কয়েকটা গুজু আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে হিসি খাওয়াতে চাইছে, আর সে প্রোজেক্টে চামচেমি করছে কিছু পা-চাটা অশিক্ষিত জানোয়ারের বাচ্চা টাইপের বঙ্গ সন্তান– এই রসিকতাটি ইন ইটসেল্ফ ভীষণ অপমানজনক! ওই হনুমান জাম্বুমান ইত্যাদি প্রাইমেট দেখলেই কমলা গেরুয়া নেংটি এঁটে পুজো করা পাবলিকদের সঙ্গে আমাদের একাসনে বসাতে চাইছে মাইরি! তাও আবার প্রসাদে মুড়ি, নকুলদানা আর পেঠা না কীসব অখাদ্য পিণ্ডি! মিষ্টি বলতে প্যাঁড়া। বাড়িতেও হিন্দিতে কথা কয়! খৈনি খায়! রবীন্দ্রনাথ নেই, বঙ্কিম নেই, শরৎচন্দ্রটি অবধি অনুবাদে পড়ে! উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিৎ, কলেজ স্ট্রিট, অপুদুগ্গা, যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচার, ইস্টবেঙ্গল, ফিশ ফ্রাই, রোববারের মাংস ভাত– কিচ্ছু নেই।
১৩.
ইদানীং বাঙালির এসবে আর ভয়-ফয় নেই। যে পাথর আঙুলে ধারণ করা যায় না, সে মাল মিকচার মেশিনে ফেলে ট্যাকচার বানাতে বড়জোর দু’মিনিট। তারপর কার কী হল, তাতে থোড়াই পরোয়া! সে টেনে চেপে একটিপে হেটো রামপুরের তারাপীঠ থেকে বোলপুর গুরুপীঠ মেরে বদ্দোমানের সীতাভোগ-মিহিদানা লিয়ে বাড়ি ফিরে ওপিচার্স চয়েচের উপাচার সাজিয়ে বউকে বলবে, ‘‘দুটো ভাতে ভাত বসিয়ে দাও, ক’দিন খুব হল।’’ মশাইটির সামান্য টোকো উদ্গারে বলির পাঁটার সুবাস, খাটে বাবু হয়ে বসলে সেলিকল ফ্লেভার্ড কুঁচকি থেকে কিউটি ক্যুরা বগল অবধি পাখার হাওয়ায় ফুরফুরে, এবং দেওয়ালে ঝোলানো বড়মা থেকে খাটের ছত্রি জুড়ে ভিজে গামছার অ্যারোমা অবধি তাবৎ ব্রহ্মাণ্ডে বিছানো রেলপথের দু’ধারে কেবল কাশবন, অপু-দুর্গার দৌড়াদৌড়ি, আর ছোট বগিতে বাঙালির তুমি ফুটবল। অতএব বাঙালি অবিনশ্বর। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতোই কোয়ান্টাম বাঙালি, মাঝখানে বালি ওই তুলে নিয়ে যায়!
পড়ুন ‘ভয়বাংলা’-র আগের পর্ব: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
কাপ্তেন বাবুদের থ্যাটারি আস্তানা ঘিরে ‘পাড়ার ছোঁড়ারা সব বিশ্বকর্মার পিঠে ইট’ মেরেছিল মনে আছে? সন্ত্রস্ত বেণিমাধব চাটুজ্জে ঢাল খুঁজেছিলেন বাকিদের সঙ্গে, পরে তরোয়ালও– সেটিও নিশ্চিত টিনেরই ছিল। তবে যারা ইট মারে, তাদের বুনিয়াদি চরিত্র সম্পর্কে নটুয়াদের ধারণা সাফ, সেটা বেশ বোঝা গেছিল। আঙুর দ্বর্থহীন ভাষায় ময়নাকে বলেছে, ‘সামনের চার সারি মাতাল বাবুর দল’– অর্থাৎ, বর্ধমান এবং ভূকৈলাশের রাজা, কিশোরীলাল তর্কপঞ্চানন, দলের স্বত্ত্বাধিকারী বীরকৃষ্ণ দাঁ ইত্যদি ছাড়াও কখনও স্বয়ং ল্যাম্বো সাহেব। ওদের ডিঙিয়ে ‘পিছনে মানুষ, দশর্ক, আমাদের দেবতা’– ডেমোগ্রাফিক ভাগটা আঙুরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জনিত ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। কাপ্তেনবাবুকেও আবার ওই আঙুরই ‘স্বর্ণ সিংহাসন ছেড়ে’ বেশুমার বাঙালির পানে তাকানোর আহ্বান জানায়, ‘ছোটলোকদের দিকে’ চেয়ে দেখতে বলে হয়তো তার নিজের যাওয়ার কোনও জায়গা না থাকার কারণে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা পরিসরটির রাজনৈতিক গুরুত্ব বাকি সমস্ত আয়োজনকে– ওই টিনের তলোয়ার ইত্যাদির আস্ফালন ইত্যাদি– ছাপিয়ে যায় বলে। সে কি ভেবেছিল যে, ওই ছোটলোকদের কাতারে হঠাৎ তার মুখটাও একঝলক ভেসে উঠতে দেখবে কাপ্তেনবাবু? অবস্থান পাল্টাবে চরিত্র এবং দর্শক, ফলে শিল্পীর মুঠো আলগা হয়ে ক্রমশ খসে পড়া আত্মপরিচয়ের খড়কুটোগুলি আঁকড়ে থাকা সহজ হবে? একবার বহু লোকের মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে পারলেই কেবল ম্লান, ক্ষয়ে যাওয়া আলোর রোশনাই কাঁচিয়ে ফিরবে সে, ঝলমল করবে আবার, নদেরচাঁদ বাচষ্পতির ভাষায়, ‘পোষা বেশ্যা’ থেকে ফের মায়াজগতের পরীর মতো উড়তে পারবে? কে জানে!
গোষ্ঠীচেতনায় এক ছটাক জমির খোঁজ বাঙালি শিল্পীর বরাবরই। ‘চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই’ থেকে ‘দেহী পদপল্লবমুদারম’ উচ্চারণ অবধি পারটিসিপেশনের নানাপ্রকার উচ্চারণে বহুবিধ হেরফের লক্ষিত হয়েছে– কখনও এমনকী, খানিকটা থ্রেটনিংও দিয়ে দেখেছে সে। যা আদতে প্রণিধানযোগ্য তা হল, কিছুটা শহুরে, মধ্যবিত্ত, রেনেসাঁসের হাওয়া অল্প-বিস্তর লেগেছে এমন ব্যক্তির রাজনৈতিক বোধটি ওই সাংস্কৃতিক চেতনা-প্রবাহে যোগ দেওয়ার, বা কোনও অবস্থাতেই তাতে গা না ভাসানোর সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে তৈরি, বাপের ঠাকুদ্দা ছাগলের দুধ খেত বলে বিনোবা ভাবের শিষ্য হয়েছে, এমন বাঙালির সংখ্যা তাই এখনও একরকম বিরলই বলা যায়। সাতের দশকে সুচিন্তিত ব্যক্তিগত প্রয়াসগুলির তুলনায় কৌম আবেগে ভেসে যাওয়ার নিদর্শন অনেক বেশি, তবে বড়সড় পালাবদলের দিনগুলির পর্যালোচনার কালে পূর্ববর্তী অর্ধশতাব্দী জুড়ে একটানা রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার, শহরে গ্রামে পুলিশের নিপীড়ন অগ্রাহ্য করে মজদুর সংগঠন তৈরি থেকে কৃষক সভার আন্দোলন, প্রাণের বিনিময়েও আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার উদাহরণগুলি ভুললে চলবে না। হয়তো ইংরিজি শিক্ষার জন্যেই রুশ বিপ্লবের গল্পগুলি বাঙালি আত্মস্থ করেছিল অন্যদের তুলনায় সহজে। ফ্যাসিজম, নাৎসি বাহিনীর অপরাধের বেসিক স্ট্রাকচারগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত সাম্রাজ্যবাদের নতুন ধাঁচায় ইনকর্পোরেটেড হলে বাঙালির বুকে ভয় ধরায়নি তা নয়, তবে সে প্রতিরোধের ইতিহাস সম্পর্কেও সমান ওয়াকিবহাল ছিল। অতএব, হঠাৎ একদিন বোতলে করে চাড্ডি ‘Mooত্র’ এনে ‘খেয়ে ফেল, নইলে রাম লক্ষণ ক্যালাবে’ বললেই বাঙালি চমকাবে, এতটা আশা করা উচিত হয়নি।
পড়ুন ‘ভয়বাংলা’-র অন্য পর্ব: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
সত্যিই কয়েকটা গুজু আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে হিসি খাওয়াতে চাইছে, আর সে প্রোজেক্টে চামচেমি করছে কিছু পা-চাটা অশিক্ষিত জানোয়ারের বাচ্চা টাইপের বঙ্গ সন্তান– এই রসিকতাটি ইন ইটসেল্ফ ভীষণ অপমানজনক! ওই হনুমান জাম্বুমান ইত্যাদি প্রাইমেট দেখলেই কমলা গেরুয়া নেংটি এঁটে পুজো করা পাবলিকদের সঙ্গে আমাদের একাসনে বসাতে চাইছে মাইরি! তাও আবার প্রসাদে মুড়ি, নকুলদানা আর পেঠা না কীসব অখাদ্য পিণ্ডি! মিষ্টি বলতে প্যাঁড়া। বাড়িতেও হিন্দিতে কথা কয়! খৈনি খায়! রবীন্দ্রনাথ নেই, বঙ্কিম নেই, শরৎচন্দ্রটি অবধি অনুবাদে পড়ে! উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিৎ, কলেজ স্ট্রিট, অপুদুগ্গা, যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচার, ইস্টবেঙ্গল, ফিশ ফ্রাই, রোববারের মাংস ভাত– কিচ্ছু নেই। তাও তো সবটা বলে উঠতে পারিনি। আমাদের নাকি গোবর মাখিয়ে হিসি খাওয়াবে! আমাদের! কতবড় অডাসিটি ভাবুন একবার! দালালি করছে কে– কঙ্গনা ‘রানআউট’। যত বড় বুক নয় তত বড় কথা! মালগুলোর আর্ট দেখেছেন? আবির ছড়িয়ে আলপনা দেয়। তারপর ‘পানির’ খায়। ভেগান হাফউইট যতসব! পাগড়ি পরে ঘোড়ায় চড়ে বাজি ফাটিয়ে নাচতে নাচতে বরযাত্রী যায়! বারবারিয়ান্স! নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই– আফটার অল এখানকার ক্লাউনগুলো অলমোস্ট বাঙালি! পরে অবিশ্যি খোঁজ নিয়ে দেখলাম বেশিরভাগই লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক টাইপের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বুকে হেঁটে দু’পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছে। সে থাক। জুতোপেটা বহু ইতরামি সালটেছে, এবারও তার ব্যাত্যয় হবে না। কহ গো সজনী, এ প্রভাতে, বিষাদে কে রহে…
আসলে গত বেশ কয়েকশো বছর যাবৎ আমাদের অ্যাটিটিউডটাই হল ‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দোব না’ টাইপের গাছাড়া মনোভাব। কবে থেকে স্টোনম্যান পুষছি দেখুন দেখি! মাল খেয়েও টিপ ফসকায় না, সোজা টাকে হিট করছে। পাশাপাশি দোকনো মার্কসবাদের ‘ভক্তিমূলে বাস্তুবাদ’ ইত্যাদিতে লুটোপুটি জয়নগরবাসীর সে কী আকুতি– ‘‘যদি এসইউসিআই না থাকত, তবে ‘লেলিনকে’ কি চিনত লোকে?’’ প্রশ্নের ঝোঁকটা ‘লেলিনে’ নয়, বরং উক্ত রাজনৈতিক দল তাক করে– নদীর ধারে কাদায় লুটোপুটি প্রতিবাদীরা উত্তমকুমার সেজে ধেনো টেনে গান গেয়ে সামাজিক অসাম্যের ক্লাস নিচ্ছে। দোষ কারও নয় গো মা! আমরাই খাল কেটে কুমির এনিচি।
কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।