কথায় কথায় ‘ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেব’ বলা টোকলা এখন পুরো ফোকলা… যে সেলুনটির মালিক নকুলদা একদা অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল– ‘দেখে নিস, এই উত্তমছাঁট-টাই উঠে যাবে, দেখে নিস এই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবে, দেখে নিস, ফুটবল খেলা দেখতে লোক যাবে না!’ আমার বাল্যবয়সে এসব ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। বছর বারো আগে দেখা। বৃদ্ধ হয়েছেন, নিজে চুল কাটেন না, কর্মচারি রাখা আছে। বললেন– ‘বলে রাখলুম, এই বাগবাজারে আবার বাঘ ফিরে আসবে।’ এটাও মিলে গেছে! বাগবাজারে গেলে দেখতে পাবেন বাটা-মোড়ের কাছাকাছি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রোল-চাউমিনের দোকানটার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে আছে।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
৮.
ছোটবেলাটা বাগবাজারে কাটিয়েছি। লকডাউনের আগে, মাসে একবার করে হলেও ওদিকে যেতাম, এ-গলি ও-গলি ঘুরে বেড়ালে মনের নানাবিধ ভাবসঞ্চার আস্বাদন করতাম। কেতাবাজ প্রবীর এখন স্থবির। [একবার বলেছিল পকেটে চিরুনি থাকলে বার কর। তারপর বুক পকেট থেকে একটা ডাঁটি বাইরে ঝোলানো সানগ্লাসটা চোখে পরে নিয়ে (সানগ্লাসকে গগলস্ বলতাম, যেমন ওমলেটকে মামলেট) বলেছিল– দ্যাখ, আমার চোখের কাচে মুখ দেখতে পাচ্ছিস তো, মাথাটা আঁচড়ে নে]।
কথায় কথায় ‘ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেব’ বলা টোকলা এখন পুরো ফোকলা…। যে সেলুনটির মালিক নকুলদা একদা অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল– ‘দেখে নিস, এই উত্তমছাঁট-টাই উঠে যাবে, দেখে নিস এই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবে, দেখে নিস, ফুটবল খেলা দেখতে লোক যাবে না!’ আমার বাল্যবয়সে এসব ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। বছর বারো আগে দেখা। বৃদ্ধ হয়েছেন, নিজে চুল কাটেন না, কর্মচারি রাখা আছে। বললেন– ‘বলে রাখলুম, এই বাগবাজারে আবার বাঘ ফিরে আসবে।’ এটাও মিলে গেছে!
বাগবাজারে গেলে দেখতে পাবেন বাটা-মোড়ের কাছাকাছি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রোল-চাউমিনের দোকানটার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে আছে। গিরীশমঞ্চের কাছাকাছি এক জায়গায় বাঘে-হরিণে একসঙ্গে জল খাচ্ছে, ঝর্নার জল। সব সৌন্দর্যায়ন আর কি!
কখনও যেন মনে হয়, মা সারদা গঙ্গাস্নান করে দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গেলেন এই মাত্র, ওঁর সাদা শাড়ি থেকে ঝরা জল ফোঁটা ফোঁটা পড়ে আছে, গিরিশ ঘোষের বাড়ির ছাদ থেকে পেটকাটি ঘুড়ি উড়ছে, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ছাদে মুখপোড়া ঘুড়ির লড়াই চলছে, পশুপতি বসুর বাড়ির ইলিশমাছ ভাজার গন্ধে পাড়া ম’ ম’ করছে। (বেনি ঝোলানো শাড়ি পরা মেয়েরা যাচ্ছে নিবেদিতার ইস্কুলে) নিধুবাবুর শিষ্য মোহনচাঁদ গলা সাধছে, জানালায় দাঁড়িয়ে শুনছে গোপাল উড়ে।
এভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পুরনো পাড়া দিয়ে হাঁটছি। খালধারে নাটাদার ঠেক-এ এখন মোটর গ্যারাজ। কিছুদিন আগে নাটাদার সঙ্গে কথা হয়েছিল। নাটাদা ওর ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল। বলছিল– ‘কীসব হয়ে গেল রে চোখের সামনে…। চোরগুলোর নাম হয়ে গেল সমাজসেবী, ওদের গলায় মালা দিচ্ছি, তালি মারছি, জেনেবুঝে যে, ওরা হিস্সা খোর। আরে, আমরাও গুন্ডা ছিলাম, কিন্তু পাড়ার দেক্ভাল করতাম, কোনও বেপাড়ার কেউ এসে এ পাড়ার মেয়েদের টোন-টিটকিরি করতে পারত না। ভোটে দাঁড়ানো নেতাদের কিছু কাজকর্ম করে দিতাম, ওরা এজন্য পয়সাকড়ি দিত, থানাটা সামলে দিত। তা বলে নিজেরাই ভোটে দাঁড়িয়ে পাবলিকের প্রতিনিধি হতে চাইতাম না। কারণ আমরা তো জানতাম আমরা কী?’
এরকম কত! গলিতে গলিতে গুপ্ত গল্প। একদিন মারাহাট্টা ডিচ লেন দিয়ে হাঁটছি, দেখছি জজসাহেবের বাড়ির সিঁড়িতে বসে বিড়ি বাঁধছে কয়েকজন, আর সিংহটার মুখের ভিতরে বসে আছে একটা পায়রা। (ফটিক সাহার মুদি দোকানটাকে তিন টুকরো করে তিন ছেলে বসছে) কটকটি-তেলেভাজার দোকানটায় মোবাইল রিচার্ড হয়, জেরক্সও। ডালবড়াটা কি ভালোই না করত!
এমন সময় এক প্রৌঢ়া আমার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
‘কী গো, চিনতে পারছ?’ চোখ-মুখে কারুকাজ: হাসছে, ও হাসির ব্যাখ্যা, কোনও মানে-বইতে থাকবে না। একটা চোখ মৃদু টিপে দিল। দাঁতে ঠোঁট টিপল। সামনে দুটো দাঁতই নেই।
খুব চেনা লাগছে, অথচ চিনতে পারছি না। আমি মাথা নাড়াই, না তো…।
‘এ তো ঝাড়ি কত্তে, আমি কলের জলে নাইতে এলে তুমি তোমাদের বারান্ডায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে…। তাছাড়া তুমি আমাকে এই দোকানটা থেকে ডালবড়া খাইয়েচ কতদিন… কাপের আইসকিরিম একদিন, তাছাড়া…।’
আমি চিনতে পারি। ওর মাকে আশার মা বলত। মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই দারুণ দেখতে ছিল। টানটান শরীর। ছেলেদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলত। কর্পোরেশনের ইস্কুলে পড়ত। জগা, তাপস, ঘনারা বলতো স্কিপিং লাফাত দেখি, কেমন পারিস? একশো লাফালে দুটো ডালবড়া! ও স্কিপিং লাফাত। তখনও ফ্রক। ১৩-১৪ বছর বয়েস। আমি ক্লাস সিক্স।
‘তোমার মতন দেখতে একজন আছে, জানো তো, টিভিতে দেখি মাঝে মাঝে।’ আমি বলি, তাই বুঝি? কী নাম?
‘কে জানে, কী নাম। ওসব ফালতু পোগ্গাম দেখি নাকি তাই? ভাটের! কিন্তু এক্কেবারে তোমার মতোই দেকতে। মাইরি বলছি। যাক্ গে যাক। আমাকে চিনতে পারছ তো? কতদিন পরে দেকা, আমার নামটা কী বলত, আমার নামে কিন্তু একজন সিনিমা আর্টিস ছিল, হিরোইন। হিন্টু দিলুম, হি হি।’
হিন্ট লাগত না। তুমি তো আশাদি। কিন্তু তুমি তো বিলেত চলে গিয়েছিলে, পাবলো তোমায় বিয়ে করেছিল না? পাবলো ছিল যুগোশ্লোভিয়ান সাহেব। তখন সল্টলেক ভরাট করার কাজ চলছিল। ড্রেজারে গঙ্গার মাটি কেটে কাদা করে সল্টলেকে পাঠাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটা যুগোশ্লাভ কোম্পানিকে। অনেক সাহেব থাকত তখন। কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়েছিল। ডাংগুলি, সাতগুটি এসব খেলত।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
আমাদের একটা খেলাও ছিল, যেখানে জিতলে বা হারলে টাকা দিতে হত। আমাদের কাছে টাকার বান্ডিল থাকত, সিগারেটের প্যাকেট থেকে টাকা তৈরি হত। কাঁচি, পাসিং শো সিগারেট প্যাকেটের দাম কম ছিল, ক্যাপস্টান, গোল্ড ফ্লেকের বেশি। ফাইভ ফিফটি ফাইভ হাজার টাকা। পেতাম না তো। যুগোশ্লাভ সাহেবরা ওদের দেশের খালি প্যাকেট দিত। দু’-হাজার টাকা দাম ছিল! সাহেবদের নাম ছিল পাবলো, টিটো, ড্যানিয়েল, জোসেফ…।
পাবলো এই মেয়েটাকে ড্রেজারে নিয়ে যেত। তারপর ১৯৬৬ নাগাদ পাবলো মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। খিলখিল হেসে উঠল ফোকলা আশাদি। বলল, ‘সে তো সেই কবেকার কথা। তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গায়। পাবলো বছর পাঁচ রেখেছিল।
‘এ্যাই পুঞ্চু, আয় আয়…। ইদিকে আয়।’
একটা বছর চারেকের ছেলে রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের লেজ সোজা করছে।
‘এই দ্যাকো পাবলোর চিন্নো।’
দেখি ওর চোখের নীল তারা। রং ফর্সা। বলল– ‘আমার নাতি। ছেলে, মানে, আমার পাবলোর একটা মেয়ে হয়। মেরি। গোয়াতে বারে গান গায়। ডান্সও করে। নাতিটা আমার কাছেই। ইংলিশ মিডিয়াম নার্শারিতেও দিইচি। ওদেশে যাবার কিছুদিন পর খুব গণ্ডগোল। ওদের সার্বিয়ান, বসনিয়ান, কোয়েশিয়ান কতরকম গুরুপ। আর মারপিট! পাবলোর মাথায় বোমার টুকরো ঢুকল, আমি বডি বেচে পয়সা রোজগার কত্তুম, ওখানে এক জাহাজির সঙ্গে আলাপ। ইউসুফ। ও আমাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে এল ফের। আন্ধেরিতে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল– সে অনেক কথা! চলো এক কাপ চা খেয়ে যাও। এই তো আমার ঘর। একটা সেন্টার করেছি। আয়া, রান্নার লোক, বাসন মাজার লোক সাপ্লাই করি। বডি মেসাজের মেয়েও…’ বলে চোখের খেলা খেলল। সেই পুরনো কালের।
ঘরে নিয়ে গেল। খাটে শুয়ে আছে এক সত্তরোর্ধ্ব মানুষ। সস্তার সোফা সামনে। বলল, ‘ইউসুফও গেল। এখন এই লোকটাকে আমি রেখেছি। আমার বর। ওই দেখ পাবলো। তোমাদের বন্ধু।’
একটা দেওয়ালে পাবলোর ছবি, অন্য দেওয়ালে যিশু কোলে মেরি, গোপাল কোলে যশোদা আর অন্য একটি শিশু কোলে আশা। জিজ্ঞাসা করি– ওই বাচ্চাটা কে? বলে– ‘ ইউসুফের। বাচ্চাটা ও নিয়ে গেছে। আমাকে তালাক দিল তো। খ্রিশ্চান হয়ে ওদের চার্চে পাবলোকে বিয়ে করেছি, মুসলমান হয়ে ইউসুফকে। এই লোকটাকে আর বিয়েটিয়ে করিনি, আমি এখন হিন্দু না খ্রিশ্চান না মোসলমান জানি না কিনা…!’
বিছানায় শোয়া লোকটা ভাবলেশহীন।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী