়েও। বোঝাই যাচ্ছে, স্থানীয় ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে এই প্লাবনের প্রকোপ খুব ভালো ছিল না। হলিউডের জাঁকজমকের সঙ্গে অধুনাদুঃস্থ ইন্ডাস্ট্রি টেক্কা দেবে কী করে? তবে ইতালিতে একটি বিশেষ মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। প্রোডাকশন কমছে; এই অবস্থায় অভিনেতাদের কাজ বজায় রাখা যায় কীভাবে? সেই সময় থেকেই এখনও অবধি, ইতালিতে ভিনভাষী ছবি সাবটাইটেল দিয়ে দেখানো হয় না, ‘ডাব’ করা হয়। অর্থাৎ, অভিনেতাদের রোজগারের হিল্লে হয় ভয়েস-অ্যাক্টর হিসেবে। তাই ফ্রান্স বা অন্যান্য দেশ যখন মার্কিন ছবির প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে, সেই ফ্লাডগেট খোলাটাই ইতালীয় ইন্ডাস্ট্রি নিজের পক্ষে অনুকূল করে দিল। যত বেশি বিদেশি ছবি মুক্তি পাবে, তত ভয়েস-অ্যাক্টরদের ডাব করার কাজ বাড়বে।
অতএব একটা প্রজন্ম জন ওয়েন, গ্যারি কুপার, জিমি স্টুয়ার্টদের দেখল টেক্সাস-অ্যারিজোনায় ঘোড়সওয়ার, মুখে তাদের ইতালীয় বুলি। ঠোঁট মিলল কি না মিলল– কেউই পাত্তা দিল না। এই প্রজন্মর কাছে ওয়েস্টার্ন তখন প্রিয়তম জঁর। অতএব তাঁরা যখন ছবি বানাবেন, সেই সের্জিও লিওনে বা সের্জিও করবুচিরা যে তাঁদের বাল্যকালে দেখা ওয়েস্টার্নই বানাবেন, তা আর আশ্চর্য কীসের? কিন্তু কীভাবে তাঁরা শুট করবেন টেক্সাস-অ্যারিজোনায়, কীভাবে তাঁদের ছবির গ্রাম্য জনপদে খোদ মার্কিন গেঁয়ো মানুষরা ঘুরে বেড়াবে? এই ফিল্মমেকাররা পরোয়া করলেন না। স্পেন, ইতালির প্রান্তরে রুক্ষ পটভূমিতে সেখানকার গ্রাম্য মানুষদের পটভূমিতেই তৈরি হতে থাকল খুবই কম বাজেটের একের পর এক ওয়েস্টার্ন। হলিউড নাক সিঁটকাল; অনুকরণের চেয়ে বড় প্রশস্তি কীই বা হতে পারে? তারা খানিক ছোট করেই এই ছবির নাম দিল ‘স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন’। কিন্তু উন্নাসিকতার সঙ্গে আসে অন্ধত্ব। তখন হলিউডের স্টুডিও যুগের পড়ন্ত বেলা। আর দু’- আড়াই দশকের মধ্যেই সারা পৃথিবীর দর্শক, এমনকী খোদ মার্কিন দর্শকরাও, ওয়েস্টার্ন বলতে বুঝবে স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন। এখনই যদি আপনি টপ টেন বা টোয়েন্টি ওয়েস্টার্ন বলে গুগলে সার্চ দেন, সেখানেও সের্জিও লিওনের কয়েকটা স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন তো থাকবেই।
তার মানে, গরিবদের বানানো এই ‘নকল’ ওয়েস্টার্নে কিছু অন্য মাত্রা ছিল, যেগুলি এইবার ওয়েস্টার্নের সাক্ষর হয়ে যাবে তার উৎসভূমির বাইরে থেকে এসে। প্রথমত, স্পেন ও ইতালির প্রান্তর, এবং সেখানকার মানুষজনের শরীরী ও বাচিক ভাষা মনে করিয়ে দিল সাবেক আমেরিকার দক্ষিণে, মেক্সিকোর প্রেক্ষাপটের কথা, যে গল্প ধ্রুপদী যুগে কম বলা হয়েছে। সেই গল্পগুলোতে শ্বেতাঙ্গ ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি বা সভ্যতা অথবা জাতিগঠনের গল্পের ব্যাগেজ আর থাকল না। থাকবেই বা কেন, ছবিগুলির নির্মাতা বা উদ্দীষ্ট দর্শকদেরই তো সেইসব ব্যাগেজ নেই! সাদারা সভ্যতার ধ্বজাধারী নায়ক, অন্যরা ভিলেন– এইসব পূর্বনির্ধারিত জাতিবাদও গেল চুকে। বাল্যকালে দেখা ওয়েস্টার্নে এই সিনেফিলরা উত্তেজিত হতেন ক্লাইম্যাক্সের গোলাগুলিতে; সেরকম গানফাইট এইবার ছবির পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর আসতে লাগল। মুখ্যচরিত্র হয়ে গেল ভাড়াটে বাউন্টি কিলাররা। অর্থলোভ, হিংসা, বর্বরতা, প্রতিশোধের গল্পগুলো দেখা গেল আসলে আদত ওয়াইল্ড ওয়েস্টের বাস্তবের অনেক কাছাকাছি! তুলনায় যেন ধ্রুপদী হলিউডের গল্পগুলোয় অনেক কিছুই প্রক্ষিপ্ত ছিল, অনেক অ্যাজেন্ডা ছিল মতাদর্শগত। ছয়ের দশকের সময়; নির্মাতাদের অনেকেই বামমনস্ক। তাদের ছবিতে দেখা গেল মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্র, জাতিভেদের নির্মোহ সমালোচনা।
এই কলামের ১ নং ও ৪ নং কিস্তিতে এইরকম কিছু ছবির আলোচনা করেছি। আবার সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্নের এই ‘পোস্ট-ক্লাসিকাল’ মেজাজ, এবং রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্নের ‘আত্মসমীক্ষা’-র কাঠামো ওয়েস্টার্নকে যে শুধু চিরতরে পাল্টেই দিল তা নয়, ওয়েস্টার্নকে করে তুলল আন্তর্জাতিক, নির্মাণের নিরিখে। অর্থাৎ শুধুই যে মার্কিনিদের সম্পত্তি এই জঁর, তা আর রইল না। তাই অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে ‘দ্য প্রোপোজিশন’-এর মতো ছবি, ভারতে ‘সোনচিড়িয়া’ বা ‘কারনান’, কোরিয়ার ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য উয়ের্ড’, বা ‘লোগান’-এর মতো সুপারহিরো ছবি, এমনকী ‘ম্যাড ম্যাক্স ফিউরি রোড’-এর মতো ফিউচারিস্টিক ছবি– সবেতেই যে আসলে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ওয়েস্টার্নকে ফিরে দেখা, এটা স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন ছাড়া হত না।
যেমন ‘শোলে’।
শুধুমাত্র রুক্ষ প্রান্তরে ঘোড়সওয়ার ডাকু আর বন্দুকবাজদের অ্যাকশন দৃশ্য মুন্সিয়ানার সঙ্গে তোলা হয়েছে বলে ‘শোলে’ ভিনদেশি ওয়েস্টার্নের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত নয়, এই ছবি ওয়েস্টার্ন জঁরের বুদ্ধিদীপ্ত ভারতীয়করণ করে। ইউটিউবে অনেক ভিডিও পাবেন ‘শোলে’ কোন ছবি থেকে ‘টোকা’ তাই নিয়ে। এই কলামের প্রথম কিস্তিতেই বলেছিলাম যে আমার কাছে এটা কোনও ইস্যু নয়। ‘শোলে’ যে যে ছবি থেকে অনুপ্রাণিত, তার মধ্যে অন্যতম ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’-এর একটি দৃশ্য আমি চার নম্বর কিস্তিতে উল্লেখ করেছিলাম। ঠিক তার আগের এবং কয়েকটা দৃশ্যের পরের আরেকটি দৃশ্য তথাকথিতভাবে ‘শোলে -তে ‘টোকা’। দৃশ্য দুটোই ঠাকুরসাহেবের বাড়িতে গণহত্যা এবং অতঃপর সংক্রান্ত। কিন্তু একটি তফাত থেকে যায়, এবং কী অমোঘ তফাত! সের্জিও লিওনের ছবির নায়িকা এসে দেখে তার নতুন পরিবারের সবার মৃতদেহ সাজানো আছে। সেই ট্র্যাকিং শটের হৃদয়বিদারক ট্র্যাকিংয়ের শেষে পরিবারের কনিষ্ঠতম সন্তানের মৃতদেহ দেখা যায়, যে নায়িকার সবচেয়ে আদরের সৎপুত্র হতে পারত। আর রামগড়ের ঠাকুরসাবের বাড়ির সামনেও সাজানো থাকে একইরকমভাবে মৃতদেহের সারি; সদ্যবিধবা রাধা ঠাকুরসাব (এবং আমাদের) দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চায় সেই মর্মান্তিক দৃশ্য, কনিষ্ঠতমর মৃতদেহর উপরে সাদা চাদরটা যাতে না উড়ে যায় দু’হাতে চেপে ধরে সে, যেন দৃশ্যটিই শেষ কান্না চেপে ধরে রাখছে। এই যে দেখতে পাওয়া এবং না দেখতে পাওয়ার তফাত, এতেই বোঝা যায়, দৃশ্যটি শুধুই টোকা নয়।
‘শোলে’-র আরেকখানি উল্লেখযোগ্য রিভার্সাল হল গ্রাম ও নগরের সম্পর্কের। ওয়েস্টার্নে নাগরিকরা কখনওই নায়ক নয়। হয় তারা ওয়েস্টের দামাল জীবনযাপনে অপটু ভাঁড়, নয়তো তারা গ্রামের সরল জীবনকে নষ্ট করতে আসা আধুনিক জটিল ভিলেন। কিন্তু নায়কচরিত্রে বেশিরভাগ সময়েই থাকে গ্রামের মানুষ। ‘শোলে’ এই জায়গাটাতেই বড় তফাত আনে। ১৯৭৫ সালেরই ‘দিওয়ার’ অমিতাভ বচ্চনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের ল্যান্ডমার্ক ছবি হিসেবে নায়কচরিত্র ও নাগরিক ক্রিমিনালিটির নতুন মাত্রা আনে গ্যাংস্টার জঁরের সাপেক্ষে। তাই জয় আর বীরু নাগরিক ক্রিমিনাল হওয়ায় সেই সমসাময়িকতার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। এরপর তাদের যৌথ ক্যারেক্টার-আর্কই হল তাদের গ্রামজীবনে স্থিত হওয়া, রামগড়ের কৌমজীবনে অন্বয়ের মাধ্যমে রিডেম্পশনের। কিন্তু এখানে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হল– জয়-বীরুর হোমোইরোটিক বন্ধনের।
এরকম নিদর্শন কি মার্কিনি ওয়েস্টার্নে ছিল? এই কলামের এক কিস্তিতে আলোচনা করেছিলাম ওয়্যাট ইয়ার্প-এর কথা। ইয়ার্প আর ডক হলিডে-র বন্ধুত্ব ওয়েস্টের মিথোলজিতে বিখ্যাত। খানিক তাদের বন্ধুত্বের ওপর আধারিত ১৯৫৯ সালের খানিক কম চেনা ছবি ‘ওয়ারলক’, যদিও হেনরি ফন্ডা এবং অ্যান্থনি কুইন অভিনীত চরিত্রদের নাম ভিন্ন ছিল। ঐতিহাসিক চরিত্র দু’টির মতোই তারা ছিল নাগরিক ভবঘুরে, জনপদে জনপদে দূর্বৃত্ত-দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা তাদের স্বেচ্ছা-জীবিকা। ফন্ডা অভিনীত চরিত্রটি সেরকম একটি জনপদে প্রেমে পড়ে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্র কুইন অভিনীত তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু চটে যায়; এটা হওয়ার কথা ছিল না, তাদের জীবনে কোনও নারীর চিরতরে থেকে যাওয়ার কথা নয়। তারা মুক্ত পুরুষ, তারা পুরুষ-যুগল।
ঠিক এই মাত্রাটিই বীরু আর জয়ের মধ্যে ছিল। বীরু চায় বাসন্তীর সঙ্গে গ্রামে থিতু হবে, জয়ের তা বিলকুল না-পসন্দ। কিন্তু ‘ওয়ারলক’-এর মতো এই মাত্রাটা সিরিয়াস নাটকীয় টেনশন তৈরি করে না, উদ্রেক করে হাস্যরস। এবং আমরা জানি জয়ের মৃত্যুতে কীভাবে সেই হাস্যরস পরিণত হবে করুণরসে।
বীরু গ্রামজীবনের সারল্যে সেটল করতে চেয়েছিল। জয় চাইছিল না। কিন্তু মৃত্যুর আগে সেও যেন একটু নরম হয়ে গেছিল, এবং এইখানে ‘শোলে’-র যে চিত্রনাট্যের বুদ্ধিদীপ্ততা, সেই মাত্রাটা ছবিটিকে ভারতীয় কনটেক্সটে সুপ্রোথিত করে। কিন্তু সেই ভারতীয়ত্ব আজকের দক্ষিণপন্থী, কনজিউমারিস্ট অথচ রক্ষণশীল সংখ্যাগুরুবাদী ভারতীয়ত্ব নয়।
প্রথমত, একটি দৃশ্য আছে যেখানে জয় বীরু-বাসন্তীর দাম্পত্যকে মেনে নেয়। এবং সে বলে সেই সংসারে তারও কিছু কাজকর্ম থাকবে। জয়-বীরুর সম্পর্কে হোমোইরোটিসিজম তো খুবই স্পষ্ট; কিন্তু এই দৃশ্যে জয় যে ভবিষ্যৎটি কল্পনা করে– সে সংসারের কাজকর্ম করে দেবে, বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করে দেবে– সেই ভূমিকাটিও কানে লাগার মতো ‘ফেমিনাইন’! যেন বীরু-বাসন্তীর সংসারে সে হতে চায় একটি ননদের মতো! অমিতাভ বচ্চন অভিনীত এই দৃশ্য কি এখনকার ‘অ্যানিমাল’-পন্থী ছবির আমলে আর লেখা হবে?
এবং ভাবুন জয়ের মৃত্যুর আগে সেই দৃশ্যগুলি। তৃতীয় অ্যাক্টে ক্লাইম্যাক্সের আগে খানিক চিত্রনাট্যের বাঁধুনি আলগা করেই হঠাৎ জয়া বচ্চন অভিনীত রাধাকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাশব্যাক আসে। যে কোনও নির্মাতারই মনে হতে পারে যে এই সময়ে এই ফ্ল্যাশব্যাকটি অপ্রয়োজনীয়, প্রক্ষিপ্ত মনে হতে পারে। কিন্তু (একদার) হিন্দি সিনেমার নাট্যভাবনার ভিন্ন পদ্ধতি ছিল। এই দৃশ্যটি একটি বিশেষ ‘আকাঙ্ক্ষা’ ব্যক্ত করে; রাধা বিধবা, এবং এই অকালবিধবা মেয়েটির প্রাণপ্রাচুর্য আবার দেখতে চান ঠাকুরসাব। তাই তিনি ভাবতে থাকেন যে রাধার সংসার আবার তৈরি করবেন তিনি। বাংলা বিধবা-পূণর্বিবাহ বিদ্যাসাগরের আমল থেকেই আমরা শুনে আসলেও বাকি ভারতবর্ষে বা হিন্দি হার্টল্যান্ডে সেই ফিউডাল প্রাগাধুনিকতা সাতের দশকেও বহাল। অতএব, সেই প্রেক্ষিতে এই দৃশ্যটি একধরনের সংস্কারমূলক আধুনিকতার আকাঙক্ষাই ব্যক্ত করে।
অতএব জয়ের মৃত্যুতে বিবিধরকমের ডিজায়ার মুখ থুবড়ে পড়ে। তার মধ্যে বিধবার ফের বিবাহের সাধটি তাও ব্যক্ত করা গেলেও, জয়ের বীরুর সংসারে কেয়ারগিভারের সাধটি প্রায় অব্যক্ত queer একরকমের বাসনা। অতএব এইসব ভিন্নধর্মী সম্ভাবনার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্রোধই শেষ দৃশ্যের নৃশংস ভায়োলেন্স ট্রিগার করে। ১৯৭৫ সালে ‘শোলে’-র ভায়োলেন্স সেই সময়ের নিরিখে অত্যাধিক ছিল, ঠিক আজকের ‘অ্যানিমাল’, ‘মার্কো’, ‘কিল’ বা ‘জাঠ’-এর মতোই। কিন্তু অধুনার এই ছবিগুলিতে ভায়োলেন্স কেবলই ক্রাফটের উদযাপন হিসেবে থেকে যায়। প্রস্থেটিক্স, সিজিআই, এবং অন্যান্য কারিগরি স্কিল যে আধিক্য দেখাতে পারে, তা নাটকের, আবেগের যুক্তিতে নাটকীয় কার্যকারণ ছাপিয়ে যায়, হয়ে যায় gratuitous display, অপ্রয়োজনীয় মাত্রাতিরিক্ত। ‘শোলে’-র ভায়োলেন্স অন্য গল্প বলে। একটি জাতি সদর্থে আধুনিক হতে চেয়েছিল। রামগড় এই ছবিতে যে ছোট্ট ভারতবর্ষ, তা আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। অন্ধ এ কে হাঙ্গলের ‘ইতনা সন্নাটা কিউ ভাই’ বলে পুত্রশোকে মসজিদের দিকে হেঁটে যাওয়া এখন দেখলে ২০১৮ সালের আসানসোলের ইমাম ইমদাদুল্লা রশিদির কথা আমাকে মনে করায়।
এই যে ভিন্ন ভারতবর্ষ হতে চাওয়া, ‘৭৫-এর সালের সময়ে সেই হতে চাওয়া খানিক প্রতারিত হয়েছিল। এই প্রতারণা জবাবে আর্তনাদই হল ‘শোলে’-র সেই ভায়োলেন্স। এভাবেই, ‘কারি ওয়েস্টার্ন’-এর সফল সিনেফিলিক দৃষ্টান্ত হয়েও ‘শোলে’ তার স্থানিক-কালীক প্রেক্ষিতে সুগ্রন্থিত থাকে।
কিন্তু ‘শোলে’ নিয়ে আরও আলোচনার অবকাশ থেকে যায়– যেমন, গব্বর সিং তো চম্বলের ডাকাত সর্দারের মতো চরিত্র। সে আর্মি ফ্যাটিগ পরে থাকে কেন? সেই সব আলোচনা তোলা রইল।
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…
৭. যখন জঁর নিজেকে নিয়েই সন্দিহান
৬. আমেরিকার ‘হয়ে ওঠা’-র কল্পগল্প
৫. একটি সভ্যতার হয়ে ওঠার মিথোলজি
৪: পশ্চিমে এল এক নারী, বেজে উঠল অমর সংগীত
৩. জঁরের ফর্দ– দৃশ্য, শব্দ, প্রেক্ষাপট
২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর
১. ভাঙনের শহরে এক নামহীন আগন্তুক এবং চারখানি গল্পের গোত্র