নিউ ইয়র্ক বিমানবন্দরে নেমেছি, যিনি নিতে আসবেন, তাঁকে দেখছি না। আমার মোবাইলে ভারতের সিমকার্ড। তাই আমি হেল্প ডেস্ক এগিয়ে জানতে চাই, এই নম্বরে দয়া করে ফোন করে দেখুন, মি. অমুক এখন কোথায়? আমাকে নিতে আসার কথা ছিল। ডেস্কের মেমসাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘হ্যাভ ইউ কাম হিয়ার টু ডাই?’ আমি পারডন-পারডন বলায় উনি পুনর্বার বললেন, ‘হ্যাভ ইউ কাম হিয়ার টু ডাই?’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি প্রকৃত অর্থে মরতেই এসেছি এখানে? যদি ওরা কেউ না নিতে আসে, মরেই তো যাব! ফেরার টিকিট, টাকা কিছুই নেই। আমি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টায় বলি, ‘হোয়াই শুড আই ডাই?’ মেমসাহেব হেসে ফেলেন। বলেন, ‘ইউ নিড নট ডাই ম্যান, ফ্লিইজ টেল মি ইয়োর ফ্লাইট নাম্বার।’ বললাম। মেমসাহেব ফোন করলেন। বললেন, ‘সামওয়ান মৃত্যু ইস কামিং টু রিসিভ ইউ, ওয়েট দেয়ার নিয়ার ডেথ্।’ আমি সত্যিই ঘাবড়ে যাই। ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকি ওঁর মুখের দিকে। আবার বললেন, ‘গো দেয়ার, নিয়ার ডেথ। ওয়েট আনটিল মৃত্যু কাম্স।’
৭.
আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে যেদিন যোগ দিলাম, সেদিন ডিউটিরুমে একটা তর্ক চলছিল উচ্চারণ নিয়ে। বিখ্যাত সব ঘোষক তর্ক করছেন অতুলপ্রসাদের শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে। ‘অতুল’ না ‘ওতুল’? ‘অতুলনীয়’ বলি, ‘অপ্রতুল’ বলি, তবে ‘ওতুল’ বলব কেন? ‘প্রণবেশ’-কে ‘প্রোণোবেশ’ উচ্চারণ করা কি ভুল? কিন্তু করি তো। ‘লোকোসঙ্গীত’ নাকি ‘লোক্সঙ্গীত’– ইত্যাদি তর্কাতর্কির মধ্যে বেচারা আমি চুপচাপ শুনছি। এমন সময় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘নতুন জয়েন করেছ বুঝি? বেশ। ইয়ংম্যান, ছয়টার পরে এসো।’
জানতে পারলাম, উনি আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর। ছ’টার পর যেতে বলেছেন। পাঁচটায় ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টা খানেক এধার-ওধার ঘোরাঘুরি করে ছ’টার পর ওঁর চেম্বারে গিয়ে দেখি কেউ নেই। তারপর দিনও তাই। বস বলেছেন, অথচ তিনি নেই, ভুলে গেলেন? পাঁচটার আগেই একদিন গিয়ে বললাম ‘স্যর, ছ’টার পরে আসতে বলেছিলেন, কিন্তু…’। উনি আমার কথা থামিয়ে বলেছিলেন, ‘সে কী! আমি কেন বলতে যাব! আই ডু লিভ অফিস অ্যাট শার্প ফাইব পি.এম, অ্যান্ড রিচ হিয়ার শার্প এ্যাট টেন এ.এম। আমি আমতা আমতা করে বলি, বলেছিলেন স্যর। প্রথম দিন ডিউটি রুমে…। উনি বললেন, ‘ইয়েস, মনে পড়েছে আমি কইয়াছিলাম ছয়টার পরে আসতে। শীতকাল তো! ইয়ংম্যানগিরি দ্যাখাইতে হইব না। আজও তো দেখি ছয়টার পর নাই।’ এবার বুঝতে পারলাম উনি বাৎসল্যবশবর্তী হয়ে সোয়েটার পরে আসতে বলেছিলেন। ‘সোয়েটার’ শব্দটার উচ্চারণ হয়েছিল ‘ছয়টার’-এর মতো।
নিউ ইয়র্ক বিমানবন্দরে নেমেছি, যিনি নিতে আসবেন, তাঁকে দেখছি না। আমার মোবাইলে ভারতের সিমকার্ড। তাই আমি হেল্প ডেস্ক এগিয়ে জানতে চাই, এই নম্বরে দয়া করে ফোন করে দেখুন, মি. অমুক এখন কোথায়? আমাকে নিতে আসার কথা ছিল। ডেস্কের মেমসাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘হ্যাভ ইউ কাম হিয়ার টু ডাই?’ আমি পারডন-পারডন বলায় উনি পুনর্বার বললেন, ‘হ্যাভ ইউ কাম হিয়ার টু ডাই?’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি প্রকৃত অর্থে মরতেই এসেছি এখানে? যদি ওরা কেউ না নিতে আসে, মরেই তো যাব! ফেরার টিকিট, টাকা কিছুই নেই। আমি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টায় বলি, ‘হোয়াই শুড আই ডাই?’ মেমসাহেব হেসে ফেলেন। বলেন, ‘ইউ নিড নট ডাই ম্যান, ফ্লিইজ টেল মি ইয়োর ফ্লাইট নাম্বার।’ বললাম। মেমসাহেব ফোন করলেন। বললেন, ‘সামওয়ান মৃত্যু ইস কামিং টু রিসিভ ইউ, ওয়েট দেয়ার নিয়ার ডেথ্।’ আমি সত্যিই ঘাবড়ে যাই। ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকি ওঁর মুখের দিকে। আবার বললেন, ‘গো দেয়ার, নিয়ার ডেথ। ওয়েট আনটিল মৃত্যু কাম্স।’
কী আতান্তরে পড়লাম! মেমসাহেবের আদেশ পালন করলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দু’জন ভদ্রলোক এলেন। আমার কাছেই এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আমিই স্বপ্নময় চক্রবর্তী কি না। আমি ঘাড় নাড়ি। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমরাই রিসিভ করতে এসেছি। আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় সাহা, আর ইনি মুর্তজা।’ যাক, দুই মৃত্যু আমার সামনে। আমি বেঁচে গেলাম। গাড়িতে বললাম সব। সব শুনে বললেন, ‘‘মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হ্যাভ ইউ কাম টু ডে?’ ‘ডে’ শব্দটা ‘ডাই’-এর মতো বলেন ওরা।’’ আমি বললাম, ‘‘সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু ‘ওয়েট নিয়ার ডেথ’ বললেন কেন?’’ মৃত্যুঞ্জয়বাবু বললেন, ‘‘খেজুরের দোকানটার সামনে দাঁড়াতে বলেছিলেন বোধ হয়। খেজুরের ইংরেজি ‘ডেট্’ কি না। ডেট শপ। যাক। ছাড়ান দ্যান।’’
উচ্চারণ নিয়ে কতবার যে কতরকম মুশকিলে পড়েছি। ওড়িয়া ভাষায় ‘ঝিঙা’কে যেটা বলে সেটা শুনে এক তরকারি বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘যোনি কি কচি হবে?’ ভীষণ রেগে গেল! পরে জানলাম আমি যেভাবে বলেছি, সেটা ‘শুদ্ধ’ ওড়িয়া উচ্চারণ নয়, ঝিঙা হল ‘জোনহি’। অনেকটা যোনির মতোই শোনায়। আমি কী করব! আলুর উচ্চারণ অনেকটা ‘আড়ু’র মতো, কিন্তু ‘আড়ু’ নয়। ড় এবং ল-এর মাঝামাঝি ধ্বনি। একবার হল কী, কম্বোডিয়ার এক জায়গায় বাঁশের তৈরি নানারকম জিনিসপত্র দেখেছিলাম। কেনার ইচ্ছে হয়েছিল। দোকানের নাম ইংরেজি অক্ষরেও লেখাছিল – সম্ভবত ‘খাইলম গুং’। তখন টুকটুক করে যাচ্ছিলাম, নামতে পারিনি। টুকটুক আমাদের অটোরিকশার মতো। হোটেলে ফিরে পরে বেরলাম। আমি আমার ইংরেজিতে রাস্তার লোকজনের কাছে জানতে চাইলাম, ‘খাইলম গুং’ নামক দোকানটা কোথায়? একজন একটু অবাক হওয়ার ভান করে আমাকে বলল, ‘চলো, আমিও সেখানেই যাচ্ছি।’ যেখানে নিয়ে গেল– সেটা একটা গলির ভিতরে অন্ধকার ঘর। ধোঁয়ায় ভরা। ঝাঁঝালো গন্ধ। দেখলাম, কিছু লোক সরু বাঁশের নল দিয়ে ধোঁয়া টানছে। বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল এটা নেশা করার জায়গা। ড্রাগ নেওয়া হচ্ছে, বাঁশের নল দিয়ে ধোঁয়া টানা হচ্ছে। বাঁশেরই কম্বোডিয়ান শব্দটা বলেছিলাম নিশ্চয়ই, বাঁশের শিল্প দ্রব্য এবং বাঁশ দিয়ে নেশা করা বোঝানোর শব্দের সূক্ষ্ম উচ্চারণগত পার্থক্যই এই কাণ্ড!
অনেক ভাষার কতগুলি নিজস্ব ধ্বনি আছে, যা অন্য ভাষায় নেই। আল্লহ শব্দের হ ধ্বনি আখবার শব্দের খ ধ্বনি বাংলায় নেই। সাঁওতালি ভাষায় এমন কিছু ধ্বনি আছে যা বাংলা হরফে বোঝানো যায় না। পূর্ববঙ্গের কথ্যভাষার অনেক শব্দও মান্য বাংলায় নেই। তাই পরশুরামকে ‘চিকিৎসা সংকট’ গল্পে লিখতে হয়–’ হয় হয়। zানতি পার না।
আমাদের একজন মাস্টারমশাই কিছুতেই ‘বেঙ্গল’ বলতে পারতেন না। ‘বেঙ্গল ব্যাঙ্ক’ তাঁর উচ্চারণে ব্যাঙ্গল বেঙ্ক। একবার একটি বিচ্ছু ছেলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘স্যর, ভেক মানে কী?’ স্যর বলেছিলেন, ‘ভ্যাক জানো না? ফ্রোগ ফ্রোগ। তবে জানি, আমার মুখ থিক্যা বেঙ শুনতে চাও, তাই না? কান ধইরা খাড়া হও, হয়তান।’
সিন্ধুকে মধ্যএশীয়রা ‘হিন্দু’ বলত। অনেক ভাষাতেই ‘স’ ধ্বনি ‘হ’ হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গেও। ছোটবেলায় কতই শুনতাম ট্যাহা নাই হুইসা নাই। হাল দি হাল দি হাল আয়। মানে ফাল দি ফাল দি আয়। মানে লাফিয়ে লাফিয়ে আয়। হিয়ানো হাদাইছে মানে সেখানে লুকিয়েছে। অসমেও স-এর হ উচ্চারণ হয়। চট্টগ্রামে প, ফ, স– এরকম অনেক ধ্বনিই হ হয়ে যায়। মেক্সিকোর কাছাকাছি আমেরিকান উচ্চারণে ‘জ’ ধ্বনিও ‘হ’ হয়। দেখছি লেখা আছে ‘সান জোসে’, ওরা বলছে ‘সান হোসে’। এক দক্ষিণ ভারতীয় অফিসার পেয়েছিলাম, বলতেন, ‘অলওয়েজ কিপ ব্যাটারি ইন ইয়োর টর্চ।’ তামিলে বোধহয় ভ নেই। ইতালিতে ট নেই। ব্রিটিশ সাহেবরা চন্দ্রবিন্দুটা বোধ হয় উচ্চারণ করতে পারে না, তাই কাঁথি হয়ে যায় ‘কন্টাই’, চুঁচুড়া হয়ে যায় ‘চিনসুরা’। আমাদের একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে নীতি হল স্থানীয় লোকেরা যেমন উচ্চারণ করে, তেমন বাংলা বানান রাখা। তাই গান্ধী নয়, গাঁধী, বরোদা নয় বদরোদা। কেনিয়া নয়, কিনিয়া। তবে অস্ট্রেলিয়া কী হবে? ওরা তো উচ্চারণ করে ‘অইস্ট্রেলিয়া’। নিউজিল্যান্ডের উচ্চারণ ‘নিউ িZল্যান্ড’। রাশিয়ানরা মস্কোকে বলে প্রায় ‘মাস্খাট’। থাইল্যান্ডের লোক ‘তাইল্যান্ড’ বলে। জাপানিরা টোকিওকে ‘তোকিও’ বলে। তাহলে?
আকাশবাণীর চাকরিতে উচ্চারণগত সমস্যায় পড়েছি কতবার। হাওড়া জেলা থেকে আসা একজন ‘সব সমস্যার সমাধান’ উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘Sob Somosyar Somadhan’ বলছে। ব্যাকরণগতভাবে দন্ত্য স-এর উচ্চারণ তো এমনই হওয়ার কথা। কিন্তু এটা বাংলার মান্য উচ্চারণ নয়। ‘Shab Shamashyar Shamadhan’ এটাই মান্য উচ্চারণ। কী করা যাবে! শ্যামবাজারে শশীবাবু আষাঢ় মাসে শশা খাচ্ছেন– কলকাত্তাই উচ্চারণে হয়: স্যামবাজারের সসীবাবু আসার মাসে সসা খাচ্ছেন। এরকম উচ্চারণও রেডিওতে চলবে না। একজন অডিশন দিতে এসে গাইলেন– সিউলিতলার পাসে পাসে ঝরাফুলের রাসে রাসে। কেউ আবার স-এর উচ্চারণ ‘শ’ করেন। সাইকেল ‘শাইকেল’ হয়ে যায়। রাস্কেল ‘রাশকেল’। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর মুর্শিদাবাদে ‘র’ ধ্বনি নিয়ে বড় বিপর্যয়! রাম কখন ‘আম’ হবে আবার আম কখন ‘রাম’ রূপ নেবে বোঝা দায়! ‘র’ এবং ‘ল’-এর বিপর্যয়টাও খুবই দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে ‘র’ ধ্বনি ‘ল’ হয়, কিন্তু ‘ল’ ধ্বনি ‘র’ হয় না। ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায় আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র আছে, সেখানে বেশ কিছু বাংলাভাষী মানুষ আছেন বলে সপ্তাহে তিনদিন কিছুটা সময় বাংলা অনুষ্ঠান হয়। ঘোষক নিয়োগের জন্য একবার ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় মানুষেরা কুরমালি বাংলা বলেন। যেমন– এখন শুইনব্যেন Soঙ্গীত, হ্যামন্তো মুখার্জির গলায়।
………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………..
কিংবা, ‘ইখন ঝুমুর সুনাইব্যেন র্যাবতীবালা।’ কলকাতা থেকে একজন নামকরা বাচিকশিল্পী গিয়েছিলেন নির্বাচক হিসেবে। উনি বললেন, ‘এরকম উচ্চারণ চলবে না।’ অথচ ওরকম উচ্চারণই ওই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। কী করব আমি? এর আগে যিনি ছিলেন উনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কের কাজে বদলি হওয়া এক কর্মচারীর স্ত্রী। আকাশবাণীর সেই কর্তাব্যক্তিকে, যিনি আমাকে সোয়েটার পরে আসতে বলেছিলেন, তাঁকে ফোন করি। উনি বলেছিলেন, ‘রেডিওতে উশ্চারণটাই তো আসল। বিকৃত উশ্চারণ চলবে না।’
অথচ সেই রেডিও তো এখন শুনি অনায়াসে হিন্দি-ঘেঁষা উচ্চারণ চলছে। মীনাকসি, অমিতাভ্, লছমী… ইত্যাদি। উশ্চারণ বিধি জানি না কোথায়!
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী