Robbar

এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 18, 2025 3:39 pm
  • Updated:May 19, 2025 11:49 am  
14th episode of blotting paper by Swapnamoy Chakraborty

সুভাষদা তখন তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে মৃদু হোঁচট খেলেন। ‘হাবড়া যানেওয়ালি’ যুবতী ইঞ্জিনটা কোমরে ওড়না-টোরনা পেঁচিয়ে মুখে গুটকা দিয়ে এবার যাওয়ার উপক্রম করছে। আমি দ্রুত ছুটে যাই, ‘রোকিয়ে রোকিয়ে’ বলতে বলতে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামি। ট্রেন একটা হুইসেলে ‘যাচ্ছি’ বলে দিয়েছে। আমি গার্ডের কামরার দিকে ছুটতে ছুটতে বলি– ‘এম.পি-এম.পি-এম.পি!’ ট্রেন থেমে যায়। গার্ড বলেন, ‘এম.পি মতলব সাংসদ?’

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

১৪.

কবি সুভাষ মুখোপাধ‌্যায়কে ট্রেনের চেকার বলেছিলেন, ‘আভ্‌ভি উতর যাইয়ে। নিকলো ট্রেন সে। ধাপ্পাবাজ, ধোঁকা দেনেওয়ালা আদমি…!’ আমিও ছিলাম সেই ট্রেনের কামরায়। ব‌্যাপারটা বলে ফেলি।

সময়টা ১৯৯৭-’৯৮। সুভাষ মুখোপাধ‌্যায়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সৃজন উৎসবে। সৃজন উৎসব পুরুলিয়া জেলায় কাঁসাই আর কুমারী নদীর মোহনার কাছে একটা টিলাকে ঘিরে হত। যাঁরা এর জন‌্য সাংগঠনিক কাজকর্ম করতেন, তাঁদের প্রধান একজন হচ্ছেন আমাদের লেখক-বন্ধু সৈকত রক্ষিত।

সৃজন উৎসবের কথা একটু বলি। ওরকম একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে শীতের শেষের দিকে, প্রায় বসন্ত সময়ে পূর্ণ জ‌্যোৎস্না-রাতে তিনদিন ধরে চলে লোকগান, ঝুমুর, নাচনি, গণসংগীত, কবিতাপাঠ, আঞ্চলিক নাচ-গান-বাজনা। স্থানীয় শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা এতে অংশ নিতেন। শহর থেকেও কিছু মানুষজনকে নিয়ে যাওয়া হত। আমি বারতিনেক গিয়েছি, প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় তিন-চারবার। অনেক খ‌্যাতিবান কবিরাও গিয়েছেন– বিপুল চক্রবর্তী, স্বপন বসুরাও। থাকার ব‌্যবস্থা টিলার গায়ে তাঁবুর ভিতরে। মাটির ওপর খড় বিছানো। কম্বল নিজেদের নিয়ে যেতে হত।

পাহাড়ের তলায় হাঁড়িয়া বেচুনিরা বসে যেত। খোঁজ করলে মহুয়াও পাওয়া যেত। পাঁপড়, তেলেভাজা, ছোলা, মুড়ি– এসব তো ছিলই। কাছাকাছি ছিল আদিবাসী গ্রাম। ওরা মূলত সাঁওতাল। গ্রামের নিকানো উঠানে ঘরের বাইরের দেওয়ালে শুঁড় ওঁচানো হাতি কিংবা পেখম তোলা ময়ূরের ছবি আঁকা। গোবর-নিকানো উঠোনে শিশুরা করে খেলা।

একটা টিলা পাহাড়ের উপরে উঠলে একটা বড় চত্বর, তার উপরে, পাহাড়ের মাথায় অনেকটা জায়গা চাঁচা-লেপা। এসব সমান জায়গাগুলিতে মঞ্চ। ঝুমুর নাচলেন গীতারানি, তারপরই গান গাইবেন অজিত পাণ্ডে। অজিত পাণ্ডের গান শেষ হলে কবিতা পড়তে উঠবেন মন্দাক্রান্তা সেন, বসে আছেন কালীকৃষ্ণ গুহ।

‘ওরে কালা কেনে গেলি মথুরায়, সর্ব অঙ্গ জ্বলে যায়, আয় কালা আয়।’ গীতারানি দু’হাতের আঙুলের খেলায় ‘আয় আয় আয়’ করছেন, তখনই এলেন সুভাষ মুখোপাধ‌্যায়, সঙ্গে কার্ত্তিক মোদক। বললেন, ‘এসে গেছি। এসে গেছে কালা।’ সারা মুখে বর্ষা নামিয়ে হাসলেন।

সুভাষ মুখোপাধ‌্যায় সেই রাতে ওখানেই ছিলেন, তবে খড়ের বিছানা নয়, আলাদা একটা ঘরের ব‌্যবস্থা ছিল। সুভাষদা পরদিন কবিতা বললেন, কথাও। দুপুরে ফেরা। পুরুলিয়া স্টেশনে নামিয়ে দেবে একটা গাড়ি। অ্যাম্বাসাডর, পিছনে সুভাষ মুখোপাধ‌্যায়, কার্ত্তিক মোদক, আর একজন মেদিনীপুরের লোকশিল্পী। আমি সামনে। কথা ছিল স্টেশনেই টিকিট কাটা হবে। ফাঁকা ট্রেন, ভিড় হবে না তেমন। সুভাষ মুখোপাধ‌্যায়ের মতো অতিথির জন‌্য কেন আগে-ভাগে টিকিট কেটে রাখা হয়নি, জানি না। হয়তো অতিথির নাম ‘সুভাষদা’ বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল।

যখন স্টেশনের কাছাকাছি, তখনই রেলের সেই পেটেন্ট সুরে ঘোষণা– শুনতে পাচ্ছি, ‘হাবড়া যানেওয়ালি… ডাউন…।’ স্টেশনের সামনে যখন গাড়িটা থামল, ট্রেন তখন প্ল‌্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। এই ট্রেনটা না ধরতে পারলে পরের ট্রেন তিন ঘণ্টা পর! বাড়ি ফিরতে খুব রাত হবে। কার্ত্তিকদা বললেন, ‘টিকিট কাটতে হবে না এখন। খড়্গপুরে নেমে গিয়ে টিকিট কাটবোখুনে। ওখানে অনেক ট্রেন। যদি চেকার ধরে, তখন দেখা যাবে। এমএলএ, এম.পিদের যদি টিকিট ফ্রি হয়, জ্ঞানপীঠ পাওয়া কবিরও ফ্রি।’

আমরা ওভারব্রিজে। সুভাষদা তখন তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে মৃদু হোঁচট খেলেন। ‘হাবড়া যানেওয়ালি’ যুবতী ইঞ্জিনটা কোমরে ওড়না-টোরনা পেঁচিয়ে মুখে গুটকা দিয়ে এবার যাওয়ার উপক্রম করছে। আমি দ্রুত ছুটে যাই, ‘রোকিয়ে রোকিয়ে’ বলতে বলতে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামি। ট্রেন একটা হুইসেলে ‘যাচ্ছি’ বলে দিয়েছে। আমি গার্ডের কামরার দিকে ছুটতে ছুটতে বলি– ‘এম.পি-এম.পি-এম.পি!’ ট্রেন থেমে যায়। গার্ড বলেন, ‘এম.পি মতলব সাংসদ?’

আমি বলি ‘হাঁ জি।’ ওভারব্রিজের দিকে আঙুল দেখাই। তখন কার্ত্তিক মোদকের কাঁধে ভর করে সুভাষদা আসছেন। ট্রেনের গার্ড ওই লম্বা, সরু পাজামা এবং খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা একমাথা উসকো চুলের মানুষটিকে দেখতে পান। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর এক সহৃদয় আরপিএফ ওঁকে হাত ধরে তোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। গার্ড ভাবলেন, এই চেহারার লোক যে-সে এম.পি. নন, জর্জ ফার্নান্ডেজ টাইপের এম.পি।

ট্রেনটি থেমেই থাকে। ওভারব্রিজ থেকে নেমেই সামনে যে কামরাটা সেখানেই তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন, সুভাষদা আর কার্ত্তিকদা। আমিও। ট্রেনের কামরায় বসার জায়গা পেয়েছিলাম সবাই, পরের স্টেশনে ট্রেনটা একটু বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়েছিল। কারণটা বোঝা যাচ্ছিল না। বুঝলাম এবার।

একজন চেকার এসেছেন, সঙ্গে দু’জন রেল কর্মচারী। একজনের হাতে ট্রে, অন‌্যজনের হাতে কেটলি। ট্রে-র ওপরে কেক, বিস্কুটের প‌্যাকেট, প‌্যাড়া, বোতলবন্দি জল এইসব সাজানো।
‘আদরণীয় সাংসদজি কাঁহা হ‌্যায়? মেরা মহামান‌্য সাংসদ?’
সুভাষদাকে দেখতে পান ওঁরা। ততক্ষণে ট্রেনের অনেকে সুভাষদাকে চিনে ফেলেছে। কারণ, কয়েকজন অধ‌্যাপক-অধ‌্যাপিকা ছাত্রছাত্রী-সহ ওই কামরায় ছিলেন। যখন জানতে পারে সুভাষ মুখোপাধ‌্যায় এখানে এসে উঠেছেন, অনেকেই অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। ঘিরে ধরেছে। তখনও সেলফি যুগ আসেনি।

…………………………….

চেকার মহোদয় প্রথমেই দু’-হাত জোড় করে বললেন, ‘পরনামজি।’ সুভাষদা একবার কার্ত্তিকদার মুখের দিকে একবার জানালার ওধারে আদিগন্ত মাঠের দিকে তাকালেন। এবার আমার দিকে। একটু অবাক। বিনা টিকিটের যাত্রী। প্রণাম বলছে কেন? তাহলে বোধহয় বয়সটা বেশি বলে আগে প্রণাম জানাল। বেশ ভদ্র, শিক্ষিত চেকার নিশ্চয়ই। দেশ থেকে সুশিক্ষা চলে যায়নি এখনও। সুভাষদা এবার হাতজোড় করে প্রতি নমস্কার জানালেন।

…………………………….

ঘিরে ধরা মানুষটি নিশ্চয়ই এম.পি। চেকার মহোদয় প্রথমেই দু’-হাত জোড় করে বললেন, ‘পরনামজি।’ সুভাষদা একবার কার্ত্তিকদার মুখের দিকে একবার জানালার ওধারে আদিগন্ত মাঠের দিকে তাকালেন। এবার আমার দিকে। একটু অবাক। বিনা টিকিটের যাত্রী। প্রণাম বলছে কেন? তাহলে বোধহয় বয়সটা বেশি বলে আগে প্রণাম জানাল। বেশ ভদ্র, শিক্ষিত চেকার নিশ্চয়ই। দেশ থেকে সুশিক্ষা চলে যায়নি এখনও। সুভাষদা এবার হাতজোড় করে প্রতি নমস্কার জানালেন।
‘আইয়ে লিজিয়ে। থোড়া সা নাস্তা হ‌্যায়। পানি পিজিয়ে। চায় কা ভি ইন্তেজাম হ‌্যায়।’
সুভাষদা বললেন, ‘হ‌্যাঁ। ভালোই তো, জলতেষ্টা তো পেয়েছিল।’ জলের বোতলটার গলা ধরে নিজের গলায় ঢাললেন।
চেকার মহোদয় এবার বললেন, ‘আভি মেরা সাথ চলিয়ে, স‌্যর।’
সুভাষদা ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কাঁহা?’
– ফার্স্ট ক্লাস মে।
– কিউ?
– মতলব। ‘আপ সাংসদ হ‌্যায় না, ট্রেন রুকা হুয়া হ‌্যায়, আপকো ফার্স্ট ক্লাস মে…’।
সুভাষদা বলেন, ‘কী কার্ত্তিক, একটু দেখো না ওরা সব কী বলছে…!’ চেকার মহোদয় হিন্দিতে বলেই চলেছেন– কিছুতেই আনরিজার্ভ কামরায় সফর করতে দেওয়া হবে না। এসব এখন আর হয় না। গান্ধীজির আমলে হত। জয়প্রকাশ নারায়ণ এরকম করতেন। এই বঙ্গালে কিছু কিছু কমিউনিস্ট এম.পি. আছে, এই রকম করে। সিকিউরিটিও নেয় না। অথচ আমাদের ওধারে প্রত‌্যেক এম.এল.এ. এম.পি-র পুলিশ গার্ড তো আছেই, সেই সঙ্গে পার্সোনাল ব্ল‌্যাক বডি থাকে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন স‌্যর, ফার্স্ট ক্লাসে বসিয়ে দিই।
সুভাষদা বললেন– আপনি কিছু একটা ভুল করছেন। আমি সাংসদ নই।

ইতিমধ‌্যে গার্ড সাহেবও এই কামরায় ঢুকে গেছেন।
চেকার সাহেব বারবার বলছেন, ‘আপনিই সাংসদ। গার্ড সাহেব আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন…’। সুভাষদা বলছেন, তাহলে অন‌্য কেউ হবে।
ইতিমধ‌্যে গার্ডের চোখের জালে আমি ধরা পড়ে গেছি। আমিই, তো ‘এম্পি-এম্পি’ করে গার্ডকে বলে ট্রেনটা থামিয়েছিলাম। গার্ড আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কাঁহা হ‌্যায় তুমহারা এমপি মহোদয়?’ আমি হাত কচলে বলি, এম.পি. নয়। মহান কবি। জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়া কবি। সাহিত‌্য একাডেমি, জ্ঞানপীঠ, রবীন্দ্র পুরস্কার সবই পেয়েছেন ইনি। একজন এম.পি-র চেয়ে এরকম একজন কবির সম্মান অনেক বেশি।
‘বকওয়াশ মৎ কর…’ হুঙ্কার দিলেন চেকার। ‘টিকিট কাঁহা?’

শিল্পী: শান্তনু দে

কবি কার্ত্তিক মোদক হাত কচলে শান্তিপুরী হিন্দিতে বললেন– ‘টিকিটের ফুসরত নেহি পায়া, টিরেন আ গিয়া, তাই উঠ গয়া। টিকিট আভি আভি দিয়া যায়, জ্ঞানপীঠ প্রাপ্ত কবি হ‌্যায়…’। তখনই সেই মোক্ষম বাক‌্য– যা প্রথমেই বলেছিলাম।

শেষটা অবশ‌্য ভালোই হয়েছিল। কলেজের অধ‌্যাপক, ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করেছিল। এবং জানিয়েছিল, দিল্লির মন্ত্রীরা সব এঁকে চেনে। খারাপ ব‌্যবহার করা হয়েছে এরকম নালিশ যদি করে দেন– আপনাদের ভালো হবে না। শেষ অবধি গার্ড সাহেব বললেন, ‘খড়্গপুর স্টেশনে নেমে আপনাদের কেউ টিকিট কেটে আনবেন। এখানেও টিকিট কাটা যায়, কিন্তু স্পটে কাটতে হলে জনপ্রতি ২০০ টাকা করে ফাইন দিতে হবে। সুতরাং, খড়্গপুরেই। টিকিট কেটে এলে জানাবেন, তখন ট্রেন ছাড়া হবে।’

টিকিট কাটতে আমিই গিয়েছিলাম। এবং জানিয়ে রাখি। ট্রেনটা সেদিন ৫০ মিনিট লেট করে ঢুকেছিল হাওড়ায়। কারণটা এতদিনে জানলেন।

…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…

১৩. ভারত কিন্তু আম-আদমির

১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’

১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না

১০. জনতা স্টোভ, জনতা বাসন

৯. রামেও আছি, রোস্টেও আছি!

৮. বাঘ ফিরেছে বাগবাজারে!

৭. রেডিওর যত ‘উশ্চারণ’ বিধি

৬.হৃদয়ে লেখো নাম

৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু

৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য

৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল

২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন

১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী