আসলে, মানুষ বস্তুত অহংকারী এবং ঈর্ষাকাতর। অগম্য, অজেয় কিছু সে মানতে চায় না। সামগ্রিক মানবের ক্ষেত্রে, এই গুণই তার বিজয়রথ। আর একক মানুষে এসে তা-ই বহুক্ষেত্রে বিপর্যয়। তবু খানিক যেন নেশার বশেই একক মানুষ সর্বত্রগামী হয়ে এগিয়ে যেতে চায়। তাঁর চারপাশকে খানিক দুমড়ে মুচড়ে দিয়েই। আমরা দেখি, যার যা করার কথা নয়, তিনি সেটাই করতে এগিয়ে এসেছেন। দখল করতে চাইছেন সবকিছু। রাতদখল, ভোরদখলের মতো তা হল মানুষদখল। অর্থাৎ পাশের মানুষটিকে নিজের গ্রাসে টেনে নিয়ে তাকে গৌণ করে দেওয়া। এই যে একক মুখ্য মানুষ, সে কি আদতে রক্তকরবীর রাজার মতো ক্ষমতাবান তথাপি নিঃসঙ্গ নয়?
৭.
জর্জ অরওয়েল লেখক হওয়ার আগে পুলিশ হতে চেয়েছিলেন। যোগও দিয়েছিলেন। শেষমেশ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দেন। তবে, পুলিশ হিসাবে থাকাকালীন যাবতীয় অভিজ্ঞতা ঢেলে দেন তাঁর সাহিত্যে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক অসাম্যের প্রতি তাঁর যে ক্ষুরধার কালজয়ী কলম, তার সলতে পাকানোর পর্বটি বলা যায়, ওই পুলিশজীবনেই। চার্লস বুকোস্কি তো বছর দশেক ডাকবিভাগে কর্মরত ছিলেন। তারপর ফিরলেন তাঁর প্রায় আত্মজৈবনিক উপন্যাস নিয়ে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় লিখলেন তাঁর ‘পোস্ট অফিস’, সেখানে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাই এল, অল্টার ইগো চিনাস্কি বলে গেল বুকোস্কির গত জীবনের কথা।
এ কথা ঠিক যে, বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিকই প্রথম জীবনে অন্য কিছু হতে চেয়েছিলেন, পরে চলে এসেছেন লেখালিখিতে। রাউলিং শিক্ষকতা করতে চেয়েছিলেন, সিলভিয়া প্লাথ ভেবেছিলেন চিত্রশিল্পী হবেন। পরবর্তী কালে তাঁদের খ্যাতি আসে সাহিত্যে। কিন্তু ধান ভানতে আজ শিবের গীত কেন? আসলে ওই অরওয়েলের পুলিশজীবন যেভাবে তাঁর সাহিত্যের অভিমুখ বেঁধে দিয়েছিল, বা, বুকোস্কির জীবন যেভাবে ‘পোস্ট অফিস’ উপন্যাস হয়ে উঠল, সেই প্রেক্ষিতেই দু’চার ভাবনা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
এমন তো হয়েই থাকে যে, আমাদের অন্তস্তলের আগুন সম্পর্কে আমরা অবহিত থাকি না। পেটের তাগিদে যে কোনও একটা পেশা বেছে নিই। সেটাই দস্তুর। মাত্র কয়েকজনই পারেন নিজেকে চিনে জীবনের ঠিক টিকিট কাটতে। ভাবুন তো, ধোনি যদি রেলের চেকার হয়েই রয়ে যেতেন, ইন্ডিয়া কি এমন চেকমেট করতে পারত বিপক্ষকে! অতএব কার ভিতর যে কী আগুন আছে, তা বলা মুশকিল। আজ যিনি ছবি আঁকিয়ে কাল তিনি কোনও সংস্থার দুঁদে কর্তা হয়ে উঠতে পারেন। তবে, সেই কর্তার পরিচালন কি ছবির মতো সুন্দর হতে পারে? এই প্রশ্নচিহ্নেই থামতে হয়।
সকলেই নিশ্চিত বুকোস্কি কিংবা অরওয়েলের মতো অতীত জীবন নিংড়ে নতুন জীবন গড়তে পারেন না। তাহলে তাঁরা ব্যতিক্রম হতেন না। অর্থাৎ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন বিশ্বসাহিত্যকে পুষ্টি জুগিয়েছিল, তেমনটা সব ক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। ঠিক এইখানেই আমাদের ভুল হয়ে যায়। আমরা যদি মনে করি, ডাকবিভাগে কর্মরত প্রত্যেকেই একখানা ‘পোস্ট অফিস’ বা পুলিশে কর্মরত প্রত্যেকেই ‘পশুখামার’ রচনা করেন, তাহলে তা খোয়াবনামাই। অথচ আমরা এই বরণীয় দৃষ্টান্তগুলোকে ব্যক্তিগত ইচ্ছে-পূরণের হাতিয়ার করে তুলি। তা দোষের নয়। তবে, ওঁদের মতো হয়ে-ওঠার সাধনা-নিষ্ঠার ধার না ধরে শুধু উদাহরণে ঠেস দিয়ে যদি নিজেদের যে কোনও কাজকে ভাবি ক্ল্যাসিক, তবে, রসিক জীবন খানিক মুচকিই হাসে।
এক্ষেত্রে তাহলে কী হতে পারে? এখানেই অমোঘ জীবনানন্দ, অন্ধেরাই বেশি চোখে দেখে। ওঁর শেষ ছ’বছরের পাণ্ডুলিপি সংস্করণ উল্টে উল্টে দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, মলাটের ভিতর কীভাবে মহাকাল বন্দি হয়ে যেতে পারে! তবে, আজ জীবনানন্দের কথা নয়। কথা জীবনের আনন্দ নিয়ে। একজন মানুষ তাঁর জীবনের আনন্দ খুঁজে নিতে পারেন নানা ভাবে। যেমন, এই ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়ে। অর্থাৎ অন্যতর দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রেখে। যেমন, কেউ একইসঙ্গে নেতা এবং অভিনেতা হতে পারেন। লেখক এবং প্রশাসক হতে পারেন। কিন্তু এই বহুমুখে সম্মুখে তোমার জয়ে থাকা যে সব সময় জীবনের সার্বিক আনন্দের বাতাবরণ তৈরি করে, তা তো নয়। একজনের আনন্দের মূল্যে সবার জীবন ভালো কাটতে পারে না। যেমন, কয়েকজন নেতার খেয়ালখুশির কারণে সকলে ভালো থাকতে পারে না। আর সকলে নেতা হয়েও উঠতে পারে না।
………………………………………………………….
সকলেই নিশ্চিত বুকোস্কি কিংবা অরওয়েলের মতো অতীত জীবন নিংড়ে নতুন জীবন গড়তে পারেন না। তাহলে তাঁরা ব্যতিক্রম হতেন না। অর্থাৎ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন বিশ্বসাহিত্যকে পুষ্টি জুগিয়েছিল, তেমনটা সব ক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। ঠিক এইখানেই আমাদের ভুল হয়ে যায়। আমরা যদি মনে করি, ডাকবিভাগে কর্মরত প্রত্যেকেই একখানা ‘পোস্ট অফিস’ বা পুলিশে কর্মরত প্রত্যেকেই ‘পশুখামার’ রচনা করেন, তাহলে তা খোয়াবনামাই। অথচ আমরা এই বরণীয় দৃষ্টান্তগুলোকে ব্যক্তিগত ইচ্ছে-পূরণের হাতিয়ার করে তুলি। তা দোষের নয়। তবে, ওঁদের মতো হয়ে-ওঠার সাধনা-নিষ্ঠার ধার না ধরে শুধু উদাহরণে ঠেস দিয়ে যদি নিজেদের যে কোনও কাজকে ভাবি ক্ল্যাসিক, তবে, রসিক জীবন খানিক মুচকিই হাসে।
………………………………………………………….
আর তাই বোধহয় এ সমাজে অধিকার এবং যোগ্য-অযোগ্যের ধারণা এসেছিল এবং থেকেও গিয়েছে। আমাদের গড় ধারণা থাকে যে, কে কোন কাজটায় যোগ্য। তিনি সেই কাজটি না করে অন্য কিছু করতে গেলেই ঝামেলা বাধে। যিনি সভাকবি, তিনি হঠাৎ নায়েবের কাজ করতে বসলে মুশকিল। দুটো সামলাতে না পেরে তিনি হয়তো এমন কিছু করে বসলেন যে, কবিসমাজের হল গোঁসা আর নায়েবসমাজ গেল চটে। ধরুন, কুরুক্ষেত্রের সব সারথিই যদি বিশ্বরূপ দেখাতে বসেন, তাহলে কী সাংঘাতিক কুরুক্ষেত্রই না বাধত! জল থেকে মেঘে রূপান্তরের ভিতর সূর্যের কিছু ভূমিকা থাকে। কিন্তু জল যদি নিজেই হুমড়ি খেয়ে স্বর্গের সিঁড়ি চড়তে যায়, তখন কেমন হয়?
তখন একটা শৃঙ্খলা ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। আমাদের চারপাশে তাকালে এরকম দৃষ্টান্ত হরহামেশাই চোখে পড়ে। যার যেটা কাজ নয়, তিনি সেই কাজটিই হুমড়ি খেয়ে করতে বসেন। অথচ একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন এই প্রকৃতিই বানিয়ে রেখেছে। তার ব্যত্যয় হওয়ার উপায় নেই। গাছের কাণ্ডের কাজ শিকড়, আর শিকড়ের কাজ শাখা করলে কী হয় ভাবুন দিকি!
তবু, অনেক সময় আমরা নিজেদের কর্তব্য ভুলে থাকি। হঠাৎ তা চোখে পড়লে মনে হয়, এটাই কাজ ছিল বুঝি? তাই বলে মানুষের কি অন্য ভূমিকা থাকতে নেই! যিনি রেগুলার বিবাদি বাগ মিনিতে অফিস আর বাড়ি, তিনি দরকারে প্রতিবাদী হতে পারেন না, এ কথা বলছি না। ব্যক্তি মানুষের এই নানা পরতের ভূমিকা আলাদা প্রসঙ্গ। বলতে চাইছি, ব্যক্তি মানুষ যদি নিজেই ভাবতে বসেন দুনিয়ার সবকিছুই মহৎ ভাবে করতে পারেন, এবং সব কাজ একাই করতে বসেন, তাহলে কী হবে? ধরুন, যিনি প্লেনের যাত্রী, তিনিই আচমকা মাঝ আকাশে পাইলট। জীবনের প্লটই তো তাহলে ওলটপালট। যে কোনও ভূমিকায় সমানে লড়ে যেতে গিয়ে একজনই উত্তমকুমার, একজনই ছবি বিশ্বাস হতে পারেন না। আমরা মিমিক আর আসলের তফাত ভুলে গেলে মুশকিলে পড়ি। তবে, ভুলেও যে যাই প্রায়শ, এটাই সত্যি।
অথচ, কথাটি এই যে, মানুষের এই প্রবৃত্তিগত গোলমালের কথা কি মানুষ নিজে জানে না? তাহলে সে এই দিকে হেঁটে যায় কেন! অথবা, তার আশপাশের মানুষ কি সেই আগ্রাসন বুঝতে পারে না! তাহলে তারাই বা সতর্ক হয় না কেন! আমার ধারণা, ব্যাপারটা অনেকটা ছেলের সিগারেট খাওয়ার মতো। বাবা সবই বোঝেন, জানেন; মুখে কিছু বলেন না। যদ্দিন না বড় কিছু ঘটছে! তবে, যিনি কিনা সর্বঘটে কাঁঠালিকলাটির স্বপ্ন দেখেন, সবার আগে সেই মানুষটিই জানেন তিনি কী ঘটাচ্ছেন! নিয়মের সংসারে হাত দিয়ে তিনি যে বেনিয়ম রচনা করতে চলেছেন, সে নোটিফিকেশন তাঁর কাছেই তো আগে আসে। তাহলে জেনেশুনে তিনি এই এলোমেলোপনার দিকে এগোন কেন?
এইখানেই লুকিয়ে এবারের ওপেন সিক্রেট। আসলে, মানুষ বস্তুত অহংকারী এবং ঈর্ষাকাতর। অগম্য, অজেয় কিছু সে মানতে চায় না। সামগ্রিক মানবের ক্ষেত্রে, এই গুণই তার বিজয়রথ। আর একক মানুষে এসে তা-ই বহুক্ষেত্রে বিপর্যয়। তবু খানিক যেন নেশার বশেই একক মানুষ সর্বত্রগামী হয়ে এগিয়ে যেতে চায়। তাঁর চারপাশকে খানিক দুমড়ে মুচড়ে দিয়েই। আমরা দেখি, যার যা করার কথা নয়, তিনি সেটাই করতে এগিয়ে এসেছেন। দখল করতে চাইছেন সবকিছু। রাতদখল, ভোরদখলের মতো তা হল মানুষদখল। অর্থাৎ পাশের মানুষটিকে নিজের গ্রাসে টেনে নিয়ে তাকে গৌণ করে দেওয়া। এই যে একক মুখ্য মানুষ, সে কি আদতে রক্তকরবীর রাজার মতো ক্ষমতাবান তথাপি নিঃসঙ্গ নয়? পুজো এলেই আমরা কথায় কথায় সর্বজনীন বলি, অথচ মদগর্বী নিঃসঙ্গতার বহুত্বই কি আমাদের ব্যর্থতা নয়? সর্ব কথার গর্ব কি নিজেদের মুদ্রাদোষেই খর্ব করে ফেলি না?
প্রিয় পাঠক, এই ক্যুইজ আপনার জন্য তোলা থাকল। আপাতত, পুজোর ছুটি।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে