দিলীপকুমার রায়কে তাঁর বন্ধু সুভাষ সম্বন্ধে ব্যক্তিগত পত্রে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘সিটি কলেজের ব্যাপারে আমি বেশ করেই দেখেচি সে ঝুটো। সে আপনাকে ও অন্যকে ঠকাতেই চেয়েছে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য , সে উদ্দেশ্য যাই হোক্। তার ভিতরকার এই ক্রমশই বড়ো হয়ে উঠ্চে যখন থেকে সুভাষ বাহিরের দিকে নিজেকে স্ফীত করে দেখ্তে ও দেখাতে চেয়েচে। মস্ত দলের উপর মস্ত কর্তৃত্ব করার লোভ তাকে পেয়ে বসেচে।’ এই তীব্র তিরস্কার রবীন্দ্রনাথ সুভাষকে করছেন বটে কিন্তু আসলে এ তিরস্কার বিশেষ একরাজনৈতিক প্রবণতার প্রতি। রাজনীতির কারবারি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যে কথায় সাধারণকে যদি উসকে তোলেন তাহলে তা কখনও রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায় না। রাজনীতির সূত্রে নেতাই যখন নিজেকে বড় করে দেখায়, তখন সেই ‘মেগালোম্যানিয়াক’ রবীন্দ্রনাথের বিরক্তির কারণ।
সুভাষচন্দ্রের প্রতি কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের মনোভাব? এ-প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া কঠিন। সুভাষকে রবীন্দ্রনাথ যেমন স্নেহ করতেন তেমনই সুভাষের কোনও কোনও কাজ তাঁকে বিচলিতও করেছিল। সাম্প্রতিক কালে ভারতে যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিস্তার ঘটেছে, তারই সূত্রে সুভাষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনোভাবের ইতিহাস খেয়াল করা জরুরি।
ছাত্রজীবন থেকেই সুভাষ রাজনীতি সচেতন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় অধ্যাপক এডওয়ার্ড ফার্লি ওটেনের সঙ্গে সুভাষের বিতর্কের ঘটনা সুপরিচিত। ওটেনের ভারতবিদ্বেষী মনোভাব, ভারতীয়দের সম্বন্ধে তাঁর অপমানজনক মন্তব্য ছাত্রদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করেছিল। সংগত কারণেই প্রতিবাদ করেছিলেন ছাত্ররা। সুভাষও অন্যতম প্রতিবাদী। ঘটনাটি অবশ্য তিল থেকে তাল হয়ে উঠল। সুভাষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তরুণ সুভাষ নাকি অধ্যাপক সাহেবকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেছেন। এই অভিযোগ সত্য না হলেও সুভাষকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হল। সেদিন ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ নামের প্রবন্ধ। সে-প্রবন্ধে শিক্ষকদের কর্তব্য কী, তা নির্দেশ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। লিখেছিলেন, ‘অতএব যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেণ্ট্ বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনোমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারেন; যাঁরা জানেন, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা; যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।’ রবীন্দ্রনাথের আবেদন অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজের কর্তৃপক্ষ শোনেননি। বহিষ্কৃত সুভাষের ছাত্রজীবন যাতে শেষ না হয়ে যায় সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের গভীর উৎকণ্ঠা ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত সুভাষ পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন– রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন।
এই সুভাষের ওপরেই রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত একটি ঘটনার সূত্রেই। ১৯২৮। সিটি কলেজের রামমোহন হোস্টেলে সরস্বতী পুজো নিয়ে বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সিটি কলেজ আনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ধর্মবিশ্বাসে তিনি ব্রাহ্ম। পৌত্তলিকতার সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের যোগ নেই– পৌত্তলিকতার বিরোধী বলেই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজের রামমোহন হোস্টেলে সরস্বতী পুজো হওয়া সম্ভব নয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করতে নিষেধ করেননি, কলেজের গেটের ঠিক বাইরে করা যাবে তেমনই সমঝোতা হয়েছিল। সেই সমঝোতা ভেঙে গেল কিছু ছাত্রের অত্যুৎসাহে। প্রতিষ্ঠানের সীমার মধ্যে ছাত্রদের মূর্তিপূজার উদ্যোগ প্রতিহত করলেন হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক। সঙ্গে সঙ্গে গুজব ছড়িয়ে পড়ল অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র নাকি সরস্বতীর মূর্তি ভেঙে দিয়েছেন। কলেজের দ্বাররক্ষকদের পূজিত শিবলিঙ্গও ফেলে দেওয়া হয়েছে। দুই অসত্য। ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগশূন্য হিন্দু সজনীকান্ত তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে সেদিনের সিটি কলেজের ঘটনার ‘নিরপেক্ষ’ বিবরণ দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা যে গুজব ছড়িয়েছিলেন সে-বিষয়ে সজনীকান্তও সহমত। সরস্বতী মূর্তি ভাঙাও হয়নি, শিবলিঙ্গও ফেলে দেওয়া হয়নি। অথচ প্রায় বছর খানেক ধরে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর।
‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সিটি কলেজের পক্ষে যুক্তি প্রদান করলেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা এই ধর্ম-বিতর্কে চাপা পড়ে গেল। হিন্দুত্ববাদীরা এই কলেজ বয়কট করার ডাক দিল। এই বিতর্কে পুনরায় কলম ধরতে হল রবীন্দ্রনাথকে– ‘প্রবাসী’ পত্রে তিনি সিটি কলেজের পক্ষ নিলেন, হিন্দুত্ববাদীদের অপপ্রচারের বিরোধিতা করলেন। সজনীকান্ত তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’-তে জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ-কাজ খুবই কঠিন ছিল– তিনি ব্রাহ্ম উত্তরাধিকার বহন করছেন, সুতরাং সত্যের নয় ব্রাহ্মধর্মের পক্ষ নিচ্ছেন, এমন কথা উঠতে পারত। এই অসুবিধে স্মরণে রেখেও রবীন্দ্রনাথ নীরব থাকতে পারেননি। যে সুভাষের পক্ষ নিয়েছিলেন তিনি, লিখেছিলেন ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ সেই সুভাষের বিপক্ষে সত্যের পক্ষে এবার দাঁড়ালেন। এই সূত্রেই দিলীপকুমার রায়কে তাঁর বন্ধু সুভাষ সম্বন্ধে ব্যক্তিগত পত্রে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘সিটি কলেজের ব্যাপারে আমি বেশ করেই দেখেচি সে ঝুটো। সে আপনাকে ও অন্যকে ঠকাতেই চেয়েছে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য , সে উদ্দেশ্য যাই হোক্। তার ভিতরকার এই ক্রমশই বড়ো হয়ে উঠ্চে যখন থেকে সুভাষ বাহিরের দিকে নিজেকে স্ফীত করে দেখ্তে ও দেখাতে চেয়েচে। মস্ত দলের উপর মস্ত কর্তৃত্ব করার লোভ তাকে পেয়ে বসেচে।’ এই তীব্র তিরস্কার রবীন্দ্রনাথ সুভাষকে করছেন বটে কিন্তু আসলে এ তিরস্কার বিশেষ একরাজনৈতিক প্রবণতার প্রতি। রাজনীতির কারবারি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যে কথায় সাধারণকে যদি উসকে তোলেন তাহলে তা কখনও রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায় না। রাজনীতির সূত্রে নেতাই যখন নিজেকে বড় করে দেখায়, তখন সেই ‘মেগালোম্যানিয়াক’ রবীন্দ্রনাথের বিরক্তির কারণ। সুভাষ সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের হয়ে কাজ করার যে মিথ্যে নীতির সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেই মিথ্যে নীতির কথা তো এর আগে লেখা একটি উপন্যাসে বিবৃত করেছিলেন কবি। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ যে রাজনীতি করে সে রাজনীতি মিথ্যে কথার রাজনীতি, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের খেপিয়ে তোলার রাজনীতি, দাঙ্গা লাগানোর রাজনীতি। সুভাষ সন্দীপ নন। সুভাষের আত্মত্যাগ আছে। কিন্তু যা উপন্যাসে বিবৃত হয়েছিল তারই কোনও কোনও উপসর্গ কি এবার তাহলে বাস্তব রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করল! আর দুঃখের হলেও সত্য সে ভুল রাজনীতির উপসর্গে খানিক ডুবে গেলেন সুভাষ।
সিটি কলেজের সেই মিথ্যে রাজনীতির ভুল থেকে কিন্তু সুভাষ বাইরে এসেছিলেন। ক্রমেই দেশনায়ক হয়ে উঠলেন তিনি। সেই দেশনায়ক সুভাষকে রবীন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত– দু’জনেই সমর্থন করেছেন, বরণ করেছেন। সজনীকান্ত তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’তে জানাতে ভোলেননি এই দেশনায়কের কথা। আর রবীন্দ্রনাথ? মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপনের দিনে তিনি সুভাষের পাশে অকপটে দাঁড়িয়েছেন, বঙ্কিমের বন্দেমাতরম্ গীতির একটি অনুচ্ছেদ কর্তন করা বিষয়ে সুভাষ-জহরলালকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের মন সত্যপন্থী। সুভাষের প্রতি মনোভাব তাই সত্যের পথে বদলায়। সুভাষও নিজেকে ক্রমে নির্মাণ করেন, সত্যের পথে এগিয়ে যান। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা পেছন দিকে এগিয়ে যেতে চাই– ঝুটো রাজনীতির বহরে মিথ্যেই হয়ে ওঠে সত্য। সুভাষের আত্মত্যাগ ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ নির্মাণের সময় ধর্ম, লিঙ্গ বিষয়ে উদার সমতাকে মনে রাখলে স্বীকার করতেই হবে তিনি যথার্থ দেশনায়ক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুণমুগ্ধ।
…………………ছাতিমতলা অন্যান্য পর্ব……………………..
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি