টেনিস এবং ফুটবল শচীন কর্তার প্রিয় খেলা। প্রিয় নেশা মাছ ধরা। কুমিল্লার বাড়িতে টেনিস লন ছিল। কুমিল্লার বাড়িতেই সংগীত শিক্ষা শুরু। বাড়ির কাজের দুই সহকারী শচীন দেববর্মনের লোকসংগীতের গুরু– মাধব ও আনোয়ার। স্কুলের টিফিনের ছুটিতে ধর্মসাগর দিঘীর পারের বটগাছের ছায়ায় বসে আনোয়ারের কাছ থেকে শেখা গানগুলো বন্ধুদের গেয়ে শোনাতেন।
১২.
শোনো গো দখিন হাওয়া— সুর ও সংগীতের দেশ হচ্ছে ত্রিপুরা। ত্রিপুরা সম্বন্ধে এই কিংবদন্তি আছে যে, সেখানকার রাজা-রানি, কুমার-কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত প্রত্যেকে গান গায়। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষে যত রাজ্য বিদ্যমান আছে, তাহাদের মধ্যে ত্রিপুরার রাজবংশই প্রাচীনতম।’
ত্রিপুরা রাজপরিবারের কুমার শচীন দেববর্মনের জন্ম ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে নয়, জন্ম হয় কুমিল্লার চর্থার প্রাসাদে। রাজ-অন্তঃপুরের কলহের জের ধরে ত্রিপুরার মহারাজ ঈশানচন্দ্র মানিক্যের কনিষ্ঠপুত্র নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মন; তাঁর স্ত্রী মণিপুরের রাজকন্যা নিরুপমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে স্বেচ্ছায় চলে আসেন ত্রিপুরা রাজ্যের চাকলা রোশনাবাদ মহালের সদর– কুমিল্লায়। নবদ্বীপচন্দ্র ও নিরুপমা দেবীর নয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শচীন দেববর্মন। নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন শচীন দেবের মার্গসংগীতে প্রথম গুরু। এবং শচীন দেববর্মনের ছোড়দা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিরণকুমার, মেজদি তিলোত্তমা দেবী– সবাই ছিলেন সুগায়ক। পরিবারের আবহ ছিল সংগীতের। পারিবারিক বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চর্থার বাড়িতে সময় কাটিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কুমিল্লা অতি পুরাতন শহর। কুমিল্লা নামকরণ নিয়ে নানা কিংবদন্তি রয়েছে। বলা হয়, ‘কমলাঙ্ক’ নামে এক রাজা ছিলেন, যাঁর নামানুসারে কমলাঙ্ক থেকে ‘কুমিল্লা’ নামকরণ হয়েছে। তবে কুমিল্লা জেলার প্রাচীন নাম ছিল ত্রিপুরা। কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ চর্থা শচীন দেববর্মনের জন্মভিটা। গীতিকার মীরা দেববর্মনের শ্বশুরবাড়ি। আর সুরকার রাহুল দেববর্মনের পৈতৃক বাড়ি।
শচীন দেববর্মনের প্রাক্-প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় আগরতলার কুমার বোডিংয়ে। পিতা নবদ্বীপচন্দ্র বুঝতে পারেন যে, রাজপরিবারের ছায়ায় সন্তানের সঠিক শিক্ষালাভ হওয়া খুব কঠিন। তাই কুমার বোডিং থেকে ছেলেকে নিয়ে এসে কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করান।
যে শচীন আগরতলার বোডিংয়ে ছাত্র হিসেবে ছিলেন একজন রাজকুমার, সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন অসংখ্য রাজকুমারকে। সেই শচীন কুমিল্লায় এসে সাধারণ ছাত্রের মতো ইউসুফ স্কুলে এসে মিশে গেলেন। বাবাই শচীনকে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার, মাটির সঙ্গে মিশে থাকার মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। এই মাটির কাছাকাছি থাকা, মাটির মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া, এই মাটির ভাটিয়ালি গান গলায় তুলে নেওয়ার পুরো পর্বটাই কুমিল্লায়। বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে স্মৃতিতে শচীন দেববর্মনের জীবনকে তিন পর্বে ভাগ করা যায়– কুমিল্লা, কলকাতা ও বোম্বে।
কলকাতা থেকে ছুটিতে যখন কুমিল্লায় ফিরতেন তখন সময় কাঁটাতেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে এই দু’জন শচীন কর্তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন গানের কথায় ও সুরে। জীবনের দ্বিতীয় রেকর্ডের দুইটি গানের গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য আর একটি গানের সুরকার হিমাংশু দত্ত।
টেনিস এবং ফুটবল শচীন কর্তার প্রিয় খেলা। প্রিয় নেশা মাছ ধরা। কুমিল্লার বাড়িতে টেনিস লন ছিল। কুমিল্লার বাড়িতেই সংগীত শিক্ষা শুরু। বাড়ির কাজের দুই সহকারী শচীন দেববর্মনের লোকসংগীতের গুরু– মাধব ও আনোয়ার। স্কুলের টিফিনের ছুটিতে ধর্মসাগর দিঘীর পারের বটগাছের ছায়ায় বসে আনোয়ারের কাছ থেকে শেখা গানগুলো বন্ধুদের গেয়ে শোনাতেন।
গান গেয়েই প্রথম মুক্তি পান শচীন দেববর্মন। মুক্তি বলতে বদ্ধ দুয়ার খুলে যায় শচীন কর্তার গানে। এমন একটি ঘটনা শচীন দেববর্মন তাঁর আত্মস্মৃতি ‘সরগমের নিখাদ’-এ লিখেছেন, ‘‘আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, কুমিল্লা থেকে দশ মাইল দূরে কমলাসাগরে পুজোর মেলা দেখতে যাচ্ছি– বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে। সেখানে কালীমন্দিরের চারিপাশ ঘিরে মেলা বসত। বহু দূর থেকে গ্রামবাসীরা মেলা দেখতে আসত। মেলা দেখা শেষ করে কমলাসাগর স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা টিকিট না কেটেই দৌড়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। পরে টিকিট চেকারের হাতে ধরা পড়ে যাই, বিনা টিকিটে ভ্রমণের অপরাধে। কুমিল্লার স্টেশন মাস্টার আমাদের সবাইকে স্টেশনের পাশে একটা গুদাম ঘরে বন্ধ করে দেন। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বাবার অনুমতি নিইনি, ভেবেছিলাম সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাব কোনও জবাবদিহি করতে হবে না। এখন স্টেশনে গুদামজাত হয়ে আমি তো কেঁদেই ফেলি। আমার সহপাঠী মোহিত এক বুদ্ধি জোগাল। সে বলল, ‘স্টেশন মাস্টারের মা খুব গান ভালবাসেন। কিছু আগে আমাদের বাড়িতে ঢপ কীর্তন শুনতে এসে আবেগে কাঁদছিলেন। শচীন, তুই তোর ভাটিয়ালি ও বাউল গানগুলি শুরু কর দেখি। এই গানগুলো গাইলে আমাদের মুক্তি পাবার একটা সুরাহা হবে।’ আমি অবসন্ন মনে গান শুরু করেদিলাম। গানে কোনও প্রাণ ছিল না। কারণ আমি তখন বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু গানের কি মহিমা আর মোহিতের বুদ্ধির কী বাহাদুরি– আমার গান পৌঁছাল স্টেশন-মাস্টারের মার কানে। দশ মিনিটের মধ্যে তাজ্জব ব্যাপার! গুদাম ঘরের দরজা খুলে গেল– দেখি, সশরীরে স্টেশন-মাস্টারের মা উপস্থিত। গান শোনার পর ছেলের নিকট আমাদের কথা শুনে মুক্তি দিলেন আমাদের। এমনকী, বাড়ি যাবার আগে সকলকে মিষ্টি মুখও করিয়ে দিয়েছিলেন।’’
শচীন দেববর্মন ‘ইউসুফ স্কুলে’ দুই বছর পড়াশোনার পর কুমিল্লা জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। জিলা স্কুলের সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানেই সর্বপ্রথম, সর্বসমক্ষে গান করেন শচীন দেববর্মন। তাঁর গানের জন্য স্কুলের প্রধানশিক্ষক প্রশংসা পত্র লিখে পাঠান পিতা নবদ্বীপচন্দ্রকে। এই স্কুল থেকেই শচীন ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর আইএ পড়ার জন্য ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। এই কলেজের একটি নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময় নাটকে সংগীতের দায়িত্ব পান শচীন দেববর্মন। আর এই নাটকের মধ্যে থেকেই সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ‘শচীনকর্তা’র।
ছবি: লেখক
… দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১১: বাহান্ন বছর পর ফিরে তপন রায়চৌধুরী খুঁজেছিলেন শৈশবের কীর্তনখোলাকে
পর্ব ১০: মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে নেতাজির নিয়মিত যাতায়াত থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার জীবন শুরু
পর্ব ৯: শেষবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে জানলায় নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়েছিলেন গণেশ হালুই
পর্ব ৮: শীর্ষেন্দুর শৈশবের ভিটেবাড়ি ‘দূরবীন’ ছাড়াও দেখা যায়
পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি
পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন
পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন
পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন
পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’
পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে
পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গত ৬০-৭০ বছরের পরিসংখ্যান কী বলছে? আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে বিবাহ ও সন্তান ধারণ করা যায় না, গ্রামগুলিতেও পৌঁছে গেছে সরকারি হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা, এক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যে ভারত ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
ঠাকুর বলছেন, মানুষকে প্রথমে বুঝতে হবে যে সংসার অত্যন্ত গোলমেলে জায়গা। সংসার হল বিদেশ। সেখানে বিদেশির বেশে ভ্রমে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেন অকারণেই। স্বদেশ হচ্ছে আমার চৈতন্য। আমার আত্মা। সেখানেই আমি স্থিত হতে পারলে আমার শান্তি। তবেই মুক্তি।