আকাশবাণীর স্টুডিওর মূল দরজাটা খুললেই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ-মূর্তি। টিফিন কৌটোটা খবর কাগজে মুড়ে দড়ি কিংবা সুতো দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটার পিছনে রেখে দিতাম, সন্ধের সময় টুক করে তুলে নিতাম। কয়েকদিন এভাবেই চলল। কেউ কিছু জানত না। জানলেই বা কি আছে, এটা তো বেআইনি কিছু নয়! এইসময় পরপর এখানে-ওখানে বোমা উদ্ধার হতে লাগল। জঙ্গি হামলা বেড়েছে খুব। মুম্বইয়ের একটা প্রেক্ষাগৃহ থেকে উদ্ধার হল, দিল্লির বাস টার্মিনাসে বোমা ব্লাস্ট হল। কাশ্মীরেও এখানে ওখানে বোমা ফাটছে। এই সময় শোনা গেল, আকাশবাণীতেও বোমা পাওয়া গিয়েছে!
২২.
১৯৬৮-’৬৯ সাল। কলেজে ভর্তি হয়েছি, রসায়নে অনার্স নিয়ে, ওই ব্যাচে একটি ছেলের কথা মনে পড়ছে, ওর আসল নামটা ভুলে গিয়েছি, যে নামটা সে অর্জন করেছিল, সেই নামটাই মনে আছে। ‘টেরিকট’।
ছয়ের দশকের মাঝামাঝি এদেশে পলি-ইস্টার ঢোকে। টেরিলিন, ডেক্রন– এইসব কাপড়ের অনেক দাম, এইসব কাপড়গুলো ধোয়া সহজ, শুকোয় তাড়াতাড়ি, মাড় দিতে হয় না। ডেক্রনের ফ্রক পরে বড়লোকের বিটিরা। বড় চাকুরেরা টেরিলিন শার্ট পরে। মধ্যবিত্ত ঘরে তখনও টেরিলিন ঢোকেনি। টেরিলিনের শাড়িও বেরিয়ে গিয়েছে। মিন্টু দাশগুপ্ত প্যারোডি গান গাইতেন। তিনি একটা গান বাঁধলেন– ‘হায় কীভাবে চালাই এই দিন… গিন্নি চেয়েছে টেরিলিন…’। টেরিলিন কেনার ক্ষমতা নেই, অথচ গিন্নির বায়না! এরপর টেরিলিনের সঙ্গে কার্পাস সুতো মিশ্রিত হতে লাগল। এই মিশ্রিত ফাইবারকে বলা হত ‘টেরিকটন’, সংক্ষেপে ‘টেরিকট’। এই সুতির মিশ্রণকে ‘ভেজাল’ বলে ভাবা হত। এখন যেমন ‘১০০ পার্সেন্ট কটন’-এর কদর বেশি, সেই সময় ১০০ পার্সেন্ট টেরিলিনের কদর বেশি ছিল। টেরিকটের বিভিন্ন ভাগ ছিল। ৭০-৩০, ৫০-৫০ ইত্যাদি। মানে টেরিলিনের ভাগ শতকরা ৭০ ভাগ, শতকরা ৫০ ভাগ ইত্যাদি।
কলেজের দু’-একজন টেরিকটের শার্ট পরে আসতে শুরু করেছিল। শার্টের গায়ে টেরিকট আঙুল ঘষে বলে দিতে পারত চরিত্র-কথা, টেরিলিনের শতকরা ভাগ। এবং সেটা মিলেও যেত। ‘টেরিকট’ নামে ছেলেটার স্পর্শানুভূতি ছিল অবাক করার মতো। স্পর্শে সে অনেক কিছু বুঝে যেত।
কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যালে অজানা লবণকে চিহ্নিত করতে হত। কোন অজানা লবণ বলতে হত– ওটা কী বস্তু? ধাপে ধাপে কিছু পরীক্ষা ছিল। প্রথমে ড্রাই টেস্ট, তারপর ওয়েট টেস্ট, তারপর কনফার্মেটরি টেস্ট। নানা রকমের ড্রাই টেস্ট ছিল, তার আগে অবশ্য রং জলে দ্রবীভূত হয় কি না ইত্যাদি দেখে নিলে একটা আবছা ধারণা পাওয়া যায়। যদি রং সাদা হয়, তাহলে জিংক, বেরিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদির যে কোনও একটা থাকবে। লাল হলে লোহা, পারদ, স্ট্রনশিয়াম ইত্যাদি। কালো হলে লোহা, সিসা, রুপো, তামা ইত্যাদির লবণ হতে পারে। কোনও কোনও লবণ খুব মোলায়েম, কোনও কোনও লবণ খরখরে।
কোনও কোনও গুঁড়োর আবার একটা গন্ধ থাকে। যেমন অনেক ধাতুর গন্ধ থাকে। ছোটবেলায় ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে লোহার শিকের গন্ধ পেতাম। বর্ষাকালে একটু আবার অন্যরকম। কাঁসার বাসনের একটা গন্ধ আছে। তামার বাসনের একটু অন্য গন্ধ। রুপোর কোনও গন্ধ নেই। সল্টগুলোর মধ্যেও কিছু সল্টের গন্ধ পাওয়া যায়। কোনও গন্ধে একটু ঝাঁঝ থাকে। টেরিকট সল্টগুলোর গন্ধও নিত। গন্ধ নেওয়ার কথা কোনও প্র্যাক্টিক্যাল বইতে লেখা থাকে না। এই গন্ধবিচার ছিল ওর নিজের আবিষ্কার। অদ্ভুতভাবে ও গন্ধ নিত। সোজাসুজি শুঁকলে অনেক সময় হেঁচে ফেলত। ও বলত, হাঁচি হচ্ছে মানে বেরিয়াম সালফেট!
আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয়। এর মধ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় একটি। অজানা যৌগ বুঝতে কানের ব্যবহার পৃথিবীর কোনও বইতেই নেই, কিন্তু টেরিকট কানকেও ব্যবহার করত। হাতে দু’-আঙুলে অজানা যৌগটি নিয়ে কানের পাশে ঘষলে একটা শব্দ হত। সেই শব্দে ও কিছু বুঝে নিত। আগুনে খাবার নুন, মানে সোডিয়াম ক্লোরাইড দিলে একটা চিড়চিড় শব্দ হয়। আবার অন্য অনেক সল্ট দিলে শব্দ হয় না। সেই শব্দটাও বুঝে নিতে পারত। আবার আলাদা আলাদা ধোঁয়া, ধোঁয়ার গন্ধ, ধোঁয়ার রং– এইসবও টেরিকটের নিজের আবিষ্কার।
ওর এক আশ্চর্য পরীক্ষা পদ্ধতি বলি এবার। তার আগে বলি, আমাদের ঠোঁট থেকে পায়ুদ্বার পর্যন্ত যে পথ, এটা এক বিশেষ ধরনের টিস্যু দিয়ে তৈরি। এর একটা নাম আছে, এখন মনে পড়ছে না। খুবই অনুভূতি প্রবণ টিস্যু। লঙ্কা লাগলে ঠোঁট জ্বালা করে। আবার পায়ুদ্বারে লঙ্কা ঘষে দিলেও খুব জ্বালা করে। খুব বেশি ঝাল খেলে জিভ জ্বালা করে, ঠোঁট জ্বালা করে আর পটি করলে অনেক সময় পটি নির্গমন স্থানও জ্বলে। অজানা যৌগ বোঝার ক্ষেত্রে শরীরের এই অনুভূতিও কাজে লাগিয়েছে আমাদের বন্ধু টেরিকট! ঠোঁটে বা জিভে লাগাত না। কারণ ওই অজানা যৌগ বিষাক্ত হতে পারে। এই দ্রব্যের সামান্য স্যাম্পেল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যেত এবং পায়ুদ্বারে সামান্য ঘষেও দিত। তখন জ্বলত কি জ্বলত না, যদি জ্বালা করত, কতটা জ্বলত, জ্বলুনির ধরন কেমন ছিল, কতক্ষণ জ্বলত– এটা বুঝি নিত এবং মনে রেখে দিত। এই পরীক্ষার ও নাম দিয়েছিল ‘পোঁদ টেস্ট’ এবং ও বুঝে নিয়েছিল এই গুহ্য পরীক্ষার সুপ্ত রহস্য।
ও বলত, ‘আমাকে কেউ ঠকাতে পারবে না।’ এবং সত্যিই তাই হত। বইয়ে যেসব পরীক্ষা পদ্ধতি লেখা আছে, সেগুলো ছাড়াও নিজের উদ্ভাবিত ইন্দ্রিয়-স্পর্শ প্রণালী প্রয়োগ করে ও খুব দ্রুত যৌগ শনাক্ত করে দিত। পরীক্ষায় ও খুব ভালো রেজাল্ট করে।
বি.এস.সি পাশ করার পর আমি রং ও বার্নিশ নিয়ে পড়তে যাই, কিন্তু চাকরি পেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে চাকরিতে ঢুকি, আর টেরিকট এমএসসি পড়তে যায়। শুনেছিলাম, ও বোমা বিশেষজ্ঞ হয়েছে। সেন্ট্রাল ফরেন্সিকে আছে। টেরিকটের সঙ্গে ফের দেখা হয়েছিল। বলা যায় ৩৫ বছর পর।
তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল। আকাশবাণীতে কাজ করি। সকাল ১০টায় অফিসে ঢুকি, কাজ শেষ হতে রাত ৮টাও বেজে যায়। প্রত্যেকদিন নয়, কখনও কখনও। বাড়ি থেকে কেরানি ভোগ্য চিরকালীন রুটি-আলুচচ্চড়ি নিয়ে আসি টিফিন-কৌটোয় ভরে। তখন আকাশবাণীতে একমাত্র স্টুডিওটাই এয়ারকন্ডিশন ছিল বোধ হয়। স্টেশন ডিরেক্টর আর স্টেশন ইঞ্জিনিয়ারের ঘর দুটোও। আমরা যে ঘরে বসতাম, সেটা ছিল একেবারে পশ্চিমে। বেলা দুটোর পর থেকেই প্রখর সূর্যতাপে ঘরটা তেতে থাকত। যেদিন কাজ বেশি থাকত, সেদিন দুপুরবেলা ঘর থেকে আনা টিফিন না খেয়ে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নিতাম। ঘর থেকে আনা টিফিন সন্ধের দিকে খেতাম, কারণ তখন ক্যান্টিনে তেমন কিছু পাওয়া যেত না। প্রচণ্ড গরমে খাবার-টাবার নষ্ট হয়ে যেত প্রায়শই। টক হয়ে যেত। আমি তারপর একটা বুদ্ধি বার করেছিলাম। স্টুডিওর মূল দরজাটা খুললেই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ-মূর্তি। টিফিন কৌটোটা খবর কাগজে মুড়ে দড়ি কিংবা সুতো দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটার পিছনে রেখে দিতাম, সন্ধের সময় টুক করে তুলে নিতাম।
কয়েকদিন এভাবেই চলল। কেউ কিছু জানত না। জানলেই বা কি আছে, এটা তো বেআইনি কিছু নয়! এইসময় পরপর এখানে-ওখানে বোমা উদ্ধার হতে লাগল। জঙ্গি হামলা বেড়েছে খুব। মুম্বইয়ের একটা প্রেক্ষাগৃহ থেকে উদ্ধার হল, দিল্লির বাস টার্মিনাসে বোমা ব্লাস্ট হল। কাশ্মীরেও এখানে ওখানে বোমা ফাটছে। এই সময় শোনা গেল, আকাশবাণীতেও বোমা পাওয়া গিয়েছে!
ডিউটি রুম থেকে ডিরেক্টরকে রিপোর্ট করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মূর্তির ঠিক পিছনের ব্রাউন পেপারে মোড়া, দড়ি দিয়ে প্যাঁচানো বোমা দেখা গেছে। আমাদের সিকিউরিটি অফিসারকে জানানো হয়েছে। সিকিউরিটি অফিসার যেখানে যেখানে জানাবার জানিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, আমি সেদিন খবর কাগজে নয়, একটা পার্সেলে আসা ব্রাউন কাগজে কৌটোটা মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে, ওখানেই রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের শীতলতার মধ্যেই রেখেছিলাম।
অনেকেই বোমাটা দেখতে যাচ্ছে। সিকিউরিটি অফিসার কাউকে কাছাকাছি ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। কেউ বলছে টাইম বোমা নয় তো? যদি নির্দিষ্ট সময়ে ফেটে যায়? এক্ষুনি সরিয়ে ফেলা উচিত। কেউ বলছে, জঙ্গিরা এখন প্রযুক্তগতভাবে খুবই এগিয়ে আছে। হতে পারে এটা রিমোট কন্ট্রোল, বাইরে থেকে কেউ কলকাঠি– কন্ট্রোল করছে। কেস অনেক দূরে চলে গেছে।
এই সময় আমার কী করা উচিত? বলে দেব, নাকি চেপে যাব? বিবেকের সঙ্গে আবেগের নীরব তর্কাতর্কির পর চেপে যাওয়াটাই স্থির করলাম। সবাই যেমন কৌতূহলে দেখতে যাচ্ছে, আমারও তেমন কৌতূহল দেখানো উচিত মনে হল। কিছুক্ষণ পরে আমিও সরল মুখ করে দেখতে গেলাম। তখনই টেরিকটের সঙ্গে দেখা। দেখা হল, হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ, প্রায় জড়িয়ে ধরাই বলা যায়। আমার খুব প্রেস্টিজ বেড়ে গেল।
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………..
এবার অকুস্থল। টেরিকটের সঙ্গে দু’জন সহযোগী এসেছে। একজনের হাতে মেটাল ডিটেক্টর। আর একজনের হাতে অন্য কী একটা যন্ত্র। আমাদের সিকিউরিটি অফিসারের সঙ্গে ও কথা বলল। তারপর রবীন্দ্রমূর্তি। টর্চ ফেলল টেরিকট। কাছাকাছি চলে গিয়ে উবু হয়ে বসল। একবার বেশ জোরে শ্বাস নিল। তারপর নিজেই মেটাল ডিটেক্টর হাতে নিল। ডান্ডাটা দিয়ে টেনে আনল বস্তুটা, এবার বেশ নিচু হয়ে ঘ্রাণ নিল। গন্ধ শুঁকল আর কী! তারপর ওর মুখে হাসির ঝিলিক। নিজেই দড়িটা খুলে ফেলল। প্লাস্টিকের গোল বাক্স। একটু একটু ঝোল চুঁয়ে পড়েছে। গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল ও। সেই কচি বয়সে যেমন পেত।
ভাগ্যিস সঙ্গে করে স্নিফার ডগ আনেনি। আনলে হয়তো আমার হাতটাই কামড়ে দিত!
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
২১. বাঙালির বাজার সফর মানেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম
২০. জাত গেল জাত গেল বলে পোলিও খাব না!
১৯: ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়!
১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে
১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম
১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী