স্পেনের দ্বীপ হিসপানিওলা হয়ে উঠল ভাঙা জাহাজের নাবিক, পালিয়ে আসা ক্রীতদাস আর বিভিন্ন ভবঘুরের স্বর্গরাজ্য, কারণ এত বেওয়ারিশ গরু-শুয়োর-ভেড়া যেখানে রয়েছে, সেখানে না খেতে পেয়ে মরে যাওয়ার ভয় ছিল না। সেই দ্বীপে তখনও টিকে থাকা কয়েক ঘর ক্যারিব-এর কাছে আগুনে মাংস ঝলসে রান্নার কায়দা শিখে নিয়েছিল এই নাবিক আর ক্রীতদাসরা। এই আগুনে ঝলসে রান্না করাকে ক্যারিবরা ‘বোক্যান’ বলত আর সেটা করার কাঠের তৈরি কাঠামোকে বলত ‘বারবাকোয়া’।
১৬.
বার-বি-ক্যু শুরু করেছিল ১৬১০ সালে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া ক্যারিবীয় আর বর্তমান ফ্লোরিডার তাইনো উপজাতিরা। তাইনো ভাষায় বার-বি-ক্যু-র অর্থ ‘পবিত্র অগ্নিপিতার উৎসস্থান’, আর ‘তাইনো বারাবিকোয়া’-র মানে ‘চারপেয়ে কাঠের দণ্ড আর অনেক কাঠের টুকরো মাংস রান্নার জন্য’। আর ‘তাইনো বারাবিক্যু’ মানে ‘পবিত্র অগ্নিকুণ্ড’।
সেই জমানায় উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের ফারাক ছিল বিস্তর। উত্তরের সংস্কৃতির হাওয়া নিচের দিকে এসে পৌঁছয়নি। মেক্সিকো আর তার উত্তরাংশের আমেরিকা ছিল অনেক রুক্ষ। সেখানে শুয়োরের মাংস ছিল প্রধান খাদ্য, কারণ বন্য শুয়োরের অভাব ছিল না। শুয়োরের শরীরের কোনও অংশই না ফেলে দিয়ে দেহের কিছু বিশেষ অংশ সংরক্ষণ করা হত আর তাই দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন খাবার বানানো হত। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে এই অঞ্চলে মাংসের জোগানে কম পড়লেই জঙ্গলে গিয়ে শুয়োর শিকার করা নিয়মের মধ্যে পড়ত, আর সেই শিকারকে কেন্দ্র করে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে যেত। যেখানে শুধু পরিবার নয়, পড়শিরাও শামিল হত। আর সেই শিকার করা শুয়োর বার-বি-ক্যু-তে রান্না করে খাওয়া ছিল এই উৎসবের এক অপরিহার্য অঙ্গ। উনিশ শতকের শুরু থেকে গৃহযুদ্ধের মাঝের সময়ে বার-বি-ক্যু অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্ল্যানটেশন মালিকদের কিছুদিন অন্তর মস্ত বার-বি-ক্যু করা এক রীতি হয়ে দাঁড়ায়, আর এই উৎসবে দাসেদেরও পুরো বঞ্চিত করা হত না। ওদের জন্য তৈরি হত শুয়োরের মাংসের আচার, যাতে বেশিদিন ধরে খাওয়া যেতে পারে। গৃহযুদ্ধের আগে উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ দিকের বাসিন্দারা শুয়োর চাষে মন দেয়, যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। মাংসের জন্য উত্তর ভাগের ওপর আর শিকারের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় না। মাংসের জোগান নিয়ে যখন আর দুশ্চিন্তা থাকল না, বার-বি-ক্যু প্ল্যানটেশনের বেড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চার্চ-পিকনিক আর ঘরোয়া পার্টিরও অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল।
পড়ুন ‘ভাজারদুয়ারি’-র আগের পর্ব: শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি
বার-বি-ক্যু-র উৎপত্তি নিয়ে আর এক গল্প আছে। ‘হিসপানিওলা’ নামের স্পেনের অধীনে থাকা এক দ্বীপের প্রথম যুগের বাসিন্দারা জাহাজে করে কিছু গবাদি পশু আনা ছাড়া দ্বীপের জন্য কিছুই নিয়ে যায়নি। সেখানে খোলা প্রকৃতিতে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটিয়ে এই গবাদি পশুদের সংখ্যা ফুলেফেঁপে উঠল। আর কিছুদিন বাদে এই হিসপানিওলা হয়ে উঠল ভাঙা জাহাজের নাবিক, পালিয়ে আসা ক্রীতদাস আর বিভিন্ন ভবঘুরের স্বর্গরাজ্য, কারণ এত বেওয়ারিশ গরু-শুয়োর-ভেড়া যেখানে রয়েছে, সেখানে না খেতে পেয়ে মরে যাওয়ার ভয় ছিল না। সেই দ্বীপে তখনও টিকে থাকা কয়েক ঘর ক্যারিব-এর কাছে আগুনে মাংস ঝলসে রান্নার কায়দা শিখে নিয়েছিল এই নাবিক আর ক্রীতদাসরা। এই আগুনে ঝলসে রান্না করাকে ক্যারিবরা ‘বোক্যান’ বলত আর সেটা করার কাঠের তৈরি কাঠামোকে বলত ‘বারবাকোয়া’। সময়ের সঙ্গে সেই ‘বারবাকোয়া’ ‘বার-বি-ক্যু’ হয়ে যায়। আর ‘বোক্যান’ শব্দ নিঃশব্দে প্রবেশ করে ফরাসি অভিধানে, যেখানে ‘বোক্যান’ শব্দের অর্থ ব্রাত্য।
দক্ষিণ আমেরিকাতে আবার বার-বি-ক্যু মূলত গরুর মাংস দিয়ে হয়। আড়াইশো বছর আগের আর্জেন্টিনাতে চরে বেরানো গরু দিয়ে যে আসাদো বানানো হত, সেই ‘আসাদো’-র মানেই ছিল ‘রোস্ট’। আবার ব্রাজিলের বিখ্যাত বার-বি-ক্যু ‘পিকান্হা’ নামটা এসেছিল রাখালদের গরুকে শাসন করার লাঠির নাম থেকে। আফ্রিকাতে আবার তেলাপিয়া মাছের বার-বি-ক্যু ভীষণ জনপ্রিয়; মোদ্দা কথা মাছ বা মাংস যাই হোক, বার-বি-ক্যু জিন্দাবাদ! বিখ্যাত তুর্কি পদ ‘শিস কাবাব’ আদপে এক বার-বি-ক্যু পদ, যা মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবর জাতিদের খাবার ছিল। অনেক তরিবৎ করে জাঁক দিয়ে তরোয়ালে গেঁথে আগুনের ওপর ধরে বানানো শিস কাবাব এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বার-বি-ক্যু পদের মধ্যে অন্যতম।
ভারতে কি বার-বি-ক্যু হত না? অবশ্যই হত, আর সেটাও হাজার হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে। পশ্চিম ভারতের রাজপুতানায় যোদ্ধারা শিকার করে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করত। ইউরোপে গ্রিক সৈন্যদের মতো শিকার করা পশুকে তরোয়ালের ডগায় গেঁথে আগুনে ঝলসে খেত। তফাত শুধু এখানে সৈন্যরা বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আচার মাখিয়ে খেত।