বাঙালি কাছাখোলা জাত ঠিকই, তবে সে চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’ ছবির যুক্তি-কাঠামোটি ধরেছিল স্পষ্ট। সেখানেও তো খুদে স্টোনম্যান! ঢিল মেরে জানালার শার্শি ভাঙছে যাতে বাপের দু’পয়সা রোজগার হয়। আমাদের সবসময় মনে হয়েছে ‘আহারে, আর দুটো বাড়তি ভাঙলিনে কেন বাপ, তাহলে টেবিলে গোলারুটির সঙ্গে চাড্ডি স্টেকও জুটতো… শীতের দেশ, কচি খোকাটির গায়ে মাংস নেই মোটে!’ আমি শিওর, যারা প্রথম দিন সে ছবি দেখে হল থেকে বেরিয়েছিল, তারা প্রত্যেকে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পাথর কুড়িয়ে একদিন পৃথিবীর সমস্ত জানালার কাচ ভাঙার, দরজা ওপড়ানোর, দেওয়াল ধসানোর সংকল্পে চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ভবিষ্যতের পানে।
৯.
আমার ছেলেবেলা বলতে সাতের দশক। বাঙালি সদ্য একটা দেশকে স্বাধীন করেছে, তাকে ভয় দেখানো অতএব সহজ ছিল না। তার ওপর ‘আমাগো ফিদেল’-এর বিপ্লব তখনও টাটকা– মানে বাঙালের প্রাণে কিউবা থেকে ‘ত্যার্যাশকুবা নাইচ্চা বেরাইতাছে!’ নকশালরা এর মাঝখানে কীভাবে ঢুকে পড়ল কে জানে! সত্যেন বোসের মতো বিজ্ঞানী এবং রবিঠাকুরের মতো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের দেশে বিপ্লবের দায়িত্ব কিছু আকাট মূর্খ এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হাবার হাতে গেল কীভাবে? প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্তে হস্তরঞ্জিত করাই বিপ্লবীদের কর্তব্য, তা মিটিং ডেকে পাস হয়েছিল। তাই বন্দুক নয়, ছুরি দিয়ে খুন করাটা সাব্যস্ত হয়। এটা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত? গেঁজেলদের নয়? এছাড়াও, কৃষকরা বন্দুক নয়, কাস্তে-কোদাল বাগিয়েই আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ মিলিটারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে– ইত্যাদি ছিল চারু মজুমদারের আজগুবি খোয়াইশ। গোড়ায় এই ধরনের ম্যানিফেস্টোকে ফাজলামো মনে হতেই পারে– আহা বেচারা, একটানা বিপ্লবের ফুল-বেলপাতা-চাঁদমালা গোছানোর ফাঁকে একটু মশকরা করে নিলে! তবে যখন দেখি যে, এই সবই ‘প্রবল সিরিয়াস’ চিন্তার ফসল, যখন বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নিষ্ঠুর হাস্যরসের বীভৎসতা বোধগম্য হয়, তখন আর হাসি পায় না। মানুষকে মানুষ মনে না করার, নিজেদের ক্ষুদ্র, অকিঞ্চিৎকর স্বমেহন-সম্বল জীবনগুলিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জাতির ভাগ্য-নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানোর এক মহা-নার্সিসিস্টিক যজ্ঞে মেতেছিল এরা। গরিব মানুষের প্রতি সীমাহীন ঘৃণা এবং অবজ্ঞা ছাড়া এই রাজনৈতিক অবস্থান অসম্ভব।
আরও পড়ুন ভয়বাংলা: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
অতএব, বলা যেতেই পারে, এদের হাতে বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রের শাসনভার গেলে জনগণের দুর্দশার সীমা থাকবে না, এ জাতীয় ভয় মানুষ পেয়েছিল। স্টোনম্যানের বীভৎস উপায়ে, একেবারেই অকারণে– সব খুনই অকারণ মৃত্যু, তাই না? তবে দাউ শ্যাল নট ‘কিল’ এবং দাউ শ্যাল নট ‘মার্ডার’-এর পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সে বিষয়ে পরে ফিরব। মানুষ খুন করলেও, সেই সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তির ঠেকনা জোগানোর সামাজিক ইতরামির খেলায় ‘নৈতিকতা’ নামক মামদোবাজির, প্রকারান্তরে, সাধারণ মানুষের ঘাড়ে দায় চাপায়নি কেউই। নকশালরা ‘বাম কে নাম’, আর হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী সন্ত্রাসবাদীরা ‘রাম কে নাম’ এক করে দেওয়ায় গরিবের কাঁধে বন্দুক রাখার একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। অতি-বাম আর অতি-দক্ষিণের হলাহলি, গলাগলি বাঙালি আগে বোঝেনি? হতে পারে? সে তো চায়ের ঠেক থেকে গুরুগম্ভীর সেমিনার অবধি ডাইনে-বাঁয়ে কেবল উজির-নাজির মারে। বুঝেছিল, অথচ কলার উল্টে ‘জানে কাঁহা মেরা জিগর গয়া জি’ গেয়ে পার পেয়ে যাবে ভাবল? পেত্যয় হয় না।
বাঙালি কাছাখোলা জাত ঠিকই, তবে সে চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’ ছবির যুক্তি-কাঠামোটি ধরেছিল স্পষ্ট। সেখানেও তো খুদে স্টোনম্যান! ঢিল মেরে জানালার শার্শি ভাঙছে যাতে বাপের দু’পয়সা রোজগার হয়। আমাদের সবসময় মনে হয়েছে ‘আহারে, আর দুটো বাড়তি ভাঙলি নে কেন বাপ, তাহলে টেবিলে গোলারুটির সঙ্গে চাড্ডি স্টেকও জুটত… শীতের দেশ, কচি খোকাটির গায়ে মাংস নেই মোটে!’ আমি শিওর, যারা প্রথম দিন সে ছবি দেখে হল থেকে বেরিয়েছিল, তারা প্রত্যেকে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পাথর কুড়িয়ে একদিন পৃথিবীর সমস্ত জানালার কাচ ভাঙার, দরজা ওপড়ানোর, দেওয়াল ধসানোর সংকল্পে চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ভবিষ্যতের পানে। কেউ ভাবতে বসেনি খোকা ডেলিংকুয়েন্ট হিসেবে বড় হলে একদিন এইসব লুম্পেন প্রেতারিয়েতদের সামলানো কঠিন হবে। যদিও সে আশঙ্কায় দল চালানো নেতাদের গোপন মিটিং-ঘরে হানা দেওয়াটা স্বাভাবিক– কারণ শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে তাদের ধোঁয়াটে চেহারা ছবি কেবলই সোমনাথ হোড়, চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিনদের তৈরি আদল ধাঁচা ধার করে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল প্রতিদিন। গণতান্ত্রিক ধাপ্পাবাজি এবং পুঁজিবাদী মুনাফার সওদা-বোঝাই নৌকাটিকে এই রাষ্ট্রের বদ্ধ জলা ঠেলে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ঘাটে ভিড়িয়ে তবে বেণি বাঁধবে– কমিউনিস্ট পার্টি এমন দাবি করেছে। অসহিষ্ণু শ্রমজীবীদের সংযত হতে বলা ছাড়াও, তাদের যে কখনওই সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে না, সে আশ্বাসও পার্টির নেতারা চাচ্চাহা নেহরুর শ্রীচরণ ছুঁয়ে পোতিগ্গে করে আসেন। গোটা উত্তর ভারতের নিপীড়িত, উদ্বাস্তু, গৃহহীন, নিরন্ন, নিম্নবর্ণ কুলি-কামিন চাষা-মজুর একদিন এই চক্করে পড়েই ‘জয় শ্রী রাম’ হুংকার দিয়ে উঠল কি না, সে নিয়ে তর্ক মিটবে কি হে, সবে তো প্রথমাঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক, অতএব নাটকের গতি ইদানীং কেবলই তীব্র হইয়া উঠিতেছে। তবে বাঙালি বছর ৫০ আগে অদ্দুর উঁকি মারার প্রয়োজন বোধ করেনি– ‘আরে বাওয়া, এরা কোনও দিন বিপ্লবের আগুনে ঝলসানো জনগণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।’ লাও! ঠেলা সামলাও!
আরও পড়ুন ভয়বাংলা: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
এর মাঝে গাছে কোকিল ডেকেছে, আমরা স্কুলে গেছি, পুলিশের রাতের বেলায় হাসপাতালগুলোয় ঘুরে ঘুরে গুলি খাওয়া আহতদের হাত থেকে স্যালাইন, ওষুধের চ্যানেল এবং নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে নিয়েছে, এবং দিনের বেলায় দর্জির দোকানে বেলবটমের ঘের আর স্লিভলেস ব্লাউজের খুঞ্চুমুঞ্চু নিয়ে লটকালটকিও চরম। রাজেশ খান্না-মুমতাজ একদিকে, অন্যদিকে আরডি-কিশোর। এসডিও ফাটাফাটি! ১৯৭৬ সালে বোম্বাই থেকে রিলিজড ছবিগুলোর নাম– ‘ছোটি সি বাত’, ‘চিতচোর’, ‘দো অনজানে’, ‘কভি কভি’, ‘কালিচরণ’, ‘ফকিরা’, ‘চরস’, ‘হেরাফেরি’। ১৬ জুন, ১৯৭৬, সোয়েটোর রাস্তায় নিরস্ত্র দক্ষিণ আফ্রিকার ছাত্রদের মিছিলে বর্ণবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদী সরকার গুলি চালানোর হুকুম দেয়– ছোটি সি বাত, অর্থাৎ ছোট্ট ঘটনা। খবরটা পাই অনেক পরে– উত্তরবঙ্গে সব খবরই একটু দেরিতে পৌঁছত। কলকাতার কিছু বৈঠকখানায় তা এখনও পৌঁছয়নি দেখে তৎকালীন ব্যাকওয়ার্ডনেস নিয়ে অ্যাপোলোজেটিক হই না আর। সে থাক। শুনেছিলাম সোয়েটোর মারমুখী ছাত্ররা আন্দোলনের তৃতীয় দিনে পুলিশের গাড়ি এবং বন্দুকের বিরুদ্ধে মরিয়া লড়াই চালিয়েছিল, ঊর্ধ্বগগনে চক্কর কাটা, আগুন উগরানো একনিষ্ঠ মেশিনগান, হেলিকপ্টার তাক করে পাথর ছুড়েছিল টানা। প্যালেস্তাইনে সেটি নিত্যকার ঘটনা। কায়রো, বাগদাদেরও সাম্প্রতিক ইতিহাস। সর্বত্র স্টোনম্যান। ট্যাঙ্ক, কামান, বন্দুক, গোটা সাজোয়া বাহিনী, মিসাইল, গ্রেনেড– কোনও কিছুর পরোয়া নেই। রাস্তা থেকে আধলা তুলছে আর দে দনাদ্দন! আর কী টিপ মাইরি! কেন জানি না, ছবিগুলো দেখলে মনে হয় পুরনো পলেস্তরা খসা দেওয়ালের পিছন থেকে ‘দ্য কিড’-এর সেই খোকা আর আমাগো চাল্লি উঁকি মেরে দেখছে কারও তাগ ফসকাচ্ছে কি না। পাথর ছোড়ার দল মনে হয় জানে যে, ওই চোখগুলো ওদের শরীরে গেঁথে বসা বুলেট-ক্ষতের ওপর ঘুরছে সার্চলাইটের মতো। হিসেব রাখছে যুগ যুগ ধরে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।